ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আকাশে মেঘ, জমিতে ধান, ফাঁপরে কৃষক

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২২ এপ্রিল ২০২০

আকাশে মেঘ, জমিতে ধান, ফাঁপরে কৃষক

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ উত্তরাঞ্চলের কৃষকের এখন মহাফাঁপর। নিত্যদিন আকাশে মেঘ ও ভূমিতে বোরোর পাকা ধান দেখে কিনারা করতে পারছে না কিছুই। ঝড়-বাদল শুরু হলে ফসল রক্ষা করবে কি করে। মাড়াই-কাটা শুরু হলে ফসল কাটবেই বা কী করে। মজুর মিলবে কেমন করে। মজুরদের খবর দিলেই চলে আসবে। তবে আসবে কী করে! করোনার থাবায় জীবন রক্ষায় তারাও তো ঘরবন্দী। আবাদ উদ্বৃত্ত অঞ্চল উত্তরবঙ্গে বোরো আবাদই এখন প্রধান আবাদের জায়গা করে নিয়েছে। একটা সময় আমন ছিল প্রধান আবাদ। সেচ ভিত্তিক চাষ, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ভর বছর অধিক ফলনের উচ্চ ফলনশীল নানাজাত উদ্ভাবনে মোট ভূমির অন্তত ৭০ শতাংশেই বোরো আবাদ হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের (রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ) ১৬ জেলায় প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে বগুড়া, নওগাঁ, দিনাজপুর, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে। দেশে মোট বোরো আবাদের ৩৫ শতাংশই পূরণ করে উত্তরাঞ্চল। কৃষি বিভাগের আশা এবার দেশে অন্তত দুই কোটি টন বোরো চাল মিলবে। যার অন্তত ৬৫ লাখ টন মিলবে উত্তরাঞ্চল থেকে। তবে টার্গেট পূরণ হবে শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ও ধান কাটার মজুর ঠিক মতো পাওয়া গেলে। আবাদ উদ্বৃত্ত এলাকা বগুড়ার চিত্রে দেখা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে বগুড়ায় চাষের টার্গেট করা হয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬শ’ হেক্টর জমিতে। কৃষক এই টার্গেটের চেয়ে ১৫ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ করেছে। যার বেশিরভাগই উফশী এবং হাইব্রিড। আশা করা হয়েছে আবহাওয়া ঠিক থাকলে এবং সময়মতো মজুর প্রাপ্তি সাপেক্ষে উৎপাদন হবে পৌনে ৮ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। সোনাতলা উপজেলার রানীরপাড়া গ্রামের কৃষক বাসেত আলী বলেন, এখন পর্যন্ত বোরো আবাদ খুবই ভাল। যে ঝড় ও বৃষ্টি হয়েছে তাতে তেমন ক্ষতি হয়নি। বিপদ শিলা ও ঝড় বৃষ্টি নিয়ে। গৃহস্থ সোলায়মান বললেন, করোনার থাবার অনেক আগে বোরো চাষ ঠিকঠাক মতো হয়েছে। উপকরণ (বীজ সার) ও সেচ পেয়ে ফসল এগিয়ে নেয়া গেছে। বিপত্তি শুরু হয়েছে করোনার থাবায়। তিনি ১০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। দিনা কয়েক পরই ধান কাটতে হবে। আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখলে ভীত হয়ে পড়েন। আবহাওয়া খারাপ হলে আগাম ধান কাটতে হবে। তখন মজুর পাওয়া কঠিন। আর সময়মতো মাড়াই-কাটা (স্থানীয়ভাবে বলা হয় কাটামাড়ি) শুরু হলে তো এবার মজুর নিয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হবে। তার জমির ধান কাটতে অন্তত ৩৫ জন শ্রমিক দরকার। বগুড়া অঞ্চলে এখন আর তেমন মজুর নেই। বেশিরভাগই প্রান্তিক চাষী। তারাও পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া নিজেদের জমিতে চাষ করে। এলাকা ভিত্তিক যে মজুর আছে তা কতজনের ধান কাটবে! তবে অনেক গৃহস্থ আশা করে আছেন কম্বাইন্ড হারভেস্টারের। ওই মাড়াই-কাটাই কল ভাড়া করা গেলে দ্রুত ধান কাটা যাবে। এতে খরচ ও সময় দুই সাশ্রয় হবে। এইসব গৃহস্থ ও বড় কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারের খোঁজ করছেন। কৃষি বিভাগের একটি সূত্র জানায় করোনার প্রভাবে ধান মাড়াই কাটাইয়ে যেন অসুবিধা না হয় সে জন্য সরকার সাবসিডি দিয়ে কৃষকদের কম্বাইন্ড হারভেস্টার কেনার অর্থ বরাদ্দ করেছে। কৃষকের ধান কাটলেন ইউএনও এসিল্যান্ড নিজস্ব সংবাদদাতা হবিগঞ্জ থেকে জানান, বাহুবল উপজেলায় গিয়ে কৃষকের সঙ্গে ধান কাটলেন ইউএনও এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি)। দুপুরে বাহুবল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) স্নিগ্ধা তালুকদার বলেন, সরকার কৃষকের পাশে আছে। উপজেলার নতুন বাজার এলাকায় জমিতে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে ধান কেটেছি। এতে কৃষকরা উৎসাহিত হয়েছেন। এভাবে স্থানে স্থানে গিয়ে কৃষকদের উৎসাহ প্রদান করছি। কৃষকরা দ্রুত ধান কেটে বাড়ি নিয়ে মাড়াই করছেন। বাহুবল উপজেলা সহকারী কমিশনার খৃষ্টফার হিমেল রিছিল বলেন, কৃষকদের পাশে গিয়ে অত্যন্ত ভাল লেগেছে। কৃষক জমিতে গেলে ফসল উৎপাদন হবে। উৎপাদিত ফসল খেয়ে আমরা বেঁচে থাকব। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, হবিগঞ্জের হাওড়ের ধান কাটা নিশ্চিত করতে শ্রমিকদের পুল গঠন করা হয়েছে। এই মুহূর্তে জেলার পাহাড়ী এলাকা চুনারুঘাট ও বাহুবলসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেক শ্রমিক বসে আছে। আমরা তাদের নিয়ে আসছি হাওড়ে। থাকা খাওয়ারও ব্যবস্থা করেছি। শ্রমিকদের যাতায়াতে যাতে সমস্যা না হয় তার জন্য পুলিশ প্রশাসন তৎপর। হবিগঞ্জের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরের উপপরিচালক মোঃ তমিজ উদ্দিন জানান, হবিগঞ্জ জেলার হাওড়ে ৪৬ হাজার ৩৬০ হেক্টর বোরো আবাদ হয়েছে। ২০ এপ্রিল সোমবার পর্যন্ত ২৫ শতাংশ কাটা শেষ হয়েছে। পুরো জেলায় ১ লাখ ২০ হাজার ৮শ’ হেক্টর আবাদ হয়েছে। গাইবান্ধার শ্রমিক গাজীপুরে প্রেরণ নিজস্ব সংবাদদাতা গাইবান্ধা থেকে জানান, চলতি বোরো মৌসুমে গাজীপুর জেলায় কৃষি উৎপাদন সচল রাখতে উৎপাদিত ধান কাটা ও মাড়াই কাজের জন্য দ্বিতীয় দফায় জেলা পুলিশের উদ্যোগে সোমবার রাতে বিশেষ ব্যবস্থায় গাইবান্ধা থেকে কৃষি শ্রমিকের ১১ জনের একটি প্রাথমিক দল পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে গাইবান্ধার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গণউন্নয়ন কেন্দ্রের সহযোগিতায় এই কৃষি শ্রমিক পাঠানো হয়। এর আগে কৃষি শ্রমিকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় এবং করোনা পরিস্থিতি নিয়ে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়াও শ্রমিকদের মধ্যে দুটি করে উন্নতমানের মাস্ক ও হ্যান্ড ওয়াশ বিতরণ করা হয়। পরে গণউন্নয়ন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দেয়া একটি বিশেষ বাসে করে শ্রমিকরা গাজীপুর জেলায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, এর আগে প্রথম দফায় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে নাটোরের চলনবিলে ২২ জনের একটি শ্রমিকের দল পাঠানো হয়। সিরাজগঞ্জের ৬শ’ ১৯ শ্রমিক হাওড়ে স্টাফ রিপোর্টার সিরাজগঞ্জ থেকে জানান, হাওড়ে ধান কাটা কৃষি শ্রমিক সঙ্কট নিরসনে সদর উপজেলা কৃষি অফিস ধান কাটার জন্য সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের ৬শ’ ১৯ শ্রমিককে প্রত্যয়নপত্র হাতে তুলে দিয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে। মঙ্গলবার দুপুরে সদর উপজেলার কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ রোস্তুম আলী জানান, এ পর্যন্ত নেত্রকোনায় ২৭৯ জন, সুনামগঞ্জে ৮৭ জন, কিশোরগঞ্জে ৯৫ জন ও টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ১৫৮ কৃষি শ্রমিকে প্রত্যয়ন প্রদান করা হয়েছে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানো নিশ্চিত করা হয়েছে। হাওড় অঞ্চলে আগাম ধান কাটার জন্য সিরাজগঞ্জ সদর থেকে প্রত্যেক বছর কৃষি শ্রমিক যেত কিন্তু এবারে করোনার কারণে পরিবহন সঙ্কট থাকায় তা বিঘœ ঘটে। সরকারের উদ্যোগের কারণে কৃষি শ্রমিক সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটবে আশা করা যাচ্ছে। আরও বিভিন্ন অঞ্চলে ধান কাটার জন্য প্রতিদিনই প্রত্যয়ন চলমান আছে।
×