ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা

কৃষকের দুর্দিনে ছাত্রলীগ, ধান কেটে ঘরে তুলে দিচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২১ এপ্রিল ২০২০

কৃষকের দুর্দিনে ছাত্রলীগ, ধান কেটে ঘরে তুলে দিচ্ছে

ওয়াজেদ হীরা ॥ ‘মানুষের পাশে সবাই দাঁড়ায় না, দাঁড়াতেও পারেনা, এটাই ছাত্রলীগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, বিপদে সবার আগে সবার পাশে রাত দিন আছি আমরা।’ ছাত্রলীগের এক কর্মীর ফেসবুকে দেয়া আবেগের পোস্ট এটি। আবেগের কারণ সবাই যেখানে করোনা আতঙ্কে ঘরবন্দী সেখানে কাঠ ফাটা রোদে স্বেচ্ছায় বিনা পারিশ্রমিকে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শ্রমিকবেশে কাজ করছেন মাঠে, কাস্তে হাতে কাটছেন ধান, মাথায় বয়ে নিয়ে তুলে দিচ্ছেন কৃষকের ঘরে ঘরে। আর শ্রমিক সঙ্কটে কৃষকের এমন দিনে ছাত্রলীগের পাশে দাঁড়ানোয় দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশিষ্টজন ও সাধারণ মানুষ প্রশংসাও করছেন। কৃষি ও সংশ্লিষ্টরা ছাত্রলীগের প্রশংসা করে অন্য রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণীপেশাসহ সাধারণ মানুষেরও এমনভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করছেন। কেননা, কৃষক সঠিক সময়ে ধান ঘরে না উঠালে আগামী দিনে যদি কোন খাদ্যসঙ্কট হয় তার ফল সবাইকেই ভোগ করতে হবে। তাই কৃষকের পাশে ছাত্রলীগের মতো সবাইকে দাঁড়ানোর কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষকের কষ্টের সোনার ফসল ধান পাকতে শুরু করেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে অঘোষিত লকডাউনের মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সঙ্কটও। তাই পাকা ধান ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ঘরে উঠাতে পারছেন না কৃষক। আর তাই দেশের এমন পরিস্থিতিতে পাশে দাঁড়ান ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, অনেক জায়গায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। সমতলের চেয়ে হাওড় এলাকায় ধান আগে কাটা শুরু হয়। কেননা হাওড়ে পানি চলে আসলে অধিকাংশ ফসল পানির নিচে তলিয়ে যায়। তবে সমতলের জমিতেও আগাম ধান কাটা শুরু হয়েছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই সারাদেশে ধান কাটার ধুম লেগে যাবে। আর এই মাসেই উঠে যাবে হাওড়ের ধান। দেশের খাদ্যের বড় জোগান দেয় এই বোরো। অথচ এই সময়ে এসে প্রতিবারই শ্রমিক সঙ্কট দেখা দেয় পাশাপাশি শ্রমিকের উচ্চমূল্য থাকে। গতবছরও কৃষক যখন ধান কাটতে পারছিল না তখনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে সবার আগে এগিয়ে আসে এই বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন। এবার দেশে সাধারণ ছুটি আর জেলায় জেলায় লকডাউনের কারণে শ্রমিক সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। যদিও কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন জেলার শ্রমিক আনার বিষয়ে কাজ করছে। দেশের এমন পরিস্থিতিতে কৃষকের পাশে দাঁড়ায় ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের বিভিন্ন ইউনিটকে কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেন। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ছাত্রলীগ সদস্যরা কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন। এসব ছবি, খবর গণমাধ্যম সামাজিক মাধ্যমে বেশ প্রশংসাও পাচ্ছে। অন্যদেরও এগিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে। এদিকে, গত কয়েক দিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বার বার কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সকালে ছাত্রলীগের ধান কেটে দেয়ার প্রসংশা করেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমার ছাত্রলীগের ছেলেরা করোনা দুর্যোগে এগিয়ে এসেছে। তারা কৃষকের ধান কেটে সহযোগিতা করছে। নিজেরা ফর্মুলা নিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়েছে এবং বিতরণ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নিজেরাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে বিতরণ করছে। বাড়ি বাড়ি খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছে। এ জন্য ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ। অন্য সংগঠনকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ছাত্রলীগের পাশাপাশি কৃষক লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়াও সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে সারাদেশে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এখন ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়েছে, দিনমজুর যারা এখন কাজ পাচ্ছেন না তাদের জন্য এটা একটা সুযোগ। তারা এখন ধান কাটতে যেতে পারেন। কেবল দিনমজুর নয় সকলেরই যাওয়া উচিত। এখানে কেবল উঁচু-নিচু নয়, কাজ করা সকলের দায়িত্ব। যেসব এলাকায় ধান কাটার শ্রমিকের সঙ্কট আছে সেসব এলাকার ছাত্র-শিক্ষক সকলকে এ কাজে নেমে পড়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় জনকণ্ঠকে বলেন, ছাত্রলীগ অতীতে দেশের যে কোন সঙ্কটে মানুষের পাশে ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে। দেশরতœ শেখ হাসিনার ভ্যানগার্ড ছাত্রলীগ শেখ হাসিনার নির্দেশে সব সময় মানুষের বিপদে আপদে থাকবে। কৃষকের ধান কেটে দেয়া তারই একটি অংশ। আমরা আমাদের সকল ইউনিটকে শ্রমিক সঙ্কটের এমন পরিস্থিতিতে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে বলেছি। বিভিন্ন জায়গায় যেখানে ধান কাটা শুরু হয়েছে সেখানে আমাদের নেতাকর্মীরা কৃষকদের সহায়তা করছেন। স্বেচ্ছাশ্রমে ধান কেটে ঘরে তুলে দিচ্ছেন। আগামী দিনগুলোতেও পুরোদমে ধান কাটার সময়েও আমাদের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করবে। এছাড়াও করোনায় আমাদের অন্য কার্যক্রমও চলছে। সম্প্রতি কক্সবাজার ছাত্রলীগের ধান কেটে দেয়ার একটি ছবি ফেসবুকের নিজস্ব পেজে প্রকাশ করেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। সেখানে ছাত্রলীগের এমন দৃশ্য দেখে অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রশংসা করেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, সমাজকর্মী ছাত্রলীগের অন্য ইউনিটের কর্মীদেরও এই ধরনের ধান কাটা, মাথায় ধানের আঁটি নিয়ে চলার ছবির প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ লিখেছেন, ‘সবাই যখন ভয়ে ঘরবন্দী তখন ছাত্রলীগ নামক ছেলেরা কৃষকদের সহায়তা করতে ভয় ভেঙ্গে মাঠে ছুটে।’ আবির রহমান লিখেছেন ছাত্রলীগের সমালোচনা অবশ্যই করবেন, ভাল কাজগুলো দেখবেন। অনিতা নামের একজন লিখেছেন ‘কখনও কৃষক, কখনও শ্রমিক, কখনও নার্সের সেবা কখনও আমরাই রাত জেগে খুঁজি কেউ কষ্টে ক্ষুধার কষ্টে আছে কিনা আমি গর্বিত আমি ছাত্রলীগের কর্মী।’ রবিবার দিনভর ময়মনসিংহের সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের কাতলাসেন এলাকায় দুই কৃষকের ১০ কাঠা জমির ধান কেটে দেন ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মী। ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগ নেতা তানভীর জুবায়ের ইসলাম তারিনের নেতৃত্বে ৩০ নেতাকর্মী ধান কাটার এ কাজে অংশ নেন। ধান ােটা শেষে নেতাকর্মীরা কাতলাসেন এলাকার চরপাড়া থেকে আরও এক কিলোমিটার দূরে কৃষক চানু মুন্সী ও আব্দুর রহমানের বাড়িতে তা পৌঁছে দেন। কৃষক চানু মুন্সী ও আব্দুর রহমান বলেন, শ্রমিক সঙ্কটের কারণে পাকা ধান কাটতে পারছিলাম না। এ কারণে জমিতে নষ্ট হচ্ছিল পাকা ধান। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যেভাবে ধান কাটায় সাহায্য করেছে, তা কখনও ভোলার নয়। গত শনিবার কক্সবাজারে ছাত্রলীগের ৩০ নেতাকর্মী দিনভর কেটে দিয়েছেন কৃষক হাফেজ আহমদের দেড় কানি (৬০ শতক) জমির পাকা ধান। কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের উপ দফতর সম্পাদক এবং কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রলীগ সভাপতি মঈন উদ্দিন ঘটনা জেনেছিলেন ছাত্রলীগ নেতা অনিকের কাছে থেকে। মঈন বলেন, বিষয়টি আমরা আগের দিনই জানিয়ে রেখেছিলাম পুলিশ সুপারকে। পুলিশের অনুমতি নিয়ে ও মাঠে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই ধান কাটার কাজটি সেরেছি। দরিদ্র কৃষক হাফেজ ৩০ ছাত্রকে দুপুরের খাবার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু তারা রাজি হননি। একই গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা জামসেদের মায়ের রান্না করা ডাল ও আলু ভর্তা খেয়েই তারা দিনভর কাজ করেছেন। ধানখেতের আইলে বসেই তারা খাওয়া দাওয়া করেন। এছাড়াও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জেও ছাত্রলীগ কৃষকদের ধান কেটে দেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যান্য এলাকায় ধান কাটা শুরু হলে ছাত্রলীগ কাজ করবে বলেও জানা গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত ৪৭ লাখ ৫৫ হাজার হয়েছে। তবে মাঠের যে ফলন সে হিসেবে আমাদের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনেক ছাড়িয়ে যাবে আশা করছেন কর্মকর্তারা। একাধিক কৃষি কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশের বিভিন্ন দুর্যোগে ছাত্রসংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বেশ ভাল ভূমিকা রাখে, এটি সবারই দায়িত্ব। এক কর্মকর্তা বলেন, গতবার যখন শ্রমিকের উচ্চ মূল্যে আর সঙ্কটের কারণে কৃষক ধানখেতে আগুন দেয় তখনও ছাত্রলীগসহ অনেকেই এগিয়ে এসেছিল। ছাত্রলীগের পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্য, শিক্ষক, সাংবাদিক সবাই কৃষকের ধান কাটতে সহযোগিতা করেছেন। এবার দেশে করোনায় শ্রমিক সঙ্কট পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সবাই এগিয়ে না আসলে আমাদেরই সামনে বিপদ অপেক্ষা করছে। গত সপ্তাহে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার একটি হাওড়ে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ধান কেটে দেন কিশোরগঞ্জ ৫ আসনের এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। রবিবার শ্রমিক সঙ্কটে চাষীদের পাকা ধান কেটে দেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির বাগেরহাটের নেতা-কর্মীরা।
×