ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাইফুজ্জামান

কবিতার জাদুকর

প্রকাশিত: ১০:৩০, ২৪ এপ্রিল ২০২০

কবিতার জাদুকর

স্মরণ ॥ বিংশ শতাব্দীর ছয় দশকে বেলাল চৌধুরীর (১২ নবেম্বর ১৯৩৮-২৪ এপ্রিল ২০১৮) বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব। প্রবন্ধ রচনা, অনুবাদে আত্মনিয়োগ, সম্পাদনায় যুক্ত থাকা তাকে খ্যাতির শীর্ষ দেশে পৌঁছে দেয়। সাংবাদিক হিসেবে তিনি সমধিক জনপ্রিয় ছিলেন। কবি বেলাল চৌধুরীর জন্ম : শর্শদি ফেনী, ১২ নবেম্বর ১৯৩৮। পিতা : রফিক উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। তিনি ১৯৫৭ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি যখন ছাত্র তখন বাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা। ছয় ও সাত দশকে কলকাতা থাকার সময় বেলাল চৌধুরী কৃত্তিবাস পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তার সম্পাদনা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল। পল্লীবারতা, সচিত্র সন্ধানী ও ভারত বিচিত্রা সম্পাদনার দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। বল্লাল সেন, ময়ূর বাহন, সবুক্তগীন ছদ্মনামে লিখিত তার কলামগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেলাল চৌধুরী ১৯৭৪ সালে দেশে ফিরে সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রগতিশীল কাজে জড়িয়ে পড়েন। জাতীয় কবিতা পরিষদ ও পদাবলী কবিতা সংগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সাহিত্য অন্তপ্রাণ বেলাল চৌধুরী সারা জীবন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেছেন। অন্যায় অত্যচার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। প্রথম যৌবনে জাহাজে চড়ে চামড়ার ব্যবসা করতে বাড়ি ছেড়েছিলেন। কলকাতায় একাধিকবার নোঙর ফেলে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ অসংখ্য কবিদের বন্ধু হয়ে ওঠেন। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। নিরীক্ষাধর্মী কবিতা রচনা করে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার ভাষায় তিনি ছিলেন সশিক্ষিত। কবি বেলাল চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : নিষাদ প্রদেশ (১৯৬৪), বেলাল চৌধুরীর কবিতা (১৯৭৩), আত্মপ্রতিকৃতি স্থির জীবন ও নিসর্গ (১৯৭৫), স্বপ্নবন্দী (১৯৭৯), সেলাই করা ছায়া (১৯৮০), যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে (১৯৯৭) বত্রিশ নম্বর (১৯৯৭)। গদ্যগ্রন্থ : কাগজে কলমে। শিশুতোষগ্রন্থ : উপন্যাস সপ্তরন্তের কা- কারখানা (১৯৮১) ছড়াগ্রন্থ : সবুজভাষার ছড়া, বত্রিশ দাঁত (১৯৮১)। অনুবাদগ্রন্থ : মৃত্যুর বাড়ানাড়া (১৯৯৭), ভ্রমণগ্রন্থ : সূর্যকরোজ্জ্বল বনভূমি। কবি বেলাল চৌধুরী, বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৪), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭) নীহাররঞ্জন পুরস্কার (১৯৯২)-তে ভূষিত হয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থঃ স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল, ডুমুর পাতার আবরণ, চেতনার রং চন্দ্রশিলা, লাকসাম দাদা ও অন্যান্য গল্প, শিশু কিশোর সাহিত্য : সাড়ে বত্রিশ ভাজা, সপ্তরতেœর কান্ডকারখানা, সবুজ ভাষার ছড়া। হোরহে লুই বোরহেস, পাবলো নেরুদা, ডিলান টমাস, অক্তারিও পাসের কবিতা অনুবাদ ও, স্মারক গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন বেলাল চৌধুরী। তার সসম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ বিশব নাগরিক গ্যেটে, পাবলো নেরুদা শত বর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, শামসুর রাহমান সংবর্ধনা গ্রন্থ, কবিতায় বঙ্গবন্ধু প্রভৃতি। বেলাল চৌধুরী নিরন্তর কবিতা, প্রবন্ধ স্মৃতিচারণমূলক বিভিন্ন রচনায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন। দুই বাংলার লেখকদের সঙ্গে তিনি সংযোগ স্থাপন করেছেন। কলকাতা ও ঢাকার লেখকদের তিনি এক সুতোয় গেঁথে ছিলেন। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের হালনাগাদ খবর তার কাছে পাওয়া যেত। আফ্রিকান সাহিত্যে তার আগ্রহ ছিল। তার বন্ধু তালিকায় ছিলেন কমলকুমার মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আলোকরঞ্জন দাস গুপ্ত, উৎপল কুমার বসু। নোবেল বিজয়ী গুন্টার গ্রাস বাংলাদেশে এসে তার সঙ্গী ছিলেন। গ্রাসের ঢাকা আবিষ্কারে বেলাল চৌধুরী ছিলেন পথপ্রদর্শক। বহু লেখককে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছিলেন অথচ তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী, নীরবে পাঠে মগ্ন থেকেছেন। মাছ ধরার ট্রলারে চড়ে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল বহির্দেশে তা আশির দশকে পর্যন্ত চলমান ছিল। তিনি ঢাকায় পরে থিতু হয়েছিলেন তিনি অনেক পুরস্কার, সম্মাননা পেয়েছেন। বার বার আজ প্রশ্ন উঠছে তার যে সম্মান যে স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল তা কি তিনি পেয়েছিলেন? বেলাল চৌধুরী জাপানে মাছ ধরার মুহূর্তে কুমীর ব্যবসার প্রস্তাব পেয়েছিলেন, ব্যবসা করা হয়নি। এ কাহিনী সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে বর্ণিত আছে। পেরেক ও বইয়ের ব্যবসা শুরু করেও তিনি ব্যবসায়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি আপাদমস্তক ছিলেন লেখক। বেলাল চৌধুরীর লেখক সত্তা বড় ছিল। সাপ্তাহিক সন্ধানী পত্রিকার সঙ্গে বেলাল চৌধুরী সম্পৃক্ত ছিলেন। বেলাল চৌধুরীর কবিতা স্নিগ্ধ। ব্যক্তি মানুষ, পরিপার্শ্ব আর বদলে যাওয়া নিয়ত প্রত্যাশা করে তিনি কবিতার ভূভাগ রচনা করেছেন। জীবনের কল্লোল তার কবিতায় অনুরণিত হয়। তিনি সঙ্গত কারণে আক্ষেপ করে উচ্চারণ করেছেন ‘গ্রামীণ ছবিতে আজ আর নেই সেই কিংবদন্তিখ্যাত মসলিন, নকশিকাঁথার দিন। (আত্মপ্রতিকৃতি) একই কবিতায় পরিবর্তনে ছোঁয়া দেখে তিনি হতাশাও প্রকাশ করেছেন। গ্রামীণ সম্পদ গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ কোথায় যে উধাও হয়ে গেল। ঐশ্বর্যগুলো সেরেফ কথামালা হয়ে যাওয়া তাকে কষ্ট দিয়েছে। তিনি বিস্মৃত হন না তার পূর্বপুরুষরা কৃষি কর্মী ছিলেন। সখেদে তিনি বলেন, ‘আধুনিক আত্মপ্রতারণায় নগরবাসী আমি আর কতকাল এমন করে নিজেকে নিজের চোখ ঠাওরাবো।’ ছয় দশকে বাংলা কবিতায় ভুবনে কবি বেলাল চৌধুরীর আবির্ভাব। তার সহযাত্রী কবিদের সঙ্গে তার অবিরাম পথচলা ছিল অর্থময়। আড্ডা থেকে তিনি কবিতার উপকরণ পেয়েছেন। উপমা উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারে তার নিজস্বতা অনায়াসে চিহ্নিত করা যা। ঐতিহ্য, স্বদেশ ও মেহনতী মানুষের যাপিত জীবন তার কবিতার মূল উপজীব্য ছিল। স্বদেশে তিনি ব্যাপ্ত ছিলেন রৌদ্র ছায়ায়। ভাটিয়ালি গান উদাসী বাউলের কণ্ঠে যেভাবে গীত হয় সেভাবে ধানের দুধে, আঁচল ছোঁয়া নীলাম্বরী মেঘে কবি ছিলেন। বেলাল চৌধুরী ৮০ বছর বয়সে লোকান্তরিত হয়েছেন। বিখ্যাত দৈনিকগুলোর সাহিত্য সাময়িকী পাতা সম্পাদনায় তার নেপথ্য ভূমিকা ছিল। তরুণ কবিদের কবিতা তিনি আগ্রহের সঙ্গে পড়তেন। বিষয় বৈভবে ঋদ্ধ কবিতা তাকে মুগ্ধ করত। শুদ্ধ কবিতা রচনায় বেলাল চৌধুরী নিবেদিত ছিলেন। বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে অনেক বিকাল আড্ডায় গড়িয়ে গেছে। কথা হয়েছে অনেকবার ফোনে। বেলাল চৌধুরী ভ্রমণ পছন্দ করতেন। গ্রাম গঞ্জ, শহর, নগর, দেশ-বিদেশ কত জনপদে ঘুরেছেন তার ইয়ত্তা নেই। শেষ কয়েক বছরে অসুস্থতার জন্য তাকে ঘরবন্দী হয়ে পড়তে হয়। লেখকরা তার কাছে ছুটে গিয়েছে। তিনি পড়ুয়া লেখক ছিলেন। বিশাল বই তার সংগ্রহে ছিল। বইয়ের দোকান ও ফুটপাথ ঘুরে তিনি বই কিনতেন। উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন অনেক বই। এই পৃথিবীর রৌদ্রছায়া, সবুজ প্রকৃতি, প্রাণ খোলা আপন মানুষ ছেড়ে কবি বেলাল চৌধুরী ২৪ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখ মৃত্যুবরণ করেছেন। বিশুদ্ধ সাহিত্য নিয়ে তার সঙ্গে আড্ডা দেয়া আর হবে না। পুরানা পল্টন, প্রেস ক্লাব, শাহবাগ, টিএসসি কিংবা অন্য কোথাও হৈ হৈ হাসি, কথার তুবড়ি ফোটানো, শিল্প সাহিত্যের দশ দিক নিয়ে আলোচনায় তিনি আর মধ্যমণি হবেন না। অনন্তলোকে তার যাত্রা থেকে কেউ আর তাকে ফেরাতে পারবে না। হায় জীবন! কত ছোট তুমি। শেষ বয়সে তিনি রোগ ব্যাধির কাছে পর্যুদস্ত ছিলেন। তারুণ্যের সহচর বেলাল চৌধুরী জীবনযাপন ও কবিতা নির্মাণে ছিলেন দক্ষ এক জাদুকর। শব্দ নির্বাচন, বাক্য নির্মাণ ও উপমা উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারে অতুলনীয় এক নির্মাতাকে বাংলা কবিতার পাঠক আজ হারিয়েছে। পত্রপত্রিকায় তার অসংখ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। সমগ্র রচনা গ্রন্থবদ্ধ হওয়া জরুরী। বেলাল চৌধুরী স্মরণে, স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
×