ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মসজিদে তারাবির নামাজ হচ্ছে না ;###;নামাজ আদায় করতে হবে যার যার বাসায় ;###;ইফতার পার্টির কালচারও বন্ধ

এবার করোনার ধাক্কা রমজানেও

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ২৪ এপ্রিল ২০২০

এবার করোনার ধাক্কা রমজানেও

ওয়াজেদ হীরা ॥ ‘মাহে রমজান এলো বছর ঘুরে, মুমিন মুসলমানের দ্বারে দ্বারে’। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের এবারের রমজান উৎসব আনন্দহীন হয়ে উঠছে। করোনাভাইরাসের আক্রমণে নাকাল বিশ্ব। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মসজিদে বন্ধ রয়েছে নামাজ আদায়। মানুষ রক্ষার যুদ্ধে রমজানে সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতাও ঘরবন্দী হচ্ছে। রোজায় সেহরি ইফতারে থাকবে না কোন আড়ম্বর আয়োজন। বাইরের সকল আয়োজনই থাকবে বন্ধ। এছাড়াও ইফতার পার্টির নামে এবার রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনগুলোরও কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে না। মুসলমানদের ঘরেই আদায় করতে হবে তারাবির নামাজ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দীর্ঘদিনের ইফতার-সেহরি কালচারে পরিবর্তন আসলেও মানুষ রক্ষা, জীবন রক্ষাই এখন বড় ধর্ম মনে করছেন আলেম সমাজ। রহমত বরকতের মাস, সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র মাহে রমজান শুরু হচ্ছে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হতে পারে রমজান। রমজান এলেই সারাদেশে শুরু হয়ে যায় উৎসবের আমেজ। দিনব্যাপী পানাহারে বিরত থেকে সন্ধ্যায় ইফতারের আনন্দ। এছাড়াও কয়েক বছর ধরেই ঘটা করে সেহরির আয়োজন করে আসছিল রাজধানীসহ গোটা দেশের মানুষ। অলিতে গলিতে সেহরি ইফতারে সেকি আনন্দ। শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয় রমজান। মানুষের পাশে দাঁড়ায় মানুষ। একে অন্যের খোঁজ নেয়া, সেহরি ইফতারে দাওয়াত দেয়া, দান খয়রাত বৃদ্ধি করা, কমে আসে অপরাধ তৎপরতাও। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ইফতারকেন্দ্রিক ইফতার পার্টির আয়োজন করে থাকে। সবার মধ্যে একটা মেলবন্ধন তৈরি হয়। এ বছর করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে রমজানের এসব আনুষ্ঠানিকতা এবার ঘরবন্দী হচ্ছে। কেননা, করোনাভাইরাসের আক্রমণে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে থামবে তা অনিশ্চিত। থেমে থেমে আসছে মৃত্যুর খবর। দেশে দেশে জনসমাগম এড়াতে লকডাউন চলছে। বাদ যায়নি মসজিদও। দেশেও মসজিদে নামাজ আদায় না করতে সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই সৌদি আরব সরকার তারাবির নামাজ ঘরে আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশের মানুষদের ঘরে তারাবির নামাজ আদায় করতে বলেছেন। করোনার কারণে এবার কেউ শব-ই-বরাতের ইবাদত বন্দেগিও মসজিদে করতে পারেননি। রমজানেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ব্যাপক সমাগম এড়াতে মসজিদে নামাজ আদায় বন্ধ রয়েছে। সেই সঙ্গে সরকারী ছুটিও রয়েছে। তাই রমজান মাসেও আনুষ্ঠানিকতাও থাকছে সীমাবদ্ধতায়। সারা বিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসটি বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলেছে গত মাসের শুরু থেকে। প্রথম রোগী শনাক্তের পর থেকেই প্রতিদিন করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে বিশে^ ২৬ লাখের বেশি আক্রান্ত, মারা গেছেন পৌনে দুই লাখের বেশি মানুষ। দেশেও রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ১৮৬, মারা গেছেন ১২৭। রমজানের শুরুতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে ঘরে অবস্থান করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ নানা নির্দেশনা দিয়ে লম্বা ছুটি ঘোষণা করে রেখেছে সরকার। এছাড়াও সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। করোনা প্রতিরোধে সরকার দেশের বিভিন্ন জেলা, স্থান ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছে। তাই রমজানে বাইরের আনুষ্ঠানিকতায় এবার ভাটা। বিভিন্ন হোটেল মোটেল বন্ধ থাকায় কেউ বুকিং বিষয়ে যোগাযোগও করছেন না। রমজানে বিভিন্ন ইফতারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বিক্রি হলেও সাধারণ ছুটি থাকলে এবার হোটেল রেস্তরাঁ খোলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে রোজাদারদেরও বাইরে থেকে বিভিন্ন ইফতারি পণ্য কেনা সীমিত হয়ে যাবে। রোজায় ইবাদত বাসায়ই, মসজিদে থাকছে না ইফতারি কার্যক্রম ॥ ইতোমধ্যে সেহরি ইফতারির সময়সূচী ঘোষণা করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। তারা জানায়, চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ২৫ এপ্রিল থেকে রমজান শুরু হতে পারে। ইসলামী বিধান মতে মাসব্যাপী রোজা পালনের জন্য কিছু আবশ্যিক নিয়ম কানুন মানতে হয় যার মধ্য রয়েছে তারাবির নামাজ, সেহরি ও ইফতারি। রোজার মাসে মুসলমানরা এগুলো যৌথভাবে আদায় করে থাকেন। এছাড়া ইসলামী ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রায় চার হাজার লোকের ইফতারির আয়োজন করা হয়ে থাকে। মসজিদে মসজিদে চালু থাকে ইফতার। এছাড়াও ব্যক্তি ও পরিবারেও ইফতারের দাওয়াত কালচার চালু রয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, রমজানেও মুসল্লিদের বাসায় ইবাদত করতে হবে। তবে এবছর একত্রে তারাবি হচ্ছে না মুসল্লিদের। সেই সঙ্গে বন্ধ থাকবে জাতীয়সহ অন্যান্য মসজিদের বৃহৎ ইফতারির আয়োজন। যতটুকু হবে মসজিদের দায়িত্বরতদের জন্যই। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মসজিদে তারাবি পড়া নিষেধ ॥ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশেও রোজায় মসজিদে তারাবির নামাজ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এবার ঘরেই ইফতার এবং তারাবির নামাজ ও ঈদের নামাজও যার যার বাসায় পড়তে হবে বলে জানিয়েছেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আল শেখ। এ তথ্য জানিয়েছে সৌদি গেজেট। সৌদি আরবে ইসলামী আইনশাস্ত্রের কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে ফতোয়া দেয়ার চূড়ান্ত এখতিয়ার দেশটির গ্র্যান্ড মুফতির হাতে ন্যস্ত। শেখ আবদুল আজিজ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধের কারণে যদি মসজিদে যাওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে বাড়িতেই তারাবির নামাজ পড়া যাবে। ঈদের নামাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হবে। এর আগে সৌদি আরবের ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী শেখ ড. আব্দুল লতিফ বিন আবদুল আজিজ আশ-শেখও রোজার মাসে ঘরে বসেই তারাবি নামাজ পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। রমজানে কাবায় অন্তত ১০ লাখের বেশি মানুষ একত্রে নামাজ পড়েন। এ মাস ওমরাহ পালনেরও উপযুক্ত সময়। ওমরাহের ওপরও গত মাসে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সৌদি আরব। করোনাভাইরাসের কারণে আধুনিক সৌদি আরবের ইতিহাসে এবারের হজ উৎসবও বাতিল হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আগামী জুলাইয়ের শেষে হজ পালিত হওয়ার কথা রয়েছে। রাজনৈতিক ইফতারও হচ্ছে না এবার ॥ এবছর বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক ইফতারও হচ্ছে না বলে জানা গেছে। লোকসমাগম এড়াতে সব দলই সতর্কতা অবলম্বন করছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু জনকণ্ঠকে বলেন, করোনায় জনসমাগম এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। যে কোন ইফতার হলে সেখানে লোকজন বাড়বে ভিড় হবে। আমার মনে হয় এ বছর এটি করা যাচ্ছে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এখন পর্যন্ত এ ধরনের জনসমাগমের সকল কর্মসূচী এড়িয়ে কাজ করতে দেখেছি। আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া জনকণ্ঠকে বলেন, লোক সমাগম হয় এরকম সকল অনুষ্ঠান পরিহার করা হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এবার এটি হচ্ছে না। জনসমাগম এড়াতে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আমরা কাটছাঁট করেছি। আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানও করতে পারি নাই। ইফতার পার্টি করা আমাদের কালচার। তবে এই ধরনের আয়োজন কেউ করবে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রতিবছর গণভবনে বিভিন্ন পেশাজীবী ও এতিমদের জন্য ইফতার আয়োজন বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মনে হচ্ছে এবার এটি হচ্ছে না। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, তারাবিহর নামাজ নিয়ে যেখানে নিষেধ করা হচ্ছে ঈদের জামাত করা যাবে কিনা অনিশ্চিত সেখানে আমরা এবার এ ধরনের লোকসমাগম কিছু করবো না। তবে চেষ্টা থাকবে দরিদ্র দুস্থদের মধ্যে ইফতার দেয়ার। যাকাত প্রতিবছরই দিতে হয় এবার একটু বাড়িয়ে বেশি মানুষকে সাহায্য করা যায় কিনা সেটি ভাবছি। বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, আমরা ত্রাণ কার্যক্রম করছি। আমার মনে হয় আমরা কেউ এবার এই ইফতারকেন্দ্রিক কিছু করতে পারব না। সবাই যার যার বাসায় পারিবারিক আবহে করবেন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন আগে। তবে আমরা যেটা করতে পারি আরও বেশি মানুষের পাশে দাঁড়াতে ইফতারির অর্থ খরচ করতে পারি সামনে এটি নিয়ে দলীয়ভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
×