ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে মসিয়ুর রহমানের নাম

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ২৫ এপ্রিল ২০২০

  বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে মসিয়ুর রহমানের নাম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একমাত্র শহীদ সংসদ সদস্য মসিয়ুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মসিয়ুর রহমানের আজ ৪৯তম শাহাদাতবার্ষিকী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী তাঁকে যশোরের বাসভবন থেকে সেনানিবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ২৩ এপ্রিল নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাংলার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে দেশ ও জাতির জন্য নিজের অমূল্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মসিয়ুর রহমানের জন্ম ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যশোরের চৌগাছার সিংহঝুলি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মোঃ ইসমাইল এবং মাতার নাম ছৈয়দুন্নেছা। তিনি চৌগাছা (এম.ই) মিডিল ইংলিশ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরে ভর্তি হন যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৩৬ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর চলে যান কলকাতা। সেখানে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে এইচএসসি এবং ১৯৪০ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে কলকাতা লর্ড রিপন কলেজ (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ) থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রী অর্জন করেন। আইন পড়াকালে তিনি একটি মার্চেন্ট অফিসের ইংরেজ একজন কর্মকর্তার সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করায় ইংরেজীতে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা ও নিপুণতা অর্জনে সক্ষম হন। কলকাতাতে ছাত্র অবস্থাতেই মসিয়ুর রহমান রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৫ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। এ সময়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শেও আসেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন মসিয়ুর রহমান। দেশ বিভাগের পর তিনি ফিরে আসেন নিজ জেলায় এবং আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৬-এ বঙ্গীয় আইন সভার নির্বাচনে যশোর জেলা মুসলিম লীগের নির্বাচনী অভিযান পরিচালনায় তিনিই নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তিনি অগ্রসরমান সম্ভাবনাময় তরুণ নেতা হিসেবে মুসলিম লীগ সরকারের দমনপীড়ন অগ্রাহ্য করে জনগণকে সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবিতে আন্দোলন চলাকালে খুলনার এক জনসভায় বক্তৃতা করতে যান বঙ্গবন্ধু। বিশাল এই জনসভায় বক্তৃতা করে ঢাকা ফেরার পথে যশোরে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল গ্রেফতার করেই যেন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু যশোরে মসিয়ুর রহমানসহ অন্যান্য আইনজীবীরা আদালতে মামলা লড়ে তাঁকে জামিনে মুক্ত করেন এবং মুক্তির পর তিনি মসিয়ুর রহমান সাহেবের বাসায়ই ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে মসিয়ুর রহমান পালন করেন এক অভূতপূর্ব ভূমিকা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর প্রধান কুশলী ছিলেন সালাম খান। সঙ্গে ছিলেন এ্যাড. জহির উদ্দিন, এ্যাড. মজিবর রহমান, এ্যাড. জুলমত আলী খানসহ আরও কয়েকজন। সে সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনার জন্য বেগম মুজিব যশোর থেকে বিশেষ অনুরোধ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন মসিয়ুর রহমানকে। মামলা পরিচালনায় তার প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা ছিল অসাধারণ। মামলার প্রয়োজনেই তিনি প্রায় এক বছর যশোর ও নিজের পেশাগত কাজকর্ম, ঘর-সংসার ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন। ইতোমধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে আইয়ুব খানের মসনদ নড়বড়ে হয়ে পড়ে। প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসেই পাকিস্তানের মসনদ থেকে বিদায় নেন এই ফিল্ড মার্শাল। পর্দার অন্তরালে থেকে রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেয় ইয়াহিয়া খান। বস্তুত যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়েছিল ৩২ জন বাঙালী মুক্তি সেনানিকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে তার পরিসমাপ্তি হয় পাকিস্তানের মৃত্যুদন্ড ঘোষণার মধ্য দিয়ে। মসিয়ুর রহমানের এই রাজনৈতিক পথচলা অবশ্য একেবারে সরলরৈখিক ছিল না। ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল পিডিএম গঠিত হলে মসিয়ুর রহমান আওয়ামী লীগ ছেড়ে তাতে যোগ দেন। পিডিএম-কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ দুইভাগে বিভক্ত হলেও তিনি পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৯৬৯-এ পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে মূল আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকসৈন্যরা যশোরে চারুবালা করকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে জনতার ক্ষোভ আরো তুঙ্গে উঠে। তারা চারুবালা করের মৃতদেহ নিয়ে শহরে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিছিলে নামে। মসিয়ুর রহমান নিজে সেই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মিছিলটি সার্কিট হাউজের সামনে পৌঁছালে বিক্ষুব্ধ জনতা সেনাবাহিনীর দিকে ইট-পাটকেল মারতে শুরু করে। একপর্যায়ে জনতা মারমুখী হয়ে সেনাবাহিনীকে ধাওয়া করে সার্কিট হাউসের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় এবং সেখানে সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্নেল তোফায়েল এ সময় গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে মসিয়ুর রহমান গিয়ে সার্কিট হাউজের সামনে দাঁড়ান। তিনি সেনাবাহিনীকে গুলি চালনা থেকে নিবৃত্ত থাকার আহ্বান জানান এবং জনগণকে স্থানীয় ঈদগাহের দিকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকহানাদার বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চ লাইট। ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়ে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর চালানো হয় নির্বিচারে গণহত্যা। রাজধানী ঢাকা থেকে মানবতাবিরোধী এই তান্ডবলীলা শুরু হলেও ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো ছিল সারাদেশেই। ২৫ মার্চ বিকালেই বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে যশোরে অবস্থানরত মসিয়ুর রহমানকে ফোন করেন এবং পরিস্থিতি ভাল নয় বলে জানান। সন্ধ্যার দিকে মসিয়ুর রহমান একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কী ভেবে আবার বাসায়ই অবস্থান করেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাড়িতে রয়ে গেলেন শুধুমাত্র তিনি নিজে, স্ত্রী এবং বড় ছেলে। ২৫ মার্চ রাত ১টার দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গাড়ি নিয়ে এসে যশোরের সার্কিট হাউজ রোডের মসিয়ুর রহমানের পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় যশোর ক্যান্টমেন্টে। গ্রেফতারের পরই মসিয়ুর রহমানের ওপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। তাকে বলা হয় পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দেয়ার জন্য। তিনি রাজি হননি। প্রায় একমাস অমানুষিক নির্যাতন করা হয় তাকে ক্যান্টনমেন্টে। সে সময় ক্যান্টনমেন্টে আরও যারা বন্দী ছিলেন তাদের কথা থেকে জানা যায়, বিবৃতি দিতে অস্বীকার করায় পাকসৈন্যরা তাঁর শরীরের চামড়া ধারালো চাকু দিয়ে ছিলে ফেলেছিল। নির্যাতনের এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার মুখেও বিন্দুমাত্র আপোস করেননি দেশপ্রেমিক মসিয়ুর রহমান। এ সময় মসিয়ুর রহমানের যশোরের বাড়িটি মর্টারের গোলায় ধ্বংস করে দেয়া হয়। তার গ্রামের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। প্রতিহিংসামূলকভাবে মসিয়ুর রহমানের চাচাতো ভাই মতিয়ার রহমানকে জীবন্ত দগ্ধ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সঠিক দিনক্ষণের হিসাব না জানলেও আনুমানিক ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী স্বাধীনতার অকুতোভয় সৈনিক মসিয়ুর রহমানকে হত্যা করে। তার মৃতদেহটা পর্যন্ত সেদিন খুঁজে পায়নি পরিবার। অথচ জাতীয় পর্যায়ে এই নেতার সঠিক মূল্যায়ন এখনও হয়নি। আমরা স্বাধীনতার বলছি, মুক্তি সংগ্রামের কথা বলছি, গণতন্ত্রের কথা বলছি, তুলে ধরছি যশোরের মানুষের সংগ্রামী গৌরবগাথা, কিন্তু শহীদ মসিয়ুর রহমানের কথা বলছি না, লিখছি না। আমাদের এ কিসের দৈন্য? একজন আপোসহীন সংগ্রামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মসিয়ুর রহমানের উত্থান, বিকাশ এবং মর্মান্তিক মৃত্যু আমরা যেমন লক্ষ্য করি তেমননি রাজনৈতিক জীবনের বাইরে একজন অসাধারণ খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে জনহিতৈষী, অসাম্প্রদায়ী, ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসাবে তার বহু বিচিত্র গুণাবলী আমাদের চোখে পড়ে। তিনি শুধু আদর্শ রাজনীতিবিদ ও দেশপ্রেমিক নন, তিনি ছিলেন দানশীল ও মানুষের ভালবাসার পাত্র। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যশোরে এসে যশোর পৌর উদ্যানে শহীদ মসিয়ুর রহমানের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন করেন। এছাড়াও তার নামে ঝিকরগাছায় একটি কলেজ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র হল, চৌগাছা ডিগ্রী কলেজের একাডেমিক ভবন, ও তাঁর জন্মভূমি সিংহঝুলিতে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বেশকিছু ক্লাবের নামকরণ করা হয়েছে। লেখক : সাংবাদিক
×