ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইসিইউ-ভেন্টিলেশন সুবিধা নিয়ে দুশ্চিন্তা

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ২৪ এপ্রিল ২০২০

আইসিইউ-ভেন্টিলেশন সুবিধা নিয়ে দুশ্চিন্তা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিশে^র ২১০টির বেশি দেশ ও অঞ্চল করোনার থাবায় আক্রান্ত। গত ডিসেম্বরে চীন থেকে শুরু হওয়া এ প্রাণঘাতী ভাইরাস দমনে এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। এ নিয়ে মহাচিন্তা বিশ^ নেতাদের। বিজ্ঞানীরা রাতদিন চেষ্টাতেও অদৃশ্য এই শত্রুকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ইতোমধ্যে গোটা বিশে^ এ ভাইরাসে প্রায় সাড়ে ২৬ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে প্রায় এক লাখ ৮৫ হাজার মানুষের। সুস্থ হয়েছেন প্রায় সোয়া সাত লাখ মানুষ। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১৮৬। মৃত্যু হয়েছে ১২৭ জনের। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ১০৮ জন। অর্থাৎ সুস্থ হওয়ার চেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ঘটনা চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে সামনের দিনগুলোতে রোগী বাঁচাতে প্রয়োজন হতে পারে উন্নত চিকিৎসাসেবা। এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর যে ধরনের চিকিৎসা সুবিধার প্রয়োজন হতে পারে তার প্রচ- অভাব দেখা যাচ্ছে দেশের হাসপাতালগুলোতে। কারণ এ রোগের অন্যতম উপসর্গ হলো শ^াসকষ্ট। আর শ^াসকষ্ট দেখা দিলে রোগীর অবশ্যই উন্নত চিকিৎসাসেবা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা মহানগরসহ চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলায় কোভিড-১৯ বেশি বিস্তার লাভ করেছে। মোট রোগীর ৮৫ ভাগের বেশি ঢাকা বিভাগের। জানা গেছে, ঢাকা বাদে বেশি আক্রান্ত জেলায় যথেষ্ট পরিমাণে নিবিড় সেবা ইউনিট বা আইসিইউ, ভেন্টিলেশন সুবিধা নামেমাত্র। গুরুতর রোগী হলেই তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে জানিয়েছেন একাধিক জেলার চিকিৎসকরা। অথচ চীন, ফ্রান্স, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যসেবা বেশ উন্নত। সেখানে আইসিইউ, ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে অনেক রোগী বাড়ি ফিরে গেছেন। পরিবারে ফিরেছে হাসি। কেটেছে অজানা ভয়, আতঙ্ক। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের চিকিৎসাসেবার পরিধি বেশি না থাকায় স্বাস্থ্য বিভাগের অনেকেই এ নিয়ে মহাচিন্তায় আছেন। তারা বলছেন, পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যদি যায় তাহলে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা না গেলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে। ২১-৪০ বছয় বয়সীরা আক্রান্ত বেশি ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে ৬৮ ভাগ পুরুষ আর ৩২ ভাগ নারী। এর মধ্যে ২১-৩০ বছর বয়সী আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ ভাগ। ৩১-৪০ এর মধ্যে ২২ ভাগ, ৪১-৫০ এর মধ্যে ১৮ ভাগ, ৫১-৬০ এর মধ্যে ১৫ ভাগ, ৬০ এর বেশি ১০ ভাগ, ১১-২০ এর মধ্যে আট ভাগ ও ১০ বছর বয়সের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা তিন ভাগ। এই পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মূল জনশক্তি ২১-৪০ বছর বয়সের মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক দূরত্ব না মানার কারণেই কম বয়সের মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। মূল জনশক্তিকে বাঁচাতে প্রয়োজন উন্নত চিকিৎসাসেবা। তাই বেশি বেশি ভেন্টিলেশন বা আইসিইউ স্থাপনের বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে যদি মূল জনশক্তি আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ে তবে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ। যদিও বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কৃত্রিম শ^াস-প্রশ^াস যন্ত্র ভেন্টিলেশন বানাতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ভেন্টিলেটরের অভাব ॥ ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে আর কোন শহরে ভেন্টিলেশন সুবিধাসম্বলিত পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ নেই। ফলে কোন জেলা শহরের রোগীর ভেন্টিলেশন দরকার হলে তাকে ঢাকা পাঠানো ছাড়া বিকল্প নেই। যেমন হবিগঞ্জে একাধিক রোগীর করোনা ধরা পড়ার পর আইসিইউ সুবিধার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। কিশোরগঞ্জে দুই চিকিৎসকের করোনাভাইরাস ধরা পড়ার পর আইসিইউ সুবিধার জন্য তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। কারণ এই জেলা বা আশপাশের জেলাগুলোয় আইসিইউ সুবিধাসম্বলিত কোন হাসপাতাল নেই। সিলেটে আইসিইউ থাকলেও, সেখানকার একজন চিকিৎসক সেখানে ভেন্টিলেশন সুবিধা না পেয়ে ঢাকায় আসতে বাধ্য হন। বাংলাদেশের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম কোন চিকিৎসক হিসেবে ঢাকায় তার মৃত্যু হয়। গাজীপুর জলায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আর এই বৃদ্ধির গতি বেশ দ্রুত বলছেন জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ খায়রুজ্জামান। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী বাড়ছে নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মুন্সীগঞ্জ, শরিয়তপুরসহ বিভিন্ন জেলায়। তবে কিশোরগঞ্জের মতো বেশিরভাগ জেলা শহরের হাসপাতালে কোন আইসিইউ সুবিধা নেই। এখানে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী ৫৩২ জন হলেও সেখানে আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র আটটি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়েছে। কিন্তু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য সারাদেশে নির্ধারিত আটটি হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১৯২টি, যার মধ্যে ৮৯টি ঢাকায়। শুধু বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোট ৬ হাজার ৭২৬টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত করার কথা জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫০টি শয্যা শুধু ঢাকা শহরে। বাড়িতে রেখে চিকিৎসা ॥ একাধিক জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভাগীয় শহরগুলোর বাইরে জেলা শহরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইসিইউ সুবিধার ব্যবস্থা নেই। সুনামগঞ্জের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী গুরুতর মনে হলেই তাকে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তেমনি নেত্রকোনা জেলা সদর হাসপাতালের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, আক্রান্ত ব্যক্তি গুরুতর হলে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে। যদিও নেত্রকোনায় একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের কার্যক্রম শুরু হলেও অবকাঠামোগত কোন সুবিধাই হয়নি। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা সদর হাসপাতালের ডাক্তাররা বলছেন, প্রতিটি হাসপাতালে প্রায় আইসোলেশন ইউনিট আছে। তবে বেশিরভাগ রোগীকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করা হচ্ছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আইসিইউ সুবিধা নেই। তাই যাদের করোনাভাইরাসের সঙ্গে হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা বা অন্য কোন জটিলতা রয়েছে, তাদের সবাইকে করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় পাঠিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের ওপর নির্দেশনা আছে। চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের লক্ষণ থাকার পরেও অনেক রোগী সেটা লুকিয়ে রেখে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যার ফলে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। কিশোরগঞ্জ জেলার চারশ’ স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে ৪১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক জেলার চিকিৎসক ও নার্সরা জানিয়েছেন, তারা প্রয়োজন মতো পিপিই পাননি, ফলে তাদেরই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। একদিকে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি, আরেক দিকে আরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হলে জেলা বা উপজেলা শহরের স্বাস্থ্যকর্মী সঙ্কট হওয়ার আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারা। এদিকে ঢাকায় করোনার মূল চিকিৎসা কেন্দ্র কুয়েত মৈত্রী ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। এই দুই হাসপাতালের চিকিৎসাকাজে নিয়োজিতদের নানা সঙ্কটের কথা আসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। বিশেষ করে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ৪০০ নার্সের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকায় যেমন আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়ার সম্ভাবনা আছে তেমনি নার্সদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল করোনা রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানে রোগী ভর্তির প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। তবে সাধারণ রোগী ছাড়া জটিল কোন রোগীকে ভর্তি করে চিকিৎস সেবার কোন ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ আইসিইউ বা ভেন্টিলেশন সুবিধার কোনটিই নেই এখানে।
×