ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

আর্থিক প্রণোদনা বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ২৪ এপ্রিল ২০২০

আর্থিক প্রণোদনা বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ

শতাব্দীর কঠিন চ্যালেঞ্জসমূহ আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে বর্তমানে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কিংবা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পূর্ব পুরুষরা কিংবা আমাদের পূর্বতন প্রজন্ম সরাসরি শত্রুর মোকাবেলা কিংবা অভিসন্ধি বুঝতে সক্ষম ছিলেন। আজ এক অচেনা শত্রুর বিপক্ষে আমরা লড়ে চলেছি। যারা সামনে থেকে নিরন্তর মানুষকে ঘরে রাখতে চেষ্টা করছেন, ত্রাণসেবা বাসার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছেন কিংবা যারা কষ্ট করে সামনের সারিতে থেকে রোগীদের সহায়তা ও পরিচর্যা করছেন তারাই হচ্ছেন কোভিড-১৯ যুদ্ধের বীর সেনানী। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থ অর্থেই ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার পাঁচটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। যারা প্রথম সারিতে থেকে কোভিড-১৯-এ মানুষের জন্য কাজ করছেন তাদের জন্য ৭৫০ কোটি টাকার বীমার ঘোষণা দিয়েছেন। সেটিও অত্যন্ত মানবিক এবং যৌক্তিক। প্রত্যেক মানুষেরই পরিবার-পরিজন রয়েছে। তাদের বিষয়টি মানবতার সঙ্গে বিবেচনা করাই এ ঘোষণার অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন অর্থনীতির জন্য তিনটি ভাগে পরিকল্পনা করা দরকার : স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ভূমিহীন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে আরম্ভ করে কর্মহীন, বেকার সবাইকে প্রণোদনা প্যাকেজে অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ ত্রাণসামগ্রী মেরে দিয়ে পরিবেশ ঘোলাটে করতে সচেষ্ট রয়েছে। এমনকি সরকারের মন্ত্রণালয় থেকে টাকা নিয়েও সেটি করতে সচেষ্ট রয়েছে। সরকারের মন্ত্রণালয় থেকে টাকা নিয়ে সেটি অফিসিয়ালি জমা রেখেছে একটি জেলায়। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের দেয়নি বলে ক’দিন আগে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় সংবাদের ভিডিওতে দেখানো হয়েছে- যেখানে মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, যারা ত্রাণের অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের বক্তব্যে উঠে এসেছে। আসলে এখন এমন এক পরিবেশে আমাদের অবস্থান যেখানে সরাসরি জটিলতামুক্তভাবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করা কঠিন। আর যারা ত্রাণ চুরি করছে তারা কেন, কি উদ্দেশ্যে করছে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে করছে কি না কিংবা যারা বলছে যে, তারা ঢাকা জেলায় থেকে বুঝতে পারেনি সরকারের ত্রাণের টাকা কিভাবে দেবেন- খাঁটি বাংলায় বলি পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করছে কিনা সেটি যাচাই-বাছাই করে একমাত্র গোয়েন্দা বাহিনীই বের করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর ৩১টি পদক্ষেপ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবায়নযোগ্য। তবে সুযোগসন্ধানীরা বসে নেই। তারাও অর্থ বানাতে ব্যস্ত। স্বল্পমেয়াদে যাতে কৃষিপণ্য সুন্দরভাবে সর্বত্র বিতরণ করা যায় সেটির উদ্যোগ সমন্বিতভাবে তৃণমূল পর্যায়ের এমপি, স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি পুলিশ বাহিনী ও সেনা সদস্যদের প্রয়োজনে সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। এদিকে রমজান আসার পূর্বেই দেশের যারা যাকাত প্রদান করে থাকেন তারা প্রধানমন্ত্রীর যাকাত ফান্ডে অর্থ জমা দিয়ে প্রণোদনা কাজে সহায়তা করতে পারেন। সকল উন্নয়নের মেগা প্রকল্পগুলো আগামী দুই বছরের জন্য স্থগিত রেখে সরকারী কার্যক্রমে কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে হতে পারে। ঈদ এবং রমজান মাসে কেনাকাটায় কৃচ্ছ্রতা সাধন করে অভাবী মানুষকে সহায়তা দেয়ার ভাবনাও ভাবতে হবে। ধনিক শ্রেণীর সীমিত ত্রাণ দেয়া দেখলে লজ্জা লাগে। বর্তমানে ধান কাটার মৌসুম। ধান যাতে সুন্দরভাবে কাটা যায় সেজন্য স্থানীয় পর্যায়ে কৃষকরা স্থানীয় ছেলেমেয়ে যারা পোশাক কারখানায় কাজ করে এবং শিক্ষার্থী তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ধান কাটতে কাজে লাগাতে হবে। প্রায় ৩৯.০৭% লোক এখনও কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত। এখন যদি স্থানীয় পর্যায়ে ধান কাটার পরপরই আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে, যাতে বিভিন্ন ধরনের ডাল, তরিকরকারি লাগাতে পারে। সেজন্য স্থানীয় কৃষি অধিদফতর কর্তৃক কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ, সার, লাগসই প্রযুক্তি সহায়তা দিতে হবে। পোল্ট্রি শিল্পে সরবরাহজনিত সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে মুরগি লালন-পালন, টার্কি হাঁস যাতে অধিক হারে উৎপাদন করা যেতে পারে এবং শহরে প্যাকেটজাত করে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে যে সমস্ত ভেটিরিনারি চিকিৎসক আছেন তারা সাধারণ খামারিদের পাশে দাঁড়িয়ে যেন সহায়তা করেন। এদিকে করোনার কারণে দুগ্ধ খামারিরা কষ্টে পড়েছেন। সে জন্য দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করে পাউডার দুধ, বাটার, ঘি, ক্রিমসহ সবকিছু উৎপাদনের ব্যবস্থা স্থানীয় পর্যায়ে করতে হবে। এক্ষেত্রে খামারিদের থেকে ন্যায্যমূল্যে দুধ ক্রয় করে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে উদ্ভাবন ও প্রক্রিয়াজাত করার জন্য সোশ্যাল ওয়ার্কাররা কাজ করে যেতে পারেন। ইতোপূর্বে বহুবার বলেছি, আমাদের দেশে গবাদিপশুর লালন-পালনের খরচ কম। গবাদিপশুর লালন-পালনের খরচ আরও কমানোর জন্য যারা গবাদিপশু পালন করে থাকে তারা কিন্তু গায়ে মাখেনি। এখন এ দুর্যোগে মাথা ঠা-া করে ভেবে দেখতে হবে কেমন করে গবাদিপশুর লালন-পালনের খরচ কমানো যায়। মৎস্য চাষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাময়িকভাবে হোক, বর্তমানে যারা প্রচ্ছন্ন বেকার রয়েছে সেখানে স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের ধী শক্তি ও মেধা দিয়ে স্বল্পকালীন অর্থনীতিতে কাজ করানো যেতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। কোন্ ধরনের পণ্য চাষাবাদ করা যায় তার জন্য কৃষি অধিদফতরকে মৎস্য, পশু, মুরগি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ডিজিটাল উপায়ে বাংলাদেশের ৬৮ হাজার ৩৮টি গ্রাম (১৯৯১ সালের সেনশাস অনুসারে) এবং ২৩২টি হাউসহোল্ড আছে, সেখানে কি কি ধরনের পণ্য উৎপাদন এবং লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার করা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অভাবীদের স্বল্প সময়ে ঘরে ঘরে প্রয়োজন অনুসারে ত্রাণ পৌঁছে দিতে হবে। পাশাপাশি উৎপাদন ব্যবস্থাও অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে যারা কাজ করতে ইচ্ছুক তাদের কর্মে নিয়োগ করতে হবে। এ ধরনের অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়তে প্রয়োজন হচ্ছে মানসিক বল, পেটের ক্ষুধা নিবারণ করা। চা উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যে প্যাকেজগুলো দিয়েছেন সেগুলো জনকল্যাণ প্রত্যাশায় করেছেন। আমাদের প্রত্যেকেরই স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে কাজ করতে হবে। যেমন, বাড়তি দুধ থাকলে অভুক্ত মানুষের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা যারা শিক্ষার আলো পেয়েছি আসলে দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই তা পেয়েছি। এ জন্য আজকের এ চরম দুর্যোগকালীন সময়ে জাতির কাছে যে ঋণ আমাদের রয়েছে, সে ঋণ পরিশোধের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় এখনই। প্রত্যেকেই যেন স্থানীয় পর্যায়ে স্বাবলম্বী হই। স্বাবলম্বী ও আত্মনির্ভরশীল হতে হলে অবশ্যই স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। এতো সম্মুখ সমরই নয়, অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে লড়ান। আর তাই সরকারী নির্দেশ মেনে চলা দরকার। যারা ত্রাণের অর্থ নয়-ছয় করেন কিংবা ত্রাণের খাদ্য বিক্রি করছেন তাদের জন্য দুটি শাস্তি প্রত্যাশা করছি। (১) মৃত্যুদ- (২) জীবনে কখনও জনপ্রতিনিধি হতে না পারা। পাশাপাশি এদের ছবি টিভিসহ অনলাইনে প্রচার করা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে একটি উইং হতে পারে, যেখানে বিদেশে কোন্ কোন্ পণ্যের কি চাহিদা আছে, বিপণন ও বাজারজাতকরণ কিভাবে করা যাবে সে সম্পর্কে তথ্যাদি বিদেশে দূতাবাসসমূহ বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রেরণ করবে। সে চাহিদা অনুযায়ী বর্তমান অথবা নতুন উদ্যোক্তারা যাতে পণ্য উৎপাদনে সকল সুবিধা সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। কেননা, নতুন উদ্যোক্তারা ব্যাংকে গেলেই যে ঋণ পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। শিক্ষিত বেকারদের সার্টিফিকেট জমা রেখে ব্যাংক সহজ শর্তে পণ্য উৎপাদন করার জন্য ঋণ দিতে পারে। কেবল রফতানিমুখী শিল্পের জন্য ঋণ না দিয়ে বরং আমদানি বিকল্প শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্যও ঋণ দিতে হবে। একটি সমস্যার কথা বলতে হয়- অধিকাংশ উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদ মুখে মুখে বলেন সরকারের ব্যবসা করা কাজ নয়। অথচ যখন প্রয়োজন হয় কয়জন উদ্যোক্তা সরকারের সঙ্গে জনগণের পাশে দাঁড়ান? আজ যদি বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরে বিএডিসি এবং টিসিবি একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করত তবে একচেটিয়া মুনাফা করার মতো সুযোগসন্ধানী সমাজে থাকত না। বিএনপি-জামায়াতীরা মিলে বিএডিসি-টিসিবিকে একেবারে হাত-পা কেটে ডুবিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছে। এক্ষণে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাকাবকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, কৃষিজীবীদের সহায়তা প্রদান করা ও পণ্য উৎপাদন, বিপণন এবং বাজারজাতকরণের কাজে ঢেলে সাজাতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংককে দীর্ঘমেয়াদী শিল্প প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজন গ্রামাঞ্চলে যেখানে মানুষ অভুক্ত থাকছে, সরকারী ত্রাণের সহায়তায় লঙ্গরখানা খুলে তিন বেলা খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। অপচয় ও দুর্নীতি না করে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ত্রাণের চাল যেভাবে লুটপাট হচ্ছে তার পেছনেও বিএনপি-জামায়াতীদের অশুভ চক্র কিংবা কালোবাজারি, মজুদদার শ্রেণী কাজ করছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। আবার যারা ত্রাণ দেয়ার নাম করে ফটোসেশন করছেন, তাদেরও আর্থিক দ- হওয়া উচিত। ছাত্রলীগের অনেক কর্মীই নীরবে-নিভৃতে প্রশংসনীয় কাজ করছেন। ধানও কাটছেন। আমাদের দেশে আপদকালীন সময়ের জন্য একটি জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক দল থাকা দরকার। এজন্য সরকারদলীয় লোকদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে প্রত্যেক গ্রামে ব্রিগেড গঠন করে মানুষকে সহায়তা করার উদ্যোগ নিতে পারে। করোনাভাইরাসের সময় বেসরকারী খাতে দীর্ঘমেয়াদের কথা চিন্তা করে একটি শক্তিশালী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করা যেতে পারে। দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, রাজস্ব আদায়, মুদ্রানীতির প্রয়োজন অনুপাতে ব্যবহার এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খাতের উন্নয়নের জন্য সরকার তার অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা পিকেএসএফ, বিএনএফ, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিসহ বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। অদৃশ্য শক্তির বিপক্ষে এ যুদ্ধে মানুষের বেঁচে থাকার পাশাপাশি তার অর্থনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ঢেলে সাজতে হবে। জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর সকল পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন দরকার। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত আমলানির্ভর হওয়া ঠিক নয়। লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট এবং প্রফেসর [email protected]
×