ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাসার গবেষণা

বিশ্বের দূষণ কমিয়ে দিয়েছে লকডাউন

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ২৫ এপ্রিল ২০২০

  বিশ্বের দূষণ  কমিয়ে দিয়েছে  লকডাউন

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নোভেল করেনাভাইরাসের কারণে লকডাউন (ঘরবন্দী) কয়েকশ’ কোটি মানুষ। স্থবির হয়ে রয়েছে কলকারখানাও। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর তিন মাসের লকডাউনে চীনের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ যে যার ঘরে থেকেছে। তাতে বিশ্বের প্রায় সাত শতাংশ মানুষ ওই সময় ঘরের বাইরে যাইনি। এতেই দূষণের মানচিত্রে এসেছে লক্ষণীয় উন্নতি। খবর রয়টার্স ও ইয়াহু নিউজের। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে মহামারীর প্রকোপ বাড়তে থাকায় ইউরোপ এবং আমেরিকাও একই পথ অনুসরণ করেছে। এই সময় যে শুধু মানুষকেই ঘরবন্দী করেছে তা নয়, সীমিত করেছে শিল্প-কারখানা ও যানবাহন চলাচল। তাতে গত প্রায় চার মাসে দূষণ কমে এসেছে জাদুমন্ত্রের মতো। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে বায়ুমণ্ডলে ভাসমান বস্তুকণার উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করে নাসার গ্লোবাল মডেলিং এ্যান্ড ডেটা এ্যাসিমিলেশন টিম বোঝার চেষ্টা করেছে পৃথিবী পৃষ্ঠের কত কাছে ছড়িয়ে রয়েছে এই দূষণ। করোনাভাইরাসের মহামারী চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি আর ভারতে বায়ুদূষণের চিত্র কতটা পাল্টে দিয়েছে, নাসার ওই গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে তা উঠে এসেছে। বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ মাইক্রোমিটার ও ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণীতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা। পিএম২.৫ এর অন্যতম উপাদান হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র নাইট্রেট; যার আকার মানুষের চুলের ব্যাসের ৩ শতাংশের মতো। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এই নাইট্রেট মানুষের ফুসফুস হয়ে রক্তে মিশতে পারে। তাতে হৃদযন্ত্রের রোগ, স্ট্রোক, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে। নাইট্রেট তৈরি হয় নাইট্রোজেন যৌগ থেকে। জ্বালানি তেল, ডিজেল পোড়ানোর মধ্য দিয়ে এসব নাইট্রোজেন যৌগ বাতাসে মেশে। নাসার ম্যাপে দেখা যায়, লকডাউন শুরুর কিছুদিনের মধ্যে চীনের হুবেই রাজ্যের বাতাসে এই পিএম২.৫ নাইট্রেটের উপস্থিতি কমে আসতে থাকে। নাসার বিজ্ঞানী রাইয়ান স্টফার বলেন, ‘দূষণ বাড়ার হারে এই যে সাময়িক বিরতি পড়েছে, মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর তার কতটা প্রভাব পড়বে তা হয়ত আমরা শীঘ্রই বুঝতে পারব। তবে স্যাটেলাইট থেকে নেয়া নাইট্রোজেন যৌগের এইসব উপাত্ত যে বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার সূচক তা স্পষ্ট হয়েছে এই গবেষণায়।’ যে উহান থেকে নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু, সেখানে জানুয়ারি থেকে কমে আসতে শুরু করে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য দূষণ। গাড়ির ধোয়া, বিদ্যুত কেন্দ্র এবং পয়োঃবর্জ্য পরিশোধনে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়। বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, গত কয়েক বছর ধরে বাতাসে ধীরে ধীরে কমে আসছিল নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতি। তবে এ বছর বাতাসের মানে যে দ্রুত উন্নতি দেখা যাচ্ছে, তাতে লকডাউনের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছে তারা। ২০১৪ থেকে ২০২০, এই সাত বছরে হুবেইয়ের বাতাসে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড ও পিএম২.৫ বস্তুকণার দূষণের মাত্রা লেখচিত্রে দেখানো হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নাইট্রোজেন দূষণের মাত্রা গড়ে ওঠানামা করেছে প্রতি ঘনমিটারে ২০ থেকে ৪০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে। এই সময়ের মধ্যে পিএম২.৫ বস্তুকণার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১০০ থেকে ২০০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে। ২০২০ সালের গোড়ায় দূষণের এই হার কমে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড পাওয়া যায় প্রতি ঘনমিটারে ২০ মাইক্রোগ্রামের কম। আর পিএম২.৫ বস্তুকণার উপস্থিতি পাওয়া যায় প্রতি ঘনমিটারে ১০০ থেকে ১৫০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের জর্জ ডি থার্সটন বলেন, পিএম২.৫ দূষণ কমে আসা মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর। দূষণের কারণে হৃদযন্ত্রের রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াতে এই বস্তুকণার বড় ভূমিকা আছে। নাসার গবেষণা বলছে, গত কয়েক মাসে চীনের মতো বিশ্বের আরও অনেক দেশেই পিএম২.৫ বস্তুকণার মাত্রা কমেছে অনেকটা। মার্চের গোড়ায় ব্যাপক হারে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়ায়। ওই সময় থেকেই দেশটিতে বায়ুদূষণও কমে আসার প্রমাণ মিলছে নাসার স্যাটেলাইট ইমেজে। দূষণের কারণে গত সাত বছরে দক্ষিণ কোরিয়ার বায়ুমান যা ছিল তার থেকে অনেকটা উন্নতি দেখা এ বছর। দক্ষিণ কোরিয়ার বিধিনিষেধ চীনের মত ততটা কঠোর না হলেও সচেতনতা ও সতর্কতার কারণে মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসের পরিবর্তনই বায়ুর মান উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে বলে গবেষকদের ধারণা। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাতাসে সালফার ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৬ থেকে ১০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে থাকলেও এ বছর এই দূষণ কমে প্রতি ঘনমিটারে ৬ মাইক্রোগ্রামের নিচে নেমে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে মহামারী ঘোষণার দুই দিন আগে, অর্থাৎ ৯ মার্চ পুরো ইতালি অবরুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তার আগেই দেশটির উত্তরের কিছু অঞ্চলে বিধিনিষেধ জারি হয়। ইতালির উত্তরাঞ্চলে শিল্পায়ন বেশি হওয়ায় সেখানে উচ্চমাত্রায় বায়ুদূষণ ছিল নিয়মিত ঘটনা। তবে এ বছর বাতাসের দূষণ কমে যায় প্রথম তিন মাসেই। ওই অঞ্চলে বাতাসে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড প্রায় গায়েব হয়ে গেছে বলে জানাচ্ছে গবেষণার তথ্য। ভাইরাসের সংক্রমণে ইতালির উত্তরের লোম্বার্ডি বিপর্যস্ত হলেও এই সময় থেকেই শহরটির বায়ুমান ওঠে এসেছে স্বস্তিকর পর্যায়ে। ধান ক্ষেতের নাড়া পোড়ানোর কারণে প্রতি বছর একটা সময় ভারতের দিল্লী ও উত্তরের শহরগুলো ধোঁয়ার চাদরে মুড়ে থাকে, বসন্ত কিছুটা পরিষ্কার বাতাস মেলে। এ বছর প্রথম চার মাস যেতে না যেতেই ভারতের বাতাস সতেজ হতে শুরু করে। গবেষকরা মনে করছেন, ভারতজুড়ে লকডাউনের ঘোষণা ১৩০ কোটি মানুষের এই দেশে বায়ুদূষণ কমাতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তবে বাতাসের গুণগত মানে উন্নতির পেছনে আরও কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন বোস্টনের হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের বায়ুমান বিজ্ঞানী পল্লবী পান্ট। তিনি বলেন, ‘বায়ুতে দূষণ কী মাত্রায় ছড়াবে তা অনেকখানি নির্ভর করে তাপমাত্রা ও বাতাসের গতিবেগের ওপর। আগের অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, কোন অঞ্চল অবরুদ্ধ হলে সেখানে বায়ুদূষণের মান কমে আসে। তবে এসব গবেষণায় সব প্রভাবকই বিবেচনা করা জরুরী।’ বাইরের বাতাসের মানে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি ঘরের ভেতরে বাতাসের মান কেমন তা জানতেও আগ্রহী গবেষকরা। বাইরে অবাধ চলাফেলার লাগাম টানার কারণে অধিকাংশ মানুষকে এখন দিনের পর দিন ঘরে থাকতে হচ্ছে সব সময়।
×