ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চিকিৎসাকর্মীরাও পড়বেন জটিলতায়

ডেঙ্গু, করোনার মধ্যে বেহাল অবস্থা হতে পারে ফ্লু আক্রান্তদের

প্রকাশিত: ১০:০৬, ২৫ এপ্রিল ২০২০

  ডেঙ্গু, করোনার মধ্যে বেহাল অবস্থা হতে পারে ফ্লু আক্রান্তদের

নিখিল মানখিন ॥ ডেঙ্গু ও মৌসুমি ফ্লু চলমান করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে চরমভাবে ব্যাহত করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নামে ভিন্ন হলেও এই তিনটি রোগের উপসর্গ প্রায় একই। জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট। এসব উপসর্গের রোগী চিকিৎসা করাতে গিয়ে চিকিৎসকেরাও বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন। এমন উপসর্গের প্রত্যেক রোগীকে করোনা ও ডেঙ্গুর টেস্ট করানো কঠিন হয়ে পড়বে। পরীক্ষার আগে রোগী ডেঙ্গু, নাকি করোনায় আক্রান্ত তা নির্ধারণের বিষয়টিও জটিল হয়ে যাবে। আর ডেঙ্গু ও করোনার মধ্যে বেহাল অবস্থায় পড়তে পারেন মৌসুমি ফ্লু’তে আক্রান্তরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু ও মৌসুমি ফ্লু’র মৌসুম ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেই বেড়ে যাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে। প্রতিদিন করোনায় নতুন করে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। করোনার কারণে পুরো দেশ যেন লকডাউন। আর প্রতি বছরের মতো এবারও মৌসুমি ফ্ল’তে আক্রান্ত হচ্ছেন দেশের মানুষ। করোনাভাইরাসের মতো উপসর্গ হলেও মৌসুমি ফ্লু এদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত রোগ। ডেঙ্গু পরিস্থিতি ॥ গত বছর হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে দেশের স্বাস্থ্য সেক্টর। চলতি বছর আবার শুরু হয়েছে ডেঙ্গুর মৌসুম। জমে থাকা বৃষ্টির পানি এডিস মশার প্রজননে সহায়ক ভূমিকা রাখে। গত দু’দিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাসের শেষ দিকে এবং পুরো মে মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অধিদফর। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধনে প্রয়োজনীয় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ঢাকার দুই মেয়রকে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছেন। আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দুই সিটি কর্পোরেশনের অনেক স্থানে এডিস মশার লার্ভা শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রতি বছর মে মাস থেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। ২০১৯ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩১ জন। আর ২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ২৯১ জন। গত বছর ডেঙ্গুতে সরকারী পরিসংখ্যানেই লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১৪০ জনের করোনা রোগী। আর বেসরকারী পরিসংখ্যানে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল তিন লাখের বেশি এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেন ৩ শতাধিক। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু রোগী ৩৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮ জন, মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলে ৫৮ জন, মে মাসে ১৯৩, জুনে ১৮৮৪ জন, জুলাইয়ে ১৬২৫৩ জন, আগস্টে ৫২ হাজার ৬৩৬ জন, সেপ্টেম্বরে ১৬ হাজার ৮৫৬ জন, অক্টোবরে ৮১৪৩ জন, নবেম্বরে ৪০১১ জন এবং ডিসেম্বরে ১৭ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ৯৬৯ জন। আর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে এপ্রিলে দুজন, জুনে ছয়জন, জুলাইয়ে ৩৫ জন, আগস্টে ৮২ জন, সেপ্টেম্বরে ১৩ এবং অক্টোবরে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এভাবে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে (২৩ তারিখ পর্যন্ত) ২০ জন আক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত চলতি বছরে মোট ২৯১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমান দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন দুজন। ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের পূর্বাভাস ॥ ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মশার উৎস ধ্বংস না করা গেলে শুধু লার্ভিসাইডিং করে মশা কমানো যাবে না। নাগরিকদের এসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে। রাজধানীর অনেক এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১২ শতাংশ এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ১০ শতাংশ ওয়ার্ডে এডিসের লার্ভার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি রয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিএনসিসির ১২, ১৬, ২৮, ৩১ ও ১ এবং ডিএসসিসির ৫, ৬, ১১, ১৭, ৩৭ ও ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে এডিসের ব্রুটো সূচক মিলেছে ২০ পয়েন্টের বেশি। উত্তরের শুধু ১২ নম্বর ওয়ার্ডে এই সূচক ৩০। উত্তরে ৪১ ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫৯টি ওয়ার্ডে এ জরিপ চালানো হয়েছে। ডিএনসিসির উত্তরা এবং ধানম-ির দুটি ওয়ার্ডে দুটি করে এলাকায় জরিপ হয়েছে। জরিপ করা হয়েছে এসব এলাকার এক হাজারটি বাড়ি। মৌসুমি ফ্লু ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত চার বছরের মধ্যে এবারই ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। প্রতি বছর নবেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই হিসাব করা হয়। সে অনুসারে নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ২০১৬-১৭ সালে আক্রান্ত ছিল ১৬ হাজার ৪৯০ জন ও মৃত্যু নয়জনের, ২০১৭-১৮ সালে আক্রান্ত ছিল ১৮ হাজার ৬৮৭ ও মৃত্যু ছিল ১৯ জনের, ২০১৮-১৯ সালে আক্রান্ত ছিল ২০ হাজার ৪৪৬ ও মৃত্যু ছিল সাতজন এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালের নবেম্বর থেকে গত ২০২০ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয় এক লাখ ১১ হাজার ৭৩৭ জন এবং মারা যায় ২২ জন। দেশের করোনা পরিস্থিতি ॥ দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মহামারীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিদিন করোনায় নতুন করে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মোট মৃতের সংখ্যা ১৩১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৫০৩ জন। এখন পর্যন্ত করোনায় মোট শনাক্ত হলেন চার হাজার ৬৮৯ জন। আইইডিসিআর’র তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ঢাকা মহানগরীতে আক্রান্ত ২০৬০ জন, ৫০.৫৯ শতাংশ। আর মহানগরীর বাইরে ঢাকা বিভাগে ১৪৪২ জন (৩৫.৪১ শতাংশ), চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫৬ জন (৩.৮৩ শতাংশ), সিলেট বিভাগে ৪৯ জন (১.২০ শতাংশ), রংপুর বিভাগে ৭০ জন (১.৭২ শতাংশ), খুলনা বিভাগে ৩৮ জন (দশমিক ৯৩ শতাংশ), ময়মনসিংহ বিভাগে ১৩৯ জন (৩.৪১ শতাংশ), বরিশাল বিভাগে ৮৬ জন (২.১১ শতাংশ) এবং রাজশাহী বিভাগে ৩২ জন (দশমিক ৭৯ শতাংশ) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মৌসুমি ফ্লু, ডেঙ্গু ও করোনার বিভ্রান্তিতে পড়বেন চিকিৎসক ও রোগীরা ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু ও মৌসুমি ফ্লু’তে প্রতি বছরই শত শত মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি ছিল। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও ছিল বেশি। এবার আমাদের দেশে বিশেষভাবে তিনটি ঝুঁকির দিকে একই তালে নজর রাখতে হবে। এখন দেশে মৌসুমি ফ্লু’র (সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা) মূল সময় শুরু হয়ে গেছে। আবার ডেঙ্গু গত বছরের চেয়ে নাকি এবার তুলনামূলক বেশি রয়েছে এরই মধ্যে। বৃষ্টি হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ডেঙ্গু ও সিজনাল ফ্লু জটিলতার মাত্রা বাড়িয়ে তুলবে। তিনি বলছেন, যেহেতু মৌসুমি ফ্লু ও ডেঙ্গুতে শ্বাসকষ্ট থাকে আবার করোনায়ও শ্বাসকষ্ট থাকে তাই অনেকেই শ্বাসকষ্ট হলেও বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। এ ক্ষেত্রে এবার নজর বেশি রাখতে হবে। সবাইকেই সতর্ক থাকতে হবে। রোগতত্ত্ববিদ ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, সাধারণ মানুষ যেমন করোনা, ডেঙ্গু ও ইনফ্লুয়েঞ্জার উপসর্গ আলাদা করতে এবার হিমশিম খেতে পারেন, আবার চিকিৎসা কর্মীরাও এক ধরনের জটিলতায় পড়ে যাবেন বা এরই মধ্যে পড়ে গেছেন। তিনি বলেন, অনেক চিকিৎসা কর্মীই হয়ত জ্বর দেখলেই করোনার ভয়ে রোগীকে সেবা দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে এখন করণীয় হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে এই তিনটি বিষয়ে ভাল করে পার্থক্য বোঝা যায় এমন কিছু প্রচার করা। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রয়োজনে আরও বেশি করে বুঝিয়ে দেয়া উচিত যাতে তারা দ্রুত কে কোন উপসর্গে আক্রান্ত সেটা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরতে পারেন এবং সে অনুসারে যার জন্য যে ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন সেটা দিতে পারেন। নয়ত জ্বর শুনলেই এখন যে আতঙ্ক আছে সেটা কাটবে না। এ ক্ষেত্রে রোগীর হয়রানি ও বিপদের ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সানিয়া তহমিনা জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা মোকাবেলার ব্যস্ততার মধ্যেও আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বৃষ্টি হলে আমাদের উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। এমনিতেই করোনা নিয়ে অস্থির অবস্থা চলছে, এর মধ্যে যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বা মশার উৎস ধ্বংসে সঠিকভাবে কাজ করা না যায় তবে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি কাটবে না। এছাড়া সিজনাল ফ্লু তো আছেই। করোনা ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া আর ফ্লু যদি একাকার হয়ে এবার দেশে জেঁকে বসে, তবে পরিস্থিতি খুবই জটিল হয়ে উঠবে। তাই আমাদের সবাইকে এবার সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
×