ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রহিমা খালারা এখন কর্মহীন, ত্রাণই ওদের ভরসা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২১ এপ্রিল ২০২০

রহিমা খালারা এখন কর্মহীন, ত্রাণই ওদের ভরসা

ফিরোজ মান্না ॥ করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে দেশের মানুষের জীবনের বাস্তবতা। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দেশের বেশিরভাগ মানুষ। দরিদ্র মানুষের পেটে ভাত জুটছে না। তারা এখন সরকারী বেসরকারী ত্রাণের অপেক্ষায় বসে থাকেন। ত্রাণ পেলে পেট চলে। ত্রাণ না পেলে না খেয়ে থাকতে হয়। এমন এক বাস্তবতা দেখা দিয়েছে রহিমা বেগমের জীবনে। স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। ঢাকায় এসেছিলেন অন্যের বাসায় কাজ করে জীবন ধারণ করতে। সেটাও করোনা কেড়ে নিয়েছে। ৬০ বছর বয়সী রহিমা বেগম পাড়ায় রহিমা খালা হিসাবে পরিচিত। থাকতেন পেয়ারাবাগ বস্তিতে। সকাল দুপুর আর সন্ধ্যায় তিন বাসায় কাজ করতেন। তা দিয়েই চলত তার জীবন। সেই রহিমা খালার এখন কোন কাজ নেই। কোন বাড়িতে আর তাকে কাজে নিচ্ছে না। এখন তার বাধ্য হয়ে নামতে হয়েছে ভিক্ষায়। সারাজীবন সংগ্রামী এই রহিমা খালা কোন দিন কারও কাছে হাত পাতেননি। কিন্তু আজ তাকে মানুষের কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইতে হচ্ছে। রহিমা খালার মতো লাখ লাখ রহিমা রয়েছেন যারা এখন কর্মহীন। তাদের এখন ত্রাণই ভরসা। তিন চার দিন আগে রহিমা খালার সঙ্গে কথা হলো তিনি জানালেন, তিনি গ্রামে চলে যাবেন। কিন্তু কিভাবে যাবেন সেই চিন্তা করছেন। তাকে একজন বলেছেন ট্রাকে তাকে জামালপুর শহরে নামিয়ে দেবেন। সেখান থেকে তিনি তার গ্রামে একভাবে না একভাবে যেতেই পারবেন। ঢাকায় তার এক রুমের ভাড়া দিতে হয় আড়াই হাজার টাকা। আবার খাবারের জন্যও খরচ হয় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এই ৫ হাজার টাকা জোগার করা তার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের কাছে হাত পেতে আর কয় টাকা হয়। তার চেয়ে গ্রামে তার আত্মীয় স্বজন রয়েছে-মরলে সেখানে গিয়েই মরবেন। তার সঙ্গে ওই বস্তির নাজমা নামের আরেক জন যাবেন। সোমবার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রহিমা খালা আর নাজমা বস্তির ঘর ভাড়া পরিশোধ করতে পারেননি। তাই তাদের যেতে দেয়নি বস্তির মালিক। তবে তারা সোমবার রাতেই ঘর ভাড়া পরিশোধ করে জামালপুর চলে যাবেন বলে জানালেন। ২৬ মার্চ থেকে সরকারী ছুটি ঘোষণার পর থেকে প্রায় সব বাসা থেকেই কাজের লোককে (ভুয়া) মানা করে দিয়েছে। তারপর থেকেই তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। প্রায় এক মাস সময় ধরে বেকার থাকা এই মানুষগুলোর যা কিছু সঞ্চয় ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন কেউ যদি ত্রাণ দেন সেই আশায়। তাছাড়া উপার্জন বলতে কিচ্ছু নেই। সরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও ঘরে থাকার পরামর্শ মানতে গিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় শূন্যের কোটায় গিয়ে ঠেকেছে। করোনা মোকাবেলায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা ছাড়া উপায়ও ছিল না। সারা পৃথিবী জুড়েই চলছে লকডাউন। কোন কোন দেশে জরুরী অবস্থা পর্যন্ত জারি করা হয়েছে। দেশের মানুষকে ভায়াবহ সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে দেশের অনেক জেলাই এখন লকডাইন করা হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে করোনা সংক্রমণ ততই বাড়ছে। দেশের মানুষ আরও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তাদের সামনে কি ঘোর অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। সম্প্রতি বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক এক জরিপে উল্লেখ করেছে, এমন পরিস্থিতিতে চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে ৬০ শতাংশ। বর্তমানে ১৪ ভাগ মানুষের ঘরে কোন খাবারই নেই। দেশের ৬৪ জেলায় ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ব্র্যাকের এই জরিপ চালানো এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়। করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্যগত দিকগুলো সম্পর্কে নিম্ন আয়ের মানুষের উপলব্ধি ও অর্থনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে ধারণা পেতে এই জরিপ চালায় ব্র্যাক। কি কি ব্যবস্থা অবলম্বনের মাধ্যমে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করা সম্ভব সে বিষয়েও ৩৬ শতাংশ উত্তরদাতার পরিষ্কার ধারণা নেই। এমন কি করোনা সংক্রমণের লক্ষণ (জ্বর কাশি শ্বাসকষ্ট) দেখা দিলে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরাসরি চলে না আসার যে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে সে বিষয়েও ধারণা নেই অধিকাংশের। জরিপের ফলাফল তুলে দিয়ে বলা হয়, শতকরা ৫৩ জন উত্তরদাতা বলেছেন প্রতিবেশীর এসব লক্ষণ দেখা দিলে তাকে শহরের হাসপাতাল বা সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেবেন। মাত্র ২৯ শতাংশ হেল্পলাইনে ফোন করার কথা বলেছেন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের পদক্ষেপের ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ জীবিকার দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জরিপের ফলাফল থেকে বেরিয়ে আসে। ফলে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৯ শতাংশ চরম দরিদ্রে পরিণত হয়েছেন। তারা দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে নেমে গেছেন। করোনাভাইরাসের আগে আয়ের ভিত্তিতে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৪ শতাংশ ছিলেন দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে এবং ৩৫ শতাংশ ছিলেন দারিদ্র্যরেখার উর্ধসীমার নিচে। এতে বোঝা যায় চরমদারিদ্র্য আগের তুলনায় বর্তমানে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা মহামারীর আগে জরিপে অংশ নেয়া ২ হাজার ৬৭৫ জনের গড় আয় ছিল ১৪ হাজার ৫৯৯ টাকা। যাদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ জানিয়েছে এই করোনা প্রাদুর্ভাবের পর তাদের আয় কমেছে। মার্চ মাসে তাদের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৪২ টাকায়, অর্থাৎ তাদের পারিবারিক আয় ৭৫ শতাংশের মতো কমে এসেছে। চট্টগ্রাম (৮৪ শতাংশ), রংপুর (৮১ শতাংশ) এবং সিলেট বিভাগের (৮০ শতাংশ) মানুষের আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি। সরকারী ছুটি বা সামাজিক দূরত্বের কারণে ৭২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তাদের কাজ কমে গেছে বলে জরিপের ফলাফলে বেরিয়ে আসে। ৮ শতাংশ মানুষের কাজ থাকলেও এখনও বেতন পাননি।
×