ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বাংলা সনের উৎপত্তি ইসলামী উৎস থেকে

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ২৪ এপ্রিল ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বাংলা সনের উৎপত্তি ইসলামী উৎস থেকে

(গত শুক্রবারের পর) হিজরী সনের এই সৌররূপ নতুন সনের সঙ্গে হিজরী সনের আরবি মাসগুলোর স্থলে যে যে অঞ্চলে এ সন গেল সে সে অঞ্চলে প্রচলিত মাস তাতে সংযোজিত হয়। এক তথ্য হতে জানা যায়, হিজরী সনের প্রথম মাস মহররমকে প্রথম মাস ঠিক রেখেই যে অঞ্চলে এই নতুন সন গেল সেই অঞ্চলে মহররমে যে মাস ছিল সেই মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়। এই নতুন সন প্রবর্তনের বছরেই আকবর কর্তৃক গঠিত বাংলা প্রদেশ বা সুবা বাংলায় তা চলে আসে। তখন এখানে মহররমে ছিল বৈশাখ মাস। তাই এখানে নতুন সনের প্রথম মাস হিসেবে স্থির করা হয় বৈশাখকেই। এই বৈশাখ মাস হচ্ছে শকাব্দের দ্বিতীয় মাস। শকাব্দের নববর্ষ আসে চৈত্র মাসে, আর সেই চৈত্র মাস হয় নতুন সনের দ্বাদশ মাস। এই নতুন সন বাংলাদেশে এসে বাংলা সন নামে অভিহিত হয়। এই বাংলা সনের সঙ্গে শকাব্দের যে মাসগুলো সংযুক্ত করা হয় তার অধিকাংশেরই নামকরণ হয়েছে কোন না কোন নক্ষত্রের নামে। যেমন- বিশাখা নক্ষত্রের নামে হয়েছে বৈশাখ মাস, জ্যৈষ্ঠ নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ মাস, আষাঢ়া নক্ষত্রের নামে আষাঢ় মাস, শ্রবণা নক্ষত্রের নামে শ্রাবণ মাস, ভাদ্রপদা নক্ষত্রের নামে ভাদ্র মাস, অশ্বিনী নক্ষত্রের নামে আশ্বিন মাস, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামে কার্তিক মাস, পুষ্যা নক্ষত্রের নামে পৌষ মাস, মঘা নক্ষত্রের নামে মাঘ মাস, ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামে ফাল্গুন মাস, চিত্রা নক্ষত্রের নামে চৈত্র মাস। উল্লেখ্য, বাংলা সনের অষ্টম মাস অগ্রহায়ণের নামকরণ কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। বাংলা সনের উৎপত্তি ইসলামী উৎস থেকে। এ যে হিজরী সনেরই সৌররূপ এবং মুঘল স¤্রাট আকবরের নির্দেশে আমির ফতেহুল্লাহ সিরাজী কর্তৃক হিজরী সনকে সৌর গণনায় এনে একটি নতুন সনে পরিণত করা হয়, সে সম্পর্কে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সভাপতি করে গঠিত বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার উপসংঘের সুপারিশমালার প্রারম্ভে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। এই কমিটির সুপারিশমালার প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছে যে, মুঘল আমলে বাদশা আকবরের সময় হিজরী সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে যে বঙ্গাব্দ প্রচলিত করা হয়েছিল তা থেকে বছর গণনা করতে হবে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত উক্ত কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকার কিছু কিছু সংস্কার করা হয়। বাংলা সনের মাসগুলো যাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক দিবসের হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়, তা ভেবে বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ থেকে বাংলা সনের পঞ্চম মাস ভাদ্র পর্যন্ত প্রত্যেক মাস ৩১ দিনে হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং একইভাবে ষষ্ঠ মাস আশ্বিন থেকে দ্বাদশ মাস চৈত্র পর্যন্ত প্রত্যেক মাস ৩০ দিনে হওয়ার কথা বলা হয়। লিপইয়ার বা অতিবর্ষ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, অতিবর্ষ বা লিপইয়ারের চৈত্র মাস ৩১ দিনে হবে। আরও বলা হয় যে, ৪ দ্বারা যে সাল বিভাজ্য তা অতিবর্ষ বা লিপইয়ার বলে গণ্য হবে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকে সংস্কারকৃত বাংলা সন আশির দশকে এসে সরকারী উদ্যোগে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে। বাংলা সনের উদ্ভাবক আমির ফতেহুল্লাহ্ সিরাজী আর এর সংস্কারক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা সন বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সন। এর উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাস ইসলামী উত্তরাধিকার সঞ্জাত। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের ঐতিহ্যগত অনুভব। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান প্রচলিত সর্বপ্রাচীন সন হচ্ছে হিজরী আর এই হিজরী সন থেকেই বিকশিত হয়েছে বাংলা সন, বহু পরে এখানে ইংরেজী সন বা খ্রিস্টাব্দ প্রচলিত হয়েছে। হালখাতা, খাজনা আদায়, ফসল তোলা, ফসল বোনা, বিয়েশাদি ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্র বাংলা সনের হিসাব এখনো এখানে রয়েছে। বাংলাদেশে বহু ধর্মসভা, ইসলামী জলসা, ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল, উরস মোবারক বাংলা সনের নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। হিজরী সনের সঙ্গে যেমন বাংলা সনের সম্পর্ক সুনিবিড়, তেমনি এই দুটি সনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষেরও সম্পর্ক সুনিবিড়। (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×