ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘শিবরাত্রির শেষ সলিতা’

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ২৪ এপ্রিল ২০২০

‘শিবরাত্রির শেষ সলিতা’

বন্ধু তোয়াব খানকে আমি দুটি নামে অভিহিত করে থাকি। এক, পঞ্চাশের শেষ সাংবাদিক নক্ষত্র। দুই, দেশের শেষ সম্পাদক ইনস্টিটিউশন। আজ ২৪ এপ্রিল তার ৮৭তম জন্মদিবস। এই উপলক্ষে তাকে শুভেচ্ছা জানাই। তার আরও দীর্ঘ জীবন কামনা করি। বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদক- যেমন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম কেউ দীর্ঘজীবন পাননি। মানিক মিয়া তো মধ্য বয়সেই মারা গেছেন। তোয়াব খান তাদের মতো অথবা তাদের কালের সম্পাদক নন, কিন্তু তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকের যে চরিত্র ছিল, সেই চরিত্রের শেষ প্রতিনিধি। অর্থাৎ শিবরাত্রির শেষ সলিতা। তাই আমার প্রার্থনা, প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকের এই শেষ প্রতিনিধি আরও দীর্ঘ এবং দীর্ঘকাল আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকুন। নইলে আমাদের দেশ, জাতি, সাংবাদিকতার ক্ষতি হবে। জীব জগতে অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব অতীতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন, করোনাভাইরাসের প্রকোপে এখন মানব জাতি ও মানব সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা অনেক কিছু লাভ করেছি, কিন্তু হারিয়েছি একটি স্বাধীন এবং আত্মমর্যাদা সচেতন সম্পাদক শ্রেণী। সংবাদপত্র যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চতুর্থ রাষ্ট্র হয়, তাহলে এই সম্পাদক শ্রেণী এই চতুর্থ রাষ্ট্রের কর্ণধার। অনেক দেশেই এই সম্পাদক শ্রেণী সাধারণ মানুষের অভাব অভিযোগের ও অধিকারের কথা বলা এবং এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেন। শাসকদের অত্যাচার, জেল-জুলুম সহ্য করেন। পার্লামেন্টের অনুপস্থিতি বা অকার্যকারিতার সময় সংবাদপত্রই হয় জনগণের পার্লামেন্ট এবং সম্পাদকরা হন তার পরিচালক। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সংগ্রাম এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অনেক সম্পাদক আপোসহীন ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, কেউ কেউ আত্মাহুতি দিয়েছেন। তারা সংবাদপত্র সম্পাদনাকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন, ব্রিটিশ আমলে স্বাধীন ও আত্মমর্যাদা সচেতন একটি সম্পাদক শ্রেণী কলকাতায় গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য নাম ছিল সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, প্রফুল্ল কুমার সরকার, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ লাহিড়ী, মওলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ। পাকিস্তান আমলে এই প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকদের মধ্যে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আব্দুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরীর নাম আগেই উল্লেখ করেছি। আরও দুটি নাম তাদের সঙ্গে যোগ করা যায়Ñ কাজী মোহাম্মদ ইদরিস এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীন। তারা সকলেই প্রয়াত। তোয়াব খান বয়সে তাদের জুনিয়র। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদেরই উত্তরসূরি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি বাম গণতান্ত্রিক চেতনার অধিকারী। পাকিস্তান আমলে সাংবাদিকতা শুরু করেন দৈনিক সংবাদে পঞ্চাশের দশকে। সংবাদ তখন মুসলিম লীগের মালিকানা মুক্ত হয়ে বাম গণতান্ত্রিক রাজনীতির মুখপত্র। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পরিবর্তিত নামে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার সম্পাদনা পরিষদে যোগ দেন এবং শেষ পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পত্রিকাটি সরকারী ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হলেও তোয়াব খান তাতে স্বাধীন সাংবাদিকতার যে ধারাটি ধরে রাখেন, তাতে দৈনিক বাংলা প্রচার বহুল পাঠকপ্রিয় পত্রিকায় পরিণত হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তিনি সম্পাদক পদ থেকে অপসারিত হন। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি খবর তৎকালীন সরকারের পছন্দসই ছিল না। এরপর তার জীবনের সবচাইতে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, তিনি জাতির জনক এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি ও গণসংযোগ অফিসার পদে নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধু তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর বেশ কিছুকাল পর তিনি আবার দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকার তাকে সহ্য করতে পারেননি। তাকে সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। বাংলা সংবাদপত্র জগতে ‘দৈনিক জনকণ্ঠের’ আবির্ভাব আকস্মিক ঝড়ের মতো। ঢাকাসহ দেশের চারটি স্থান থেকে পত্রিকাটি একযোগে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতে শুরু করে। পত্রিকাটির স্বাধীন মতামত একে বিপুলভাবে জনপ্রিয় করে তোলে। তোয়াব খান জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক নিযুক্ত হন। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ফিরে এসে জনকণ্ঠের স্বাধীন মতামত সহ্য করতে পারেনি। তারা এক তুচ্ছ কারণ দর্শিয়ে পত্রিকাটির সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ খান মাসুদ, উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান, নির্বাহী সম্পাদক বোরহান আহমেদ (প্রয়াত)সহ পত্রিকায় আরও কয়েকজন স্টাফকে গ্রেফতার করে। বিএনপি সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল কাগজটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য। জনকণ্ঠে সরকারী বিজ্ঞাপন দান তো বন্ধ করা হয়ই, সেই সঙ্গে বেসরকারী বিজ্ঞাপনও বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। পত্রিকাটি যে এত ঝড় ঝাপ্টা সহ্য করে এখনও টিকে আছে, তার কারণ পত্রিকাটির স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং সংবাদ ও মতপ্রকাশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আকড়ে থাকা। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাচীনকালের ডাইনোসোরাসের মতো স্বাধীন সম্পাদক প্রজাতিরও বিলুপ্ত হওয়া শুরু হয়। পত্রিকার মালিকানা চলে যায় রাজনীতিকদের বদলে ব্যবসায়ীদের হাতে। মালিকরাই পেশাদার সম্পাদকের বদলে নিজেরাই সম্পাদক পদ দখল করেন অথবা একটি পোষা সম্পাদক শ্রেণী তৈরি করেন। এই সম্পাদনার কাজটি আজ কোথায় নেমে গেছে! তার প্রমাণ, নিজেদের পত্রিকায় একটি কার্টুন ছাপার পর সম্পাদকের বায়তুল মোকাররমে ছুটে গিয়ে খতিবের পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাওয়া ও তওবা সম্পাদক নামে পরিচিত হওয়া এবং একই গ্রুপের অন্য একটি পত্রিকার সম্পাদকের স্বীকার করা, তিনি এক-এগারোর সময় সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা সংবাদ ছেপেছিলেন। এই অসত্যকে কণ্টকিত ও কলুষিত সাংবাদিকতার যুগে তোয়াব খান অবশ্যই একজন প্রকৃত সম্পাদক এবং সম্ভবত দেশের শেষ সম্পাদক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকুক এবং আরও আরও দীর্ঘজীবন লাভ করুক, এটা তার ৮৭তম জন্মদিবসে আমার একান্ত প্রার্থনা। জয়তু তোয়াব খান। লন্ডন ২৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, ২০২০
×