ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রেফতারের পর মোসলেমের ডিএনএ পরীক্ষা!

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ২৪ এপ্রিল ২০২০

গ্রেফতারের পর মোসলেমের ডিএনএ পরীক্ষা!

শংকর কুমার দে ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনী রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেমউদ্দিন খানকে গ্রেফতারের পর তার ‘ডিএনএ পরীক্ষা’ করা হচ্ছে বলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁওয়ের ঠাকুরনগর চাঁদপাড়া থেকে যেই ডাঃ সমীর দত্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই ডাঃ দত্ত বাবুই রিসালদার (বরখাস্ত) জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনী মোসলেমউদ্দিন? কারণ তিনি স্বীকারই করছেন না তার নামই মোসলেমউদ্দিন খান। আর এ নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এই গোলক ধাঁধা দূর করতেই গ্রেফতার হওয়া সত্তরোর্ধ ব্যক্তিটির ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, তিনিই কি মোসলেমউদ্দিন খান। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বুকে গুলিবর্ষণকারী জাতীয় চার নেতা হত্যাকা-ে জড়িত- পলাতক খুনী রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেমউদ্দিন ভারতে আটক হওয়ার পর তাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ভারতের গণমাধ্যমগুলো। গত ২২ এপ্রিল বুধবার খুনী মুসলেমউদ্দিনকে আটকের ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের টিভি চ্যানেল এনডিটিভি। এর আগের দিন মঙ্গলবার ভারতের ইংরেজী দৈনিক দ্য হিন্দুর খবরে বলা হয়, সম্ভবত মোসলেমউদ্দিনকে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ পক্ষ থেকে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার বিষয়ে অপেক্ষায় আছে। তারও আগের দিন গত সোমবার ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়, ভারতের গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় মোসলেমউদ্দিনকে উত্তর চব্বিশ পরগনায় একটি গ্রাম থেকে আটক করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ বা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখনও সুনির্দিষ্ট কোন ঘোষণা না আসা বিষয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা কাটাতে এখন আটক হওয়া ব্যক্তি মোসলেমউদ্দিন খান কিনা তা নিশ্চিত হতে তার ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে। গত ২৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবারও ভারতের বহুল প্রচারিত আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর খুনী মোসলেমউদ্দিন সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁও থেকে যাকে আটক করা হয়েছে, সেই বৃদ্ধই জাতির পিতার প্রকৃত ঘাতক রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেমউদ্দিন কিনা, তা নিশ্চিত করতে তার ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে বাংলাদেশী গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। অর্থাৎ ‘মোসলেমউদ্দিন’ গ্রেফতারের ঘটনা যে সত্য তার অন্তত একটি সুনির্দিষ্ট তথ্য এক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়া গেল। এখন প্রতীক্ষা এই আটক ‘মোসলেহ উদ্দিন’-ই ঘাতক মোসলেমউদ্দিন কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি। প্রতিবেদনে আনন্দবাজার জানায়, সত্তরোর্ধ এই বৃদ্ধকে আটকের পর রবিবার রাতে উত্তর ২৪ পরগনার বেরি গোপালপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশী গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেয়া হয় বলে দাবি করেছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রের দাবি। প্রতিবেদন প্রকাশের সূত্রের খবর অনুযায়ী, প্রায় ৪৮ ঘণ্টা যৌথ জেরায় ধৃতকে মুজিব-ঘাতক বলেই মনে হয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের। কিন্তু তার পরেও পরিচয় সুনিশ্চিত হতে বাংলাদেশে বসবাসকারী মোসলেমউদ্দিনের নিকট আত্মীয়দের জিনের সঙ্গে বৃদ্ধের জিন মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দাদের দাবি, পরিচয় নিশ্চিত না-হলে ওই বৃদ্ধকে যাতে পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে দেয়া যায়, সেই কারণেই হন্তান্তরের গোটা বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের মধ্যে ছড়াছড়ি হলেও সরকারী বা বেসরকারীভাবে বাংলাদেশ বা ভারত- দুই দেশের কোন দেশই স্বীকার বা অস্বীকার করছে না। মাজেদকে জেরার পরেই চার দশক ধরে গা ঢাকা দেয়া মোসলেমউদ্দিনের খোঁজ পায় বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা। এর পরেই শুরু হয় বাঙালীর চোখে ঘৃণ্য এই খুনীকে বাগে আনার মাস্টারপ্ল্যান। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি বিশ্বস্ত সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) খুনী মাজেদকে গ্রেফতারের পর তার কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তার মতো মোসলেমউদ্দিনও পশ্চিমবঙ্গে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে বলে দাবি জানায় বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। যার প্রেক্ষিতে তৎপরতা শুরু করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি বিশেষ টিম। বাংলাদেশ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ জেলার ঠাকুরনগরে চাঁদপাড়ায় লুকিয়ে ছিলেন কথিত মোসলেমউদ্দিন। তার ছদ্মনাম সমীর দত্ত, পেশায় ইউনানি চিকিৎসক। তিনি চিকিৎসা বিষয়ে একটা বইও লিখেছেন। সেটি গত বছরের শেষদিকে প্রকাশ হয়েছে। বইয়ে নিজের নাম লিখেছেন দীপক চক্রবর্তী নামে। ওই ব্যক্তি সর্বশেষ উত্তর চব্বিশ পরগনায় ছোট্ট একটি ঘরে থাকতেন। বাড়ির মালিক জানিয়েছেন, তার কেউ না থাকায় তাকে এই বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়। তবে ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত মাঝে মধ্যে তিনি ১০/১৫ দিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যেতেন। তিনি ফোন ব্যবহার করতেন না। তার কোন চিঠিও আসত না। প্রায় ১০ বছর এখানে বসবাস করেছেন। ভাল ইংরেজী বলতে পারতেন। কলকাতার পুলিশ এখন সমীর দত্তের সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র খতিয়ে দেখছে, আসলেই তিনিই বাংলাদেশের খুনী মোসলেমউদ্দিন কিনা? গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, খুনী মোসলেমউদ্দিনের গুলিতেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালী জাতির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। এর মাত্র তিন মাস পরে ওই বছরই ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে সেনাদের যে দলটি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং তিন মন্ত্রী মোহাম্মদ মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে গুলি করার পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে, তাতেও ছিল এই বর্বর ঘাতকের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্ট ২০০৯-এর নবেম্বরে মোসলেমউদ্দিনসহ ১২ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখে। কিন্তু অতীতে কয়েকবার গোয়েন্দাদের জাল কেটে পালায় ধুরন্ধর এই ঘাতক মোসলেমউদ্দিন। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, করোনাভাইরাস প্রকোপ ছড়িয়ে পড়া বন্ধে লকডাউনের মধ্যে সম্ভাব্য মোসলেমউদ্দিনের খবর পায় বাংলাদেশী গোয়েন্দারা। এরপর দিল্লীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বলে নিশ্চিত করেছে গোয়েন্দা তথ্য সূত্র। সেই তথ্যের ভিত্তিতে গত শুক্রবার উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি উপশহর থেকে এই বৃদ্ধকে ধরে একটি গোপন জায়গায় জেরা শুরু করেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। ডেকে নেয়া হয় বাংলাদেশী গোয়েন্দা কর্তাদেরও। তার পরেই পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশী গোয়েন্দাদের হাতে সন্দেহভাজন এই মোসলেমউদ্দিনকে তুলে দেয়া হয়েছে বলে ভারতীয় গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানিয়েছে। এখন ভারতের গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হওয়া যেই ব্যক্তিকে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, প্রকৃত পক্ষেই সেই ব্যক্তিটিই খুনী মোসলেমউদ্দিন খান কিনা তা ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রের দাবি।
×