ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আরও তিন মৃত্যু ॥ নতুন আক্রান্ত ৫৪৯

নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনা রোগী

প্রকাশিত: ২২:১৪, ২৯ এপ্রিল ২০২০

নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনা রোগী

নিখিল মানখিন ॥ দেশে একদিনে করোনায় আক্রান্ত ও পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার নতুন রেকর্ড হয়েছে। নমুনা সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন করে শনাক্ত হওয়া করোনা রোগীর সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও তিনজন করোনা রোগীর মৃত্যু এবং নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪৯ জন। ৪ হাজার ৩৩২টি নমুনা পরীক্ষা করে এই ফল পাওয়া গেছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা ১৫৫ জন এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৬ হাজার ৪৬২ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৮ জন এবং এখন পর্যন্ত দেশে মোট ১৩৯ জন সুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার তুলনায় করোনা শনাক্তের হার বাংলাদেশে বেশি। এদিক দিয়ে করোনা আক্রান্ত বিশ্বের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দেশকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। আর শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশ খুবই কম নমুনা পরীক্ষা করছে। বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে নমুনা পরীক্ষা কয়েকগুণ বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক ডিজিটাল কোম্পানি ‘ওয়ার্ল্ডোমিটার’ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে মোট পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার ভিত্তিতে করোনা রোগী শনাক্তের হার ১২ শতাংশ। তবে এই হার ১৩ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করে থাকে। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার ভিত্তিতে করোনা রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৩ শতাংশ। বিশ্বের অন্যান্যে দেশে এই হার অনেক কম। আর বাংলাদেশ বর্তমানে শনাক্তকৃত রোগী সংখ্যার তুলনায় ৯ গুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই হার আরও অনেকগুণ বেশি বলে ওয়ার্ল্ডোমিটার সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট পরীক্ষিত মোট নমুনার সংখ্যা ৫৪৭২৩টি। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬০ জেলা করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট ২৫ ল্যাবরেটরিতে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্তের হার যত কম হবে, দেশের করোনা পরিস্থিতির উন্নতির চিত্র তত বেশি বাস্তবসম্মত হবে। দেশে করোনা সংক্রমণ চতুর্থ ধাপের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ ধাপটি হলো ‘ মহামারী ’। এই ধাপে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়। বাহক ও আক্রান্তের নির্দিষ্ট হিসাব রাখা সম্ভব হয়ে উঠে না। করোনা সংক্রমণের তৃতীয় পর্যায় ‘ কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করেছে , যা মহামারী ধাপের পূর্ব মুহূর্ত। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের শেষ পর্যায়ে এসে দৈনিক করোনা টেস্ট করার সক্ষমতা বর্তমান অবস্থার চেয়ে অনেকগুণ বাড়ানো না হলে দেশের করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া না গেলে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করবে, যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। নতুন করে ৩ জনের মৃত্যু, নতুন আক্রান্ত ৫৪৯ জন ॥ মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতর আয়োজিত নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে দেশের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। অতিরিক্ত মহাপরিচালক জানান, নতুন করে যে তিনজন মারা গেছেন তারা সবাই পুরুষ, ঢাকার বাসিন্দা এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সী। গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে রাখা হয়েছে ১১১ জনকে। এখন পর্যন্ত মোট আইসোলেশনে রাখা রোগীর সংখ্যা এক হাজার ২৪৮ জন। ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশন থেকে ছাড় পেয়েছেন ৪৭ জন। এখন পর্যন্ত ছাড় পেয়েছেন ৭৮৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৯২ জনকে। এখন পর্যন্ত এক লাখ ৮১ হাজার ৭৯৩ জনকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে। কোয়ারেন্টাইন থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ছাড় পেয়েছেন ৩ হাজার ২৩১ জন, বর্তমানে মোট কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৭৬ হাজার ৮৪০ জন। অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা আরও জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় বিমানবন্দরসমূহে ৩১৪ জন, স্থলবন্দরসমুহে ৬১ জন এবং সমুদ্রবন্দরসমুহে ১২৬ জন বিদেশফেরতকে স্ক্রিনিং করানো হয়েছে। এ পর্যন্ত বিমান, সমুদ্র ও স্থলবন্দরে এবং ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন দিয়ে প্রবেশ করা মোট ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৭৮২ জন বিদেশফেরতকে স্ক্রিনিং করানো হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান, এ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৫৯২টি পিপিই এবং বিতরণ করা হয়েছে ১৩ লাখ ৯ হাজার ৪৮ট। বর্তমানে মজুদ রয়েছে ৩ লাখ ৪১ হাজার ৪৪৪টি পিপিই। করোনা সংক্রান্ত কলের বিষয়ে তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় স্বাস্থ্য বাতায়নের নম্বরে ৫০ হাজার ২০৬টি, ৩৩৩ নম্বরে ৯ হাজার ২৭৮টি এবং আইইডিসিআর’র নম্বরে ২৭০৩টি করোনা সংক্রান্ত কল এসেছে। অর্থাৎ গত ২৪ ঘণ্টায় মোট কল এসেছে ৭২ হাজার ১৮৭টি। এ পর্যন্ত হটলাইনগুলোতে করোনা সংক্রান্ত মোট কল এসেছে ৩৫ লাখ ৪১ হাজার ৫৭৬টি। দেশের ৬০ জেলায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ॥ দেশের ৬০ জেলায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা সিটিতেই ৩০০৭ জন, যা দেশের মোট আক্রান্তের ৫০ শতাংশ এবং সিটি বাইরে ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় শনাক্ত হয়েছে ১৮৫০ জন, যা মোট আক্রান্তের ৩১.৯৯ শতাংশ। এভাবে ঢাকা বিভাগে মোট শনাক্ত হয়েছে ৪৮৫৭ জন, যা মোট আক্রান্তের ৮৩.৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত একদিনের ব্যবধানে ঢাকা বিভাগে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। গত সোমবার এবিভাগে মোট আক্রান্তের হার ছিল ৮৫ শতাংশ। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের ঢাকা জেলায় ৮৮ জন, গাজীপুরে ৩১৮ জন, কিশোরগঞ্জে ১৯৪ জন, মাদারীপুরে ৩৮ জন, মানিকগঞ্জে ১৫ জন, নারায়ণগঞ্জে ৮৪৯ জন, মুন্সীগঞ্জে ৮২ জন, নরসিংদীতে ১৪২ জন, রাজবাড়ীতে ১৪ জন, ফরিদপুরে ৯ জন, টাঙ্গাইলে ২৭ জন, শরীয়তপুরে ১৪ জন ও গোপালগঞ্জ জেলায় ৫০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের ৯টি জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২২৭ জন, যা মোট আক্রান্তের ৩.৯৩ শতাংশ। এভাবে ঢাকা বিভাগের চট্টগ্রাম জেলায় ৬৭ জন, কক্সবাজারে ১৯ জন, কুমিল্লায় ৪৭ জন, বি-বাড়ীয়ায় ৩৫ জন, লক্ষ্মীপুরে ৩৪ জন, বান্দরবানে ৪ জন, নোয়াখালীতে ৬ জন, ফেনীতে ৪ ও চাঁদপুরে ১১ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় মোট অক্রান্তের সংখ্যা ১০২ জন, যা মোট আক্রান্তের ১.৭৬ শতাংশ। এই বিভাগের সিলেট জেলায় ১৬ জন, মৌলভীবাজারে ১২ জন, সুনামগঞ্জে ২৬ জন ও হবিগঞ্জে ৪৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। রংপুর বিভাগের আটটি জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১০৪ জন, যা মোট আক্রান্তের ১.৮০ শতাংশ। এই বিভাগের রংপুর জেলায় ২৪ জন, গাইবান্ধায় ১৯ জন, নীলফামারীতে ১১ জন, লালমনিরহাটে ২ জন, কুড়িগ্রামে ৬ জন, দিনাজপুরে ১৬ জন, পিরোজপুরে ৭ ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। খুলনা বিভাগের ৯টি জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১০১ জন, যা মোট আক্রান্তের ১.৭৫ শতাংশ। আর এই বিভাগের খুলনা জেলায় ৮ জন, যশোরে ৩৬ জন, বাগেরহাটে ১ জন, নড়াইলে ১৩ জন, মাগুরায় ৪ জন, মেহেরপুরে ২ জন, ঝিনাইদহে ১৯ জন, কুষ্টিয়ায় ১০ জন ও চুয়াডাঙ্গায় ৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২১৯জন, যা মোট আক্রান্তের ৩.৭৯ শতাংশ। এই বিভাগের ময়মনসিংহ জেলায় ১১৭ জন, জামালপুরে ৫২ জন, নেত্রকোনায় ২৭ জন ও শেরপুরে ২৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১১১ জন, যা মোট আক্রান্তের ১.৯২ শতাংশ। এই বিভাগের বরগুনায় ৩০ জন, ভোলায় ৪ জন, বরিশালে ৪০ জন, পটুয়াখালীতে ২৩ জন, পিরোজপুরে ৮ জন ও ঝালকাঠিতে ৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। রাজশাহী বিভাগের সাতটি জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৬২ জন, যা মোট আক্রান্তের ১.০৭ শতাংশ। এই বিভাগের রাজশাহী জেলায় ১০ জন, জয়পুরহাটে ২১ জন, পাবনায় ৮ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২ জন, বগুড়ায় ২৭ জন, নওগাঁয় ১ জন ও সিরাজগঞ্জে ৩ জন আকান্ত হয়েছেন। নমুনার সংখ্যা বাড়াতেই হবে ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালর ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে করোনা সংক্রমণের চতুর্থ ধাপের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। সংক্রমণের বর্তমান অবস্থাকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ক্লাস্টার বলে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। সংক্রমণের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন অনেক আগেই শুরু হয়ে ক্লাস্টার অতিক্রম করে ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করেছে। ইউরোপের করোনা আক্রান্ত প্রতিটি দেশে শত শত নমুনা টেস্ট সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। ইউরোপের কথা বলতে হবে না, দক্ষিণ কোরিয়াতেই রয়েছে প্রায় ৬শ’টি নমুনা টেস্ট ল্যাবরেটরি। আগামী ১০ দিনের মধ্যে ন্যূনতম ৫০ হাজার নমুনা টেস্ট করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করতে পারলে দেশের করোনা পরিস্থিতির আরও পূর্ণাঙ্গ চিত্র বেরিয়ে আসবে। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ জাহিদুর রহমান বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে সংস্পর্শে আসা সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি। আইইডিসিআর এ কাজটি করতে পারেনি। পরীক্ষা তো পরের কথা, তারা কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজটাই একেবারে দায়সারা গোছের করেছেন। এমনকি ৃলক্ষণ প্রকাশের পরও তারা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের পরীক্ষা করতে গড়িমসি করেছেন। এখন ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নমুনা পরীক্ষায় এখনও পেছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে ব্যাপক হারে নমুনা পরীক্ষার বিকল্প নেই।
×