ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাধন সরকার

নুুহার দিন-রাত্রি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৫ এপ্রিল ২০২০

নুুহার দিন-রাত্রি

নুহার মন খারাপ! নুহা বাবার পথ চেয়ে বসে আছে। বিদেশ থেকে তার বাবার আসার কথা। বিদেশে থাকা বাবাকে উদ্দেশ্য করে একটা কবিতাও লিখেছে নুহা। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল! নুহার বাবার বিদেশ থেকে দেশে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেল। চেনা পৃথিবীর ব্যস্ত মানুষগুলো হঠাৎই যেন থমকে গেল! নুহার দাদিকে ডাক্তার একলা এক ঘরে থাকতে বলেছে। দাদিও সব ধরনের সতর্কতা মেনে চলছে। দাদি অসুস্থ থাকায় বাসায় নুহার খেলার বন্ধু নেই বললেই চলে! আচমকা সবকিছু থমকে যাওয়ার কারণে নুহার চারপাশের কাজকর্মেরও পরিবর্তন এসেছে! স্কুল বন্ধ, বাইরে যাওয়া বন্ধ, সারাক্ষণ মায়ের কঠোর নজরদারি! নুহা জানতে পারে, এ সবের জন্য দায়ী ভাইরাসের জীবাণু। চারদিকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও সচেতনতার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে! ঘরের মধ্যে নুহার মন যেন থাকতেই চাচ্ছে না। নুহা বেশ সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। খুব ছোটবেলা থেকে এ অভ্যাস তৈরি হয়েছে তার। বিভিন্ন সময় ছবি এঁকে পুরস্কারও পেয়েছে নুহা। নুহা টেলিভিশনের পর্দায় ভাইরাসের ছবি দেখে দেখে আঁকার চেষ্টা করতে থাকে। রং-পেনসিলের প্রতিটি আঁচড় দিয়ে অতি নিখুঁতভাবে ভাইরাসের ছবি চেষ্টা করেও যেন হচ্ছে না! এ সঙ্কটের দিনগুলোতে ভাইরাসটাও যেন দুষ্টুমি করছে নুহার সঙ্গে! অবশেষে নুহা ভাইরাসটির অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকেছে। কোন ছবিতে সে ভাইরাসটিকে মেরে ফেলতে চেয়েছে, কোনটিতে আবার ভাইরাসটিকে বন্দী করে রাখার দৃশ্য এঁকেছে নুহা। আবার কোন ছবিতে সে ভাইরাসটিকে আগুনের তাপে মেরে ফেলার দৃশ্য অঙ্কন করেছে। নুহা তার বাবাকে ভিডিও কলে এসব ছবি দেখায়। নুহার বাবা মেয়ের এসব কা-কারখানা দেখে মনে মনে সাহস পায়। শত দুশ্চিন্তার মাঝেও এসব ছবি নুহার বাবাকে মনোবল ধরে রাখতে বেশ সহায়তা করে! স্কুলের বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে নুহার। নুহা উদাস মনে জানালার কাছে বসে আছে। স্কুল কবে খুলবে জানে না নুহা! নুহা বাসায় বসে রাস্তা থেকে কুকুরের ডাকের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এর আগে কখনও দিনের বেলা কুকুরের ডাকের শব্দ শোনেনি নুহা! কাকগুলো যেন খাবারের সন্ধানে এদিক-ওদিক ওড়াওড়ি করছে, কোথাও যদি খাবার পাওয়া যায়! বিড়ালগুলোরও মন ভাল নেই। বিড়ালগুলোর ব্যস্ততাও যেন কমে গেছে! এ মুহূর্তে নুহার খুব কাছের বন্ধু তার পোষা টিয়া পাখি। নুহা তার পোষা টিয়া পাখিটার সঙ্গে গল্প করে, খাবার দেয়। টিয়া পাখিরও যেন মন খারাপ! চারদিক যেন শূন্যতা! টিয়া পাখি নুহাকে বলে, ‘করোনাভাইরাস, করোনাভাইরাস! ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন।’ টিয়া পাখির এই কথা শুনে নুহা মুগ্ধ হয়ে যায়। পাখিরাও যেন সবকিছু বুঝতে পারে, মানুষকে সচেতন করতে পারে! এমন সুনসান শহর নুহা আগে কখনও দেখেনি! রাস্তাঘাটে মানুষ নেই বললেই চলে! দু-একটি রিকশা দেখা যাচ্ছে, তাও আবার অনেকক্ষণ পর পর! এ যেন এক অচেনা শহর! বাসার ছাদবাগানে পানি দেয়ার কথা মনে পড়ে যায় নুহার। আবদার করে তার বাবার সহযোগিতায় এই ছাদবাগান তৈরি করেছে নুহা। ছোট্ট এই বাগানে হরেক রকমের ফুলগাছ। ছাদবাগান থেকে হঠাৎ পাশের ছাদে চোখ চলে যায় নুহার। পাশের ছাদে নুহা দেখতে পায় একটা খাঁচার মধ্যে দুটি পাখি বন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। পাখি দুটিকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা কতদিন কিছু খায় না! অবস্থা দেখে মনে হয়, ওই বাসার সবাই ভাইরাসের ভয়ে হয়ত গ্রামে চলে গেছে! তাই ছাদে বন্দী পোষা পাখির কথা যেন কারো মনে নেই। ছাদের এক কোনে ছায়াঘেরা স্থানে খাঁচাটি থাকায় ঝড়, বৃষ্টি, রোদের হাত থেকে কিছুটা রেহাই পেলেও না খেয়ে পাখি দুটি বেশি দিন বাঁচতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না! এখনই খাবারের জন্য ছটফট করছে পাখিগুলো! পাখি দুটিকে দেখে নুহার খুব খারাপ লাগছিল। এ ঘটনার কথা নুহা তার মাকে জানায়। পাখি দুটিকে বাঁচাতে কি করা যায়; মা-মেয়ে মিলে বুদ্ধি বের করতে থাকে। সিদ্ধান্ত হলো, একটা লম্বা বাঁশ দিয়ে পাখির খাঁচাটিকে বাঁশের মাথায় বাঁধানোর পর উঠিয়ে নিজেদের ছাদে নিয়ে আসতে হবে, তারপর না হয় ওই বাসার মানুষ ফিরে আসলে পোষা পাখি দুটিকে তাদের কাছে ফেরত দেয়া যাবে! অবশেষে অনেক চেষ্টার পর পাখির খাঁচাটিকে নিজেদের ছাদে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় নুহা ও তার মা। নুহার বেশ খুশি খুশি লাগছে! খাবার ও পানি দেয়া মাত্রই খাঁচার পাখি দুটি খুশিতে ডাকতে শুরু করে! নুহার দিন-রাত্রির সময়গুলো এভাবে চলতে থাকে! নুহা টেলিভিশনে দেখতে পায় ডলফিন ফাঁকা সমুদ্র সৈকতে তার সৌন্দর্য দেখিয়ে যাচ্ছে! ফাঁকা সমুদ্র সৈকত পেয়ে দু-একটি হরিণও মনের সুখে ভুল করে সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে এসেছে! কোন কোন দেশে ফাঁকা রাস্তায় বন্যপ্রাণী যেন কিছু সময়ের জন্য আনন্দে মেতেছে! এসবের মধ্যেও নুহার মনে তার বাবার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে! টেলিভিশন দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ে নুহা। ঘুমের মধ্যে নুহা স্বপ্ন দেখে চারদিকে কোন আতঙ্ক নেই! সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে! তার দাদিও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে। নুহা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। নুহার বাবাও দেশে ফিরে এসেছে। আবার সেই চেনা ব্যস্ততা, চেনা পৃথিবী!
×