ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

টিকে থাকার লড়াইয়ে সংবাদমাধ্যম, সঙ্কট বাড়ছে

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ২৪ এপ্রিল ২০২০

টিকে থাকার লড়াইয়ে সংবাদমাধ্যম, সঙ্কট বাড়ছে

রশিদ মামুন ॥ করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট বৈশি^ক মহামারী দেশের সংবাদমাধ্যমকে টিকে থাকার লড়াইয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সরকারী সংবাদমাধ্যম ছাড়া দেশের ছাপা পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইন নিউজপোর্টাল এবং টেলিভিশনগুলো সঙ্কটময় মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি পত্রিকা তাদের ছাপানো সংস্করণ বন্ধ রেখে কেবল অনলাইন চালু রেখেছে। পুরাতন এবং নতুন সংবাদমাধ্যমের এই উদ্যোগের ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে চাকরি হারানোর ভীতি কাজ করছে। করোনা দেশের সাংবাদিকদের অনিশ্চিত আশঙ্কার জীবনের ওপর কালো ছায়া হয়ে নেমে এসেছে। সঙ্কট মোকাবেলায় নিউজ পেপার্স ওনার্স এ্যাসোনিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এবং সম্পাদক পরিষদ বলছে বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পরিশোধের পাশাপাশি সরকার ঘোষিত প্রণোদনায় শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের জন্য ঋণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মূলত সংবাদমাধ্যমের প্রধান আয়ের উৎস সরকারী বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বেসরকারী পণ্য এবং সেবার বিজ্ঞাপন প্রচার। এর পাশাপাশি ছাপা পত্রিকা বিক্রি করে কিছু আয় হয়ে থাকে। কিন্তু একটি পত্রিকা ছাপার জন্য যে খরচ তার থেকে অনেক কম দামে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে হয়। ফলে এখান থেকে আয় হলেও সব সময় একটি ঘাটতি থেকে যায়। বিজ্ঞাপনের অর্থ দিয়ে ছাপা পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইন নিউজপোর্টাল এবং টেলিভিশন সংবাদকর্মী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করে থাকে কিন্তু করোনার কারণে সরকারী এবং বেসরকারী বিজ্ঞাপন একেবারে কমে গেছে। আবার আদায় হচ্ছে না বিজ্ঞাপনের অর্থও। ফলে টিকে থাকার লড়াই প্রতিদিন কঠিন হচ্ছে। একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান বলছিলেন, গত ২৬ মার্চ থেকে লকডাউনের পর থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ আয় কমতে শুরু করে। দিনের পর দিন যা শুধু কমছেই। বৃদ্ধির কোন লক্ষণ আপাতত নেই। করোনা চলে গেলেও এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, সরকারী যেসব বিজ্ঞাপন আসত অফিস-আদালত বন্ধ থাকার কারণে সেগুলো আর তেমন আসছে না। এখন যা বিজ্ঞাপন পাওয়া যাচ্ছে তা কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনা সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি। এর বাইরে সরকারী বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। অন্যদিকে বেসরকারী বিজ্ঞাপনের অবস্থাও ভাল নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিন পত্রিকার পাতা ওল্টালে বোঝা যায় কী পরিমাণ বিজ্ঞাপন কমেছে। বেসরকারী সেবা এবং পণ্যের ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন নানামুখী সঙ্কটে। সবাই এখন টিকে থাকার জন্য লড়াই করছেন। সঙ্গতকারণে আমি কী করে বাঁচব এই চিন্তা না করে অন্য আরেকজন কী করে বাঁচবেন সেই চিন্তা করার অবকাশ তাদের হাতেও নেই। আবার বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল যেমন পাওয়া যাচ্ছে না আর এখন যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন তাদের টাকাও বাকি থাকছে। সব মিলিয়ে আয় শূন্য খাতের প্রতিদিনের ব্যয় বাড়ছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, ছাপা সংবাদপত্র করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে না। ডব্লিউএইচও তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ছাপানো সংবাদপত্র নানা তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে যায় ফলে এখানে কোভিড-১৯ বেঁচে থাকতে পারে না। করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকেই ডব্লিউএইচওর এই বিবৃতি দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে ছেপেছে। তবে এতেও সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার নি¤œগামিতা রোধ করা যায়নি। যারা প্রতিদিন সকালে উঠেই চায়ের টেবিলে সংবাদপত্র খুঁজতেন তাদের অনেকেই এখন সংবাদপত্র রাখছেন না অথবা রাখতে পারছেন না। এখানে সব থেকে বড় বাধা আসছে বাড়ির মালিকদের তরফ থেকে দেশের যেসব এলাকায় লকডাউন চলছে সকালে সেখানে সংবাদপত্র বিলি করতে অনেক হকারকেই বেগ পেতে হচ্ছে। আবার কোন এলাকা লকডাউনের আওতামুক্ত থাকলেও সেখানে করোনার কারণে বাইরের মানুষকে প্রতিদিন ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। সংবাদপত্র হকার্স ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি মোস্তফা কামাল জানান, আগের তুলনায় এখন এক-তৃতীয়াংশ সংবাদপত্র চলছে। এই শিল্পে বিরাট একটি ধস নেমেছে। তিনি জানান, প্রতিদিন দেশে ১৮ থেকে ২০ লাখ ছাপা সংবাদপত্র বিক্রি হলেও এখন তা সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখে এসে ঠেকেছে। তিনি বলেন, আমাদের হকাররা বাড়িতে কাগজ বিলি করতে প্রবেশ করতে পারছে না। গত মাসে যে কাগজ দিয়েছিল তার বিলও বেশিরভাগ বকেয়া পড়ে রয়েছে। সংবাদপত্র থেকে জীবাণু ছড়ায় না বিষয়টি আমাদের হকাররাও বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনভাবেই বাড়ির মালিকরা তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। ফলে কাগজের কাটতি কমে গেছে। বিজ্ঞাপন এবং সংবাদপত্রের কাটতি কমে যাওয়াতে আয় কমেছে সংবাদমাধ্যমের। এর বিপরীতে ব্যয় আগের মতোই রয়েছে। আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি মেটানো অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি পত্রিকা তাদের ছাপানো সংস্করণ থেকে সরে এসেছে। অনুসন্ধানে দেশের একটি বৃহৎ শিল্প গ্রুপের মিডিয়া হাউসে সঙ্কট তৈরি হওয়ার খবর জানা গেছে। এই প্রতিষ্ঠানের একটি বাংলা এবং ইংরেজী দৈনিকে গত দুমাস সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ করেনি। শিল্প গ্রুপটি পত্রিকার আয়ে পত্রিকা চালানোর নীতি গ্রহণ করায় এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্কট নিয়ে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছে নিউজ পেপার্স ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব), সম্পাদক পরিষদ। সংবাদমাধ্যমের মালিক এবং পরিচালকরা এ সময় সরকারের কাছে প্রণোদনা চাওয়ার পাশাপাশি সংবাদপত্রের বকেয়া বিল পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছেন। নিউজ পেপার্স ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এর সভাপতি এবং দৈনিক সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদ বলেন, আমরা সরকারকে বলেছি বিজ্ঞাপনের যে বকেয়া বিল রয়েছে তা পত্রিকাগুলোকে পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করে দিতে হবে। এর পাশাপাশি সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সংবাদপত্রকে ঋণ দিতে হবে। এই দাবির অগ্রগতি সম্পর্কে আজাদ বলেন, বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া আমরা নোয়াবের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের কাছে সরকার ঘোষিত প্যাকেজ থেকে আমাদের ঋণ প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেবে বলে আশা করছি। বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, এখন পত্রিকাগুলোর ৯৪ কোটি টাকা বকেয়া বিজ্ঞাপন বিল রয়েছে। সেটি সবার আগে পরিশোধ করে দিতে হবে। তাহলে পত্রিকাগুলো তাদের ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে। এছাড়া সরকার টেলিভিশনে বিভিন্ন ক্লিপ পাঠায় প্রচারের জন্য। সেখানে তাদের কোন বিল দেয়া হয় না। আমরা বলেছি সরকারী প্রচারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিলে টেলিভিশনগুলোর আয় বাড়বে। তিনি বলেন, এরপর সংবাদমাধ্যমের মালিকদের ঋণ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আসতে পারে। তিনি বলেন, সঙ্কটকালীন মুহূর্তে সংবাদকর্মীদেরও ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। কারণ এই সঙ্কট এক সময় কেটে যাবে। প্রসঙ্গত গত ডিসেম্বর থেকে বিশে^ করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়েছে। প্রায় চারমাস ধরে বিশে^ করোনা পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। যাতে অর্থনীতি চাপে পড়ছে। বাংলাদেশেও সরকারী ছুটি আগামী মে’ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। কর্যকর প্রতিষেধক এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হাওয়াতে ডব্লিউএইচও বলছে, লকডাউনই মানুষের জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায়। কোন কারণে লকডাউন শিথিল করা হলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। ফলে সংবাদমাধ্যমের এই সঙ্কট কতটা দীর্ঘায়িত হবে এখনই বলা কঠিন।
×