ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

এবার কৃষিই হয়তো আমাদের বাঁচাবে

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ২৮ এপ্রিল ২০২০

এবার কৃষিই হয়তো আমাদের বাঁচাবে

অনবরত দুঃসংবাদ পাওয়া এবং তা নিয়ে লেখার পর দেশ থেকে দুটি সুসংবাদ পেয়েছি। একটি সুসংবাদ কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক দিয়েছেন এবং দ্বিতীয় সুসংবাদটি পেয়েছি সংবাদপত্রে। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, দেশে হাওড়ের ৫১ পার্সেন্ট ধান কৃষকের ঘরে উঠেছে। অন্যদিকে করোনার জন্য বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ধান কেটে ঘরে তোলার শ্রমিকের অভাব হওয়ায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও কৃষক লীগের নেতাকর্মী এবং ছাত্র-শিক্ষকসহ নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন কৃষকদের ধান কেটে দিচ্ছেন জেনে তাদেরও অভিনন্দন জানাচ্ছি। এটা দ্বিতীয় সুসংবাদ। করোনার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী অর্থনৈতিক মন্দা ঠেকানোর জন্য কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ডাক দিয়েছেন। দেশের কৃষক সমাজও তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। এবারের বাজেটেও সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে কৃষি এবং স্বাস্থ্য। এই আশাব্যঞ্জক খবরের পাশাপাশি যখন শরিয়তপুরে ৫৩ বস্তা চালসহ ইউপি সদস্যের গ্রেফতার হওয়ার খবর শুনি, তখন অন্তরাত্মা ক্রোধে জ্বলে ওঠে। পাঠকেরা আমাকে ক্ষমা করবেন, এই সকল দুর্বৃত্তকে মৃত্যুদ- দেয়া হলেও কম শাস্তি দেয়া হয়। বহু বছর পর ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ প্রভৃতি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অভিনন্দন জানাতে পারছি। দেশের এই দুর্দিনে তারা কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়াতে পারছেন। এটা তাদের অতীতের অনেক দুর্নাম ঘুচিয়ে দেবে। শুধু আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো নয়, দেশের নানা পেশার, নানা দলের মানুষ ধান কাটায় কৃষি শ্রমিকদের সাময়িক ঘাটতি পূরণে এগিয়েছেন। সে জন্যে তাদের আবারও ধন্যবাদ জানাই। ব্রিটিশ আমলে ম্যালেরিয়া মহামারীতে যখন অবিভক্ত বাংলাদেশ ধ্বংস হতে যাচ্ছিল, তখন স্যার গুরুসদয় দত্ত ‘সারা বাংলার স্কুল কলেজের ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করে বয় স্কাউট ধরনের সংস্থা করে ম্যালেরিয়ার উৎস কচুরিপানা ধ্বংস করার অভিযান শুরু করেছিলেন। ছাত্ররা গ্রাম-গ্রামান্তরে গিয়ে খাল-বিল, পুকুর ও নদী থেকে কচুরিপানা ধ্বংস করে অবিভক্ত বাংলায় ম্যালেরিয়ার উচ্ছেদ ঘটিয়েছিল। কচুরিপানা ধ্বংসের অভিযানে বয় স্কাউটদের কণ্ঠে গান ছিল, ‘আয় কচুরি নাশি, এই কচুরি লক্ষ গলায় দিচ্ছেরে ভাই ফাঁসি।’ তখন ম্যালেরিয়ায় অবিভক্ত বাংলায় বছরে ৫০ লাখ লোকের মৃত্যু হতো। এবার মহামারী করোনা দৃশ্যমান শত্রু নয়। এর উৎসও জানা যায়নি। এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কষ্টকর। এই মহামারীর প্রকোপ সারা বিশ্বে। এ সময় বাংলাদেশের জনসমাজ, বিশেষ করে ছাত্রলীগ দেশে কৃষি শ্রমিকের অভাব পূরণে সম্মিলিত হয়ে আরও জোর ভূমিকা রাখলে স্যার গুরুসদয় দত্তের বয় স্কাউটদের মতো একটি মহৎ কাজের উদাহরণ তৈরি করবে। দেশে কৃষি শ্রমিকের অভাব নেই। প্রতিবছর ধান কাটার সময় প্রায় প্রতিজেলা-উপজেলা থেকে তারা হাওড়ে যায়। এক জেলার শ্রমিক কাজের খোঁজে অন্য জেলায় যায়। এবারেও তাই হতো! কিন্তু করোনা মহামারী এবং তজ্জনিত সরকারের লকডাউননীতির দরুন সাধারণ মানুষের সঙ্গে শ্রমিকরাও গৃহবন্দী। এই অবস্থায় হাওড় অঞ্চলে ছাত্র-জনতার সহযোগিতায় ইতোমধ্যে যে ৫১ পার্সেন্ট ধান কৃষকের ঘরে উঠেছে এটা একটা বড় সুসংবাদ। জানা গেছে বাকি ফসলও ৭ মের মধ্যে কাটা ও মাড়াই করা শেষ হবে। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ‘পরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা এবং লকডাউনের মধ্যেও আমরা হাওড় অঞ্চলে ধান কাটার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিকদের আনার ব্যবস্থা করেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিকরা আসছে। তারা করোনায় আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতিও এই ধান কাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে।’ কৃষি দফতরের তথ্য অনুযায়ীÑকিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়াÑ এই সাতটি জেলার কেবল হাওড়েই ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। বাইরের জেলার শ্রমিকেরা নওগাঁয় ধান কেটে দিচ্ছে। তাছাড়া কৃষকের পাকা ইরি ধান কেটে মাড়াই করে ঘরে তুলে দিচ্ছে জেলা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বাগেরহাটে ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। ধান কাটছে শ্রমিকসহ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সিপিবি’র নেতাকর্মীরা। তাদের আশা, বৃষ্টি বাদল না হলে মে মাসের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ধান কাটা শেষ হবে। কৃষি বিশেষজ্ঞদেরও অভিমত, কোন বৃষ্টি বাদল না হলে বাংলাদেশে খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে না। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ সতর্ক বার্তা উচ্চারণ করেছে যে, বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে বড় রকমের খাদ্য ঘাটতির জন্য দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বের এই খাদ্যাভাবের জের বাংলাদেশেও পড়তে পারে। আমার ধারণা, প্রকৃতি যদি এবার বাদ না সাধে এবং বর্ষা শুরু হওয়ার আগে ক্ষেতের ধান কেটে কৃষক গোলা ভর্তি করতে পারে এবং একশ্রেণীর মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং আমলা বড় রকমের দুর্নীতি করতে না পারে তাহলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়ার তেমন কারণ নেই। কৃষকের ক্ষেতের ধান কেটে মাড়াই করে তাদের গোলায় তুলে দিতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ যেভাবে সাহায্য জোগাচ্ছে, তারা তেমনি খাদ্য নিয়ে দুর্নীতি দমনে সমানভাবে সজাগ থাকলে করোনা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আসন্ন মন্দা ও খাদ্যাভাবের ধাক্কা থেকে মুক্ত থাকতে না পারলেও সামলাতে সক্ষম হবে। আমি শেখ হাসিনার জাদুকরি নেতৃত্বে বাংলাদেশকে শতাব্দীর সব চাইতে বড় সঙ্কট অতিক্রম করতে দেখা সম্পর্কে আশাবাদী। কোভিড-১৯ এর ভয়ঙ্কর হামলা থেকে দেশ এখনো মুক্ত নয়। কবে এই হামলা শেষ হবে তা কেউ জানে না। তার ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষের যে পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তাতে বিশ্বের সকল মানুষ আতঙ্কিত। আতঙ্কিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বাক্যবীর মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এই সময় অতীতের একটি কাহিনী মনে পড়ছে। ওয়ারশ’ শহরে বড় বড় দেশগুলোর বৈঠক বসেছে। চীনকে তখনো আমেরিকা স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রশ্নে চীনের সঙ্গে ওয়ারশ’ শহরে গোপনে মিলিত হয় এবং আলোচনা করে। এটাও ছিল এই ধরনের সম্মেলন। সে সময়েও বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ও খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বৈঠকে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রস্তাব ছিল, তারা চীন ও ভারতকে ট্রাক্টর দেবে এবং তার সাহায্যে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে ভারত ও চীন নিজেদের এবং বিশ্বের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করবে। ভারত ট্রাক্টর কেনার প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং চীন তা প্রত্যাখ্যান করে। চীনের যুক্তি ছিল, ট্রাক্টর দিয়ে কৃষি উৎপাদন তেমন বাড়ানো যাবে না এবং পশ্চিমা যন্ত্রপাতি কিনে কৃষি জমিতে সেচের ব্যবস্থা করলে খরচ পোষাবে না। তার বদলে তাদের বিপুল জনশক্তি আছে। তাদের সেচের ও চাষের কাজে লাগালে অনেক বেশি ফল পাওয়া যাবে। সে বছর ভারত পশ্চিমা যন্ত্রপাতি কিনে জমিতে জল সেচের ব্যবস্থা করেও খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারেনি। মন্দাও ঠেকাতে পারেনি। চীন বিপুল খাদ্য উৎপাদন করেছে এবং মন্দা ঠেকিয়েছে। চীনের মতো বাংলাদেশেরও সুবিধা এই যে, তার বিপুল জনশক্তি আছে। তার বেশিরভাগ গ্রামে থাকে। করোনা শহরাঞ্চলে হামলা চালায় বেশি এবং শিল্প-শ্রমিকেরা লকডাউনে যেতে বাধ্য হয়। গ্রামের কৃষকেরা স্বাস্থ্যবিধি মানে, কিন্তু ততটা গৃহবন্দী হতে হয় না। এবারেও দেশের কল-কারখানা বন্ধ, কিন্তু কৃষি উৎপাদন বন্ধ হয়নি। কৃষকের গোলায় যদি খাদ্য থাকে এবং তা যদি সারাদেশের জন্য পর্যাপ্ত হয়, তাহলে অর্থনৈতিক মন্দার গ্রাস যত বড় হোক, মওজুদ খাদ্যের জোরে বাংলাদেশ তার অনেকটাই মোকাবেলা করতে পারবে। আমি আওয়ামী লীগের অনেক কর্মকা-ের সঙ্গে সহমত পোষণ করি না, কিন্তু শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে আশা রাখি। আমার বিশ্বাস, আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ, তবুও তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিপদ উৎরাতে সক্ষম হবে। [লন্ডন ২৮ এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২০২০।]
×