ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসার কাহিনী

প্রকাশিত: ২২:০৪, ২৭ এপ্রিল ২০২০

  অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসার কাহিনী

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশে রবিবার বিকেল পর্যন্ত প্রাণঘাতী করোনায় ১৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর পাঁচ হাজার ৪১৬ জন আক্রান্তের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১২২জন। সুস্থ হওয়ার চেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এটা ঠিক। কিন্তু আক্রান্ত মানেই মৃত্যু নয়, একথা বারবার বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আর দেশে ২০-৪০ বছর বয়সী মানুষ বেশি আক্রান্ত হলেও মৃত্যু বেশি হয়েছে অন্য জটিল রোগে ভোগা বয়স্ক করোনা রোগীদের ক্ষেত্রেই। দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও অন্ধকারের ঠিক পেছনেও রয়েছে আলোর গল্প। অর্থাৎ যারা এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তারাই সেই আলোর গল্পকার। আক্রান্ত থেকে হাসপাতাল, তারপর সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরা পর্যন্ত অনেক বিচিত্র ঘটনা আর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেও প্রত্যেকে বলছেন নতুন জীবন পেয়েছেন তারা। এজন্য চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে প্রতিবেশীসহ যারা বিপদের দিনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন প্রত্যেককে জানিয়েছেন কৃতজ্ঞতা। অনেকে বলছেন, নিশ্চিত মৃত্যুকূপ থেকে ফিরেছেন। তাই সামনের দিনগুলোতে সমাজের সবাইকে ভালবেসে কাটাতে চান বাকি জীবন। চিকিৎসকরা বলছেন, একবার আক্রান্ত হওয়া মানেই নিজেকে নিরাপদ ভাবার কোন কারণ নেই। জাপানসহ বিভিন্ন দেশে একই ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর ফের করোনায় সংক্রমণ হতে দেখা গেছে। তাই যারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তাদের প্রত্যেককে সামাজিক দূরত্ব মেনে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। অন্যথায় ফের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। যদিও দেশে এখন পর্যন্ত এ রকম কোন ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। করোনা মানুষ চেনে না। ছোঁয়াচে এই রোগ একজন থেকে অন্য জনে ছড়ায়। তাই অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ডাক্তার, নার্স, রাজনীতিক, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সব শ্রেণী পেশার মানুষই আক্রান্ত হয়েছেন। তেমনি সুস্থ হওয়ার তালিকাতেও আছে সব পেশার মানুষের নাম। চিকিৎসকের করোনা জয়ের গল্প ॥ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক শহীদুল্লাহ সিকদার। গত ৯ এপ্রিল তার সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর পরীক্ষায় তার মেয়েরও করোনাভাইরাস পজিটিভ আসে। সুস্থ হওয়ার পর তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি। শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, উপসর্গ কম হলে এবং নিয়ম মেনে চলতে পারলে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঘরে থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব। সেজন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার, বিশ্রামের সঙ্গে কিছুটা শরীরচর্চা, প্রচুর পরিমাণে গরম পানি পান করতে হবে। তিনি জানান, মেয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও এই সময়ে স্ত্রী পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের চর্মরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শহীদুল্লাহ সিকদার আক্রান্ত হন এক রোগীর সংস্পর্শ থেকে। ওই রোগী নিজের উপসর্গের কথা গোপন রেখে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বলেন, আমি বেশ কিছু রোগী দেখছিলাম। একজন রোগীকে দেখে জ্বর, টক্সিস, টক্সিস মনে হচ্ছিল। আমি বললাম, আপনার কি করোনাভাইরাস আছে নাকি? উনি বললেন, না। আমার নেই। এই বলে চিকিৎসা নিয়ে চলে গেলেন। তারপর নিজে থেকে উনি পরীক্ষা করালেন। পরদিন সম্ভবত পরীক্ষা করেছেন। তার পরের দিন আইইডিসিআর থেকে আমাকে জানানো হল-‘স্যার আপনার রোগীর করোনাভাইরাস পজিটিভ। আপনি একটু সাবধানে চলেন।’ শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, আমারও কিন্তু কোন উপসর্গ ছিল না। তারপরও আমি পরীক্ষা করালাম এবং বিকেলে জানালো হলো- আমারও করোনাভাইরাস পজিটিভ। তখন আমি নিজের বাসায় একেবারে কন্টাক্টলেস হয়ে গেলাম। করোনা মোকাবেলার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অভিজ্ঞতার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে বর্ণনা করেন ডাঃ শহীদুল্লাহ। শহীদুল্লাহ সিকদার জানান, প্রথম দিকে তার তেমন কোন উপসর্গ ছিল না। এরপর একদিন সামান্য কাশি, সর্দি, সামান্য মাথাব্যথা। তিনি বলেন, তবে তাপমাত্রা তত বেশি ছিল না। সামান্য শরীর ব্যথা হয়েছিল। সেটা খুবই কম। আমার মেয়ের একটু জ্বর হয়েছিল, পাতলা পায়খানা হয়েছিল। তবে কীভাবে থাকবেন, কোথায় চিকিৎসা নেবেন, সে বিষয়ে প্রথমে নিজেও দ্বিধায় ছিলেন বলে জানালেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, আসলে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক তো সারা দুনিয়ায় আছে। আমি যখন আক্রান্ত হলাম, টেস্ট করে যখন আমি নিজেই পজিটিভ দেখলাম, তখন আমি আসলেই একটু চিন্তিত হয়ে গেলাম যে আমি হাসপাতালে যাব না বাসায় থাকব। পরে ভেবে তার মনে হয়, যেহেতু বড় কোন শারীরিক সমস্যা নেই, নিজের সঠিক পরিচর্যা করতে পারলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারলে তিনি হয়ত বাসায় থেকেও হাসপাতালের চেয়ে কম সেবা পাবেন না। সেই ভাবনা থেকেই তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন এবং মেয়ের জন্যও একই ব্যবস্থা করেন বলে জানান শহীদুল্লাহ সিকদার। কী খেয়েছেন, কী করেছেন ॥ শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, ‘আমি, আমার স্ত্রী ও মেয়ে আলাদা আলাদা ঘরে থেকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করেছি। প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার, বিশেষ করে স্যুপ, জুস আর গরম পানি পান করেছি সবসময়, আদা চা খেয়েছি। সব সময় চেষ্টা করেছি ভিটামিন সি ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খেতে। পেয়ারা, কমলা, লেবু, মাল্টা- এগুলো খেয়েছি প্রচুর পরিমাণে। তার সঙ্গে কালোজিরা এবং মধু সকাল বিকেল খেয়েছি। প্রয়োজনে কিছু ওষুধও খেতে হয়েছে। অসুস্থতার দিনগুলোতে অন্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ পানি পান করেছেন জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, সব সময় গরম পানি পান করছি। আর সেটা পরিবারের সবাই। বেশি বেশি পানি পান জরুরী, কারণ ভাইরাসের টক্সিস পানির সঙ্গে বা প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারে। জটিলতা থাকলে যেতে হবে হাসপাতালে ॥ যদি কারও আগে থেকেই ফুসফুস, হৃদযন্ত্র বা কিডনিতে জটিলতা থাকে অথবা চিকিৎসার কোন পর্যায়ে অন্য কোন অসুস্থতা দেখা দেয়, তাহলে তাকে হাসপাতালে যাওয়ার পারামর্শ দিয়েছেন শহীদুল্লাহ সিকদার। এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমি আবারও বলছি, যদি নিয়মিত খাবার, স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং অন্যান্য বিষয়ে লক্ষ্য রাখা যায় তাহলে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়। গরম পানির ভাপ নেয়ার (স্টিম ইনহেলেশন) একটা বিষয় আছে। সেটাও আমরা করেছি। তবে বাসায় থাকলে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কক্ষে থাকার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘এক ঘর থেকে রোগী যদি আরেক ঘরে না যায় তাহলে ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ কমে যায়। কারণ এটা ছড়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কন্টাক্টে। তিনজনই মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলাম ॥ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। বড় মেয়ে ও স্ত্রীরও পজিটিভ রিপোর্ট এলো। শুধু ছোট মেয়ের নেগেটিভ আসে। শ্যালকের মাধ্যমে তাকে বাসায় পাঠাই। কিন্তু তাদের প্রথমে বাসায় ঢুকতে দেননি প্রতিবেশীরা। তারা বলেন, আপনাদের মাধ্যমে আমাদেরও সংক্রমিত করবেন। চার মাস পর বাসায় আসবেন। পরে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির একজন এগিয়ে আসেন, যিনি বাড়ি নির্মাণে জমি দিয়েছেন। বললেনÑ ওরা নিজেদের বাসায় থাকবে। এ বিপদের সময় তারা কোথায় যাবে? তিনি নিজে এসে আমার ছোট মেয়েসহ ওই আত্মীয়কে বাসায় তুলে দেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন সাংবাদিক এমদাদুল হক খান। ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন তিনি। স্ত্রী ও এক মেয়েসহ তিনি উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বাসায় ফিরে পরিবারের সদস্যরা পৃথকভাবে আরও ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা শুরু করেছেন। দুঃসময়ের বর্ণনা দিয়ে এমদাদুল হক খান বলেন, প্রথম যখন করোনা পজিটিভ ধরা পড়ল, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার এমনিতেই ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে। ফলে ভয়টা ছিল বেশি। তারপর আবার স্ত্রী ও দুই মেয়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি না থাকলে তাদের কী হবে? তারাও এই ভাইরাসে সংক্রমিত হলো কিনা? এসব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেত। আমি, আমার স্ত্রী ও এক মেয়ে করোনাকে পরাজিত করে বাসায় ফিরেছি। হাসপাতালের দিনগুলো খুব শঙ্কার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছি। প্রতিদিনই খবরে মৃত্যুর সংবাদ দেখছিলাম। বাসায় এসে মনে হলো যেন সত্যিই মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলাম। এমদাদুল হক জানান, ২৮ মার্চ থেকে তিনি জ্বর ও কাশিতে ভুগছিলেন। পরিচিত এক চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেয়েছেন। কিন্তু জ্বর ছাড়ছিল না। ওই চিকিৎসকের পরামর্শে করোনা টেস্টের চেষ্টা করেন। কিন্তু আইইডিসিআরের হটলাইনে অসংখ্যবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেননি। এর মধ্যেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা ও এক্সরে করেন। মৌসুমি রোগ বলে কিছু ওষুধ দেয়া হয়। পরে আইইডিসিআরে কর্মরত পরিচিত আরেক চিকিৎসক ডাঃ সাদিয়ার পরামর্শে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে করোনার টেস্টের নমুনা দিয়ে আসেন। ১০ এপ্রিল ঢাকার সিভিল সার্জন অফিস থেকে একজন ফোন করে জানান, তার করোনা পজিটিভ এসেছে। এর কিছুক্ষণ পরেই শাজাহানপুর থানা থেকে ফোন করে বাসার ঠিকানা নেয়। পুলিশ এসে বাসা লকডাউন করে দিয়ে যায়। বাংলাদেশের খবর পত্রিকার ওই সাংবাদিক বলেন, ‘করোনা পজিটিভ হওয়ার খবরে প্রথমে আমি মুষড়ে পড়ি। চোখের সামনে যেন সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছিল, ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে আসছিল। কিন্তু আমার সাংবাদিক সহকর্মী, ডিরেক্টর গিল্ডের সহকর্মীরা ফোন করে সাহস জোগান।’ এমদাদ বলেন, ‘আমার সবসময় মনে হয়েছে যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে। এ জন্য আমি চিকিৎসকের পরামর্শ যথাযথভাবে পালন করেছি। ওষুধ খেয়ে ও ব্যায়াম করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। পাশাপাশি প্রতিদিন দিনে একাধিকবার গরম পানির বাষ্প নেয়া ও এ্যান্টিবডি তৈরির জন্য বেশি বেশি দুধ-ডিম-ফল খেতে থাকি। পরবর্তী সময় আর হতাশাকে গ্রাস করতে দেইনি। মনকে উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করেছি। পরিচিতরা সবাই আমাকে ফোন করে সাহস জুুগিয়েছেন।’ টানা ২৬ দিনের লড়াই ॥ বগুড়ার প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শাহ আলম (৫০) রোগ জয় করে নিজ বাড়ি রংপুরে ফিরেছেন। টানা ২৬ দিন করোনার সঙ্গে লড়াই করে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল করোনা আইসোলেশন কেন্দ্র ত্যাগ করেন তিনি। হাসপাতালের চিকিৎসকরা শাহ আলমকে ছাড়পত্র আর ফুল উপহার দিয়ে বিদায় জানান। এ সময় তিনিও যারা চিকিৎসা দিয়েছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ২৯ মার্চ ট্রাকে করে ঢাকা থেকে রংপুরে ফিরছিলেন শাহ আলম। পথে তার কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ট্রাকচালক তাকে বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকায় ফেলে দিয়ে চলে যায়। পরে পুলিশের সহায়তায় প্রথমে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসকরা তার করোনার উপসর্গ দেখে ৩০ মার্চ মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল আইসোলেশন কেন্দ্রে ভর্তি করে। তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসা চিকিৎসক, এ্যাম্বুলেন্স চালক, পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ ২৪ জনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। পরে তাদের নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ পাওয়া যায়। শাহ আলমের স্ত্রী সাজেদা বেগম সেবা করলেও তার নমুনাও নেগেটিভ আসে। করোনাজয়ী শাহ আলম বলেন, ‘বগুড়ায় চিকিৎসা ভাল হয়েছে। চিকিৎসকসহ অন্য সবাই খবর নিয়েছেন। বাড়িতে মানুষ যেন আমাকে অন্য চোখে না দেখে এটাই চাই।’ সামাজিক কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলাম ॥ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ইসতিয়াক আহমেদ হৃদয়। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি নিজেই জানালেন সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। তিনি জানান, আমার কোভিড-১৯ পজিটিভ আসার ৬-৭ দিনের মধ্যেই আল্লাহর রহমত আর আপনাদের দোয়ায় কোভিড-১৯ নেগেটিভ করতে পেরেছি। বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই অবস্থান করেছি। বিগত কয়েকদিনে বেশ কয়েক জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করেছি। টিএসসিতে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছি। নিজের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করেছি। তাছাড়া আপনারা জানেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তিন-চার শয়ের মতো অবলা কুকুর বিড়াল রয়েছে। এইসব অবলা প্রাণীদের গত মার্চ মাসের ২১ তারিখ থেকে খাওয়ানোর কাজটা আমি করে আসছিলাম কয়েকজন ভলান্টিয়ারসহ। এই কুকুর বিড়ালগুলোকে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখাশোনা করা। তারপর ত্রাণ বিতরণ করা...। ...কাজের জন্য অধিকাংশ সময় আমার ঘরের বাইরে থাকতে হয়েছে। যে সময়ে আসলে আমার ঘরে থাকা উচিত ছিল। আমার বাবা মা দেশের বাড়ি থেকে প্রতিদিন ফোন দিতেন বাসায় যাওয়ার জন্য। একটা পর্যায় সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায় যাব। কিন্তু মনে হলো আমি টেস্ট করে তারপর যাব। টেস্ট করা ছাড়া ঢাকা থেকে আমি আমার এলাকায় যাব না। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে টেস্ট না করে যাওয়া উচিত হবে না। সেই দায়বদ্ধতা থেকে টেস্ট করাতে গেলাম। অপ্রত্যাশিতভাবে আমার করোনাভাইরাস পজিটিভ চলে আসে। রাত ১২টার দিকে আইইডিসিআর থেকে ফোন দিয়ে আমাকে বলে আপনার করোনাভাইরাস পজিটিভ। পজিটিভ আসার পরে আমি সঙ্গে সঙ্গে যেটি করেছি সেটি হচ্ছে- আমার সঙ্গে বিগত কয়েকদিন যারা ছিল তাদের ফোন দিয়ে, ম্যাসেজ দিয়ে বিষয়টা জানিয়ে দেই। তাদের বলেছি সন্দেহ হলে আপনারা টেস্ট করাতে পারেন অথবা কোয়ারেন্টাইনটা মানার চেষ্টা করেন। আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমে আমি নিজেকে একটি ঘরে একা আবদ্ধ করে ফেলি। আমার আশপাশে কাউকে আসতে দেইনি। একেবারেই একা ছিলাম। এরপর আমি প্রতিদিন যখন গোসল করতাম। তখন পানি গরম করে নিতাম। সেই পানিতে স্যাভলন মিশিয়ে গোসল করেছি। স্বাভাবিকভাবেই স্যাভলন পানি দিয়ে গোসল করা ভাল। এই সময়টাতে অবশ্যই গরম পানিতে স্যাভলন মিশিয়ে গোসল করবেন। এটি জীবাণুনাশের জন্য অনেক ভাল কাজে দেবে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই ব্যায়াম করতাম। তার পরপরই গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করতাম। গরম পানি যতটুকু গলায় সহ্য করা যায়। সেই পরিমাণ গরম পানির সঙ্গে লবণ দিয়ে গড়গড়া করতাম। আর খাবারের ক্ষেত্রে সব রকম খাবার খাওয়া যাবে। যেটা আইইডিসিআর থেকে আমাকে বলেছে। খাবার নিয়ে কোন সমস্যা নেই। যে কোন খাবার খেতে পারেন। তবে ভিটামিন সি টা বেশি রাখা ভাল। এছাড়া কমলা লেবু, লেবুর শরবত, আপেল, মালটা, নাশপাতি। যেগুলো আমি খেয়েছি। মনে হয় অভিভাবকহীন ছিলাম ॥ যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার শাহাদাত হোসেন সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখানে চিকিৎসার বিভীষিকাময় বর্ণনা তুলে ধরেছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে সঙ্গে। তিনি জানান, করোনাভাইরাস ‘পজিটিভ’ এটি জানার পর শুরুতে তিনি খুব আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সহকর্মীদের সহায়তায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি বলেন, হাসপাতালে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে নয়দিন পার করেছি। ওখানে মনে হয়েছে রোগীরা একেবারে অভিভাবকহীন। আমি খুবই অসহায় বোধ করেছি। দেখতাম চোখের সামনে রোগী মারা যাচ্ছে। লাশ ওয়ার্ডেই পড়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যেহেতু নির্দিষ্ট ব্যক্তি লাশ দাফন করেন হয়তো তাদের সংখ্যা কম কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, সে কারণে হয়তোবা। কিন্তু এতে একজন অসুস্থ রোগী যে এমনিতেই ভয়ে আছে তার মনের অবস্থা কী হয়? হাসপাতালে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলছিলেন, ২৪ ঘণ্টায় একজন চিকিৎসক আসতেন। অনেক দূর থেকে কথা বলে চলে যেতেন। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে একটি মানুষকেও পাওয়া যায় না। এ রকমও হয়েছে যে নার্স আসেনি বলে একবার সকালের এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া হয়নি। চিকিৎসক দিনে একবারও আসেনি সেটিও হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু একজন চিকিৎসকের কথায় আমার ভরসা পাওয়ার কথা। তার কথায় আমার মনোবল বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে মানসিক সাপোর্ট দেয়ার কেউ ছিল না।’ অন্যান্য সুবিধাদির বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, যে ওয়ার্ডে তিনি ছিলেন সেখানে একশ’র মতো রোগী ছিল। এত রোগীর জন্য মাত্র তিনটি টয়লেট, তিনটি গোসলখানা। এক পর্যায়ে রোগী বাড়তে শুরু করার পর চিকিৎসকদের অনুরোধ করে তার শ্বশুরসহ বাড়ি চলে আসেন। ভুতুড়ে পরিবেশে দিন কাটাতে হয়েছে ॥ দেশে সবচেয়ে প্রথম যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সাংবাদিক শনাক্ত হয়েছিলেন সেটি ছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের। সেখানে ভিডিওগ্রাফার হিসেবে কর্মরত আশিকুর রহমান রাজু আক্রান্তদের একজন। তিনি বলছেন, শনাক্ত হওয়ার পর যখন কুয়েত বাংলাদেশ-মৈত্রী হাসপাতালে যান শুরুতেই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, কারণ সবাই পিপিই পরে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তার প্রথম অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, তাকে একজন ওয়ার্ডবয় একটা পলিথিন ব্যাগে বিছানার চাদর, বালিশ, বালিশের কাভার, টয়লেট টিস্যু আর একটা সাবান দেয়। এগুলো দিয়ে ওয়ার্ডবয় কলাপসিবলগেট তালা মেরে চলে গেল। নিজের বিছানাও নিজে গুছিয়ে নিতে হলো। তিনি বলছিলেন, প্রথম দিন তার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে কেউ আসেনি। চিকিৎসকদের ফোন করে তিনি সেটি জানানোর পর সাড়ে চারটার দিকে তার জন্য একটি বক্সে করে খাবার এসেছিল। কোন প্লেট দেয়া হতো না। আশিকুর রহমান বলেন, খাবার রেখে যাওয়া হতো কেঁচি গেটের বাইরে। তারপর হ্যান্ডমাইকে সেটা জানানো হতো। অসুস্থ লোকদের গিয়ে সেই খাবার নিয়ে আসতে হতো। সুস্থ হওয়ার গল্প শুনলেন প্রধানমন্ত্রী ॥ ফয়সাল শেখ। পড়াশোনা করেন জার্মানিতে। ছুটিতে দেশে ফিরে শনাক্ত হন তিনি করোনায় আক্রান্ত। ঢাকায় শনাক্ত হওয়া প্রথম করোনাভাইরাস রোগী তিনি। গত ১ মার্চ ঢাকায় ফেরার ১০ দিন পর তার করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দেয়। পরে নিজ উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) যান ফয়সাল। সেখানে প্রাথমিক টেস্টে তার শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। তিনি এখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সম্প্রতি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নিজের সুস্থ হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান ফয়সাল। তিনি বলেন, আমি জার্মানিতে পড়াশোনা করি। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে গত ১ মার্চ আমি দেশে আসি। কিন্তু ১০ দিন পর আমার শরীর খুব খারাপ হওয়ার বিষয়টি অনুভব করি এবং আমার মাঝে করোনার লক্ষণ দেখা দেয়। পরে নিজ থেকে আমি আইইডিসিআরে যাই। প্রধানমন্ত্রীকে ফয়সাল বলেন, সত্যি কথা বলতে প্রথম একটু ভয় পেয়েছিলাম যে, এখানে আমি জার্মানির মতো চিকিৎসা পাব কিনা? তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত আইইডিসিআরের নির্দেশনা মোতাবেক আমি কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইনে থাকি। আমার পরিবারের সদস্য এবং আমি যাদের সঙ্গে দেখা করেছি, মিশেছি তাদেরও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। পরবর্তীকালে কয়েক দফা টেস্ট করার পর করোনাভাইরাস নেগেটিভ আসলে আমি পরিবারের কাছে ফিরে যাই। আমার পরিবারের অন্য কারও সমস্যা হয়নি। ফয়সাল বলেন, করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই ডাক্তার ফার্সি আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। সব সময় খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আমি সত্যি খুশি। আইইডিসিআরের চিকিৎসাসেবায় আমি খুশি। ফিরে আসার গল্প ॥ ‘আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে লোক এসে বাসা থেকে আমার স্যাম্পল নিয়ে যান। বাসায় থাকা অবস্থায়ই আমার গলা ব্যথা, জ্বর, কাশিটা কমে যায়। তাই মনে মনে ভেবেছিলাম করোনা নেগেটিভ আসবে। তবে আইইডিসিআর থেকে ফোন করে আমার নানা তথ্য নেয়া শুরু করলে ভয়টা বাড়ে। পরে জানলাম আমি পজিটিভ।’ কথাগুলো বললেন ডেকো গ্রুপের মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কর্মরত ফয়েজ নাফিয়া রহমান। সম্প্রতি কোভিড-১৯ এ তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। নাফিয়া বলেন, সেই মুহূর্তটিতে মনের যে অবস্থা হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পরিবারের অন্য সদস্যরা কান্নাকাটি শুরু করে। তবে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে সব জিনিস গুছিয়ে একাই এ্যাম্বুলেন্স করে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াই। নাফিয়া রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, করোনাভাইরাস বিস্তারের এই সময়ে মানুষ যখন দিশাহারা তখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে সেবা নিয়ে আমার প্রত্যাশা খুব বেশি ছিল না। তাই আমি যখন হাসপাতাল ছাড়লাম মনে হয়েছে, ভালই সেবা পেয়েছি। চিকিৎসকরা কাছে এসে খোঁজ নিয়েছেন। ভালমন্দ পরামর্শ দিয়েছেন। নার্সরা নির্ধারিত জায়গায় ওষুধ রেখে গেছেন। হাসপাতালে চিকিৎসায় কোন খরচ করতে হয়নি। তিনি বলেন, বাসা থেকে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়েছে। শুধু প্রাথমিকভাবে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে নিজের ব্যবস্থাপনা ও খরচে।
×