ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়াসহ চার জেলার উঠতি তাঁত শিল্পে ধস

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২১ এপ্রিল ২০২০

বগুড়াসহ চার জেলার উঠতি তাঁত শিল্পে ধস

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ করোনার থাবায় বগুড়া তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টারের আওতায় বগুড়া জয়পুরহাট নওগাঁ ও গাইবান্ধার ৫ হাজারেরও বেশি তাঁত শিল্পে ধস নেমেছে। এসব তাঁতে শাড়ি লুঙ্গি গামছা মশারি তৈরি হয়। এ ছাড়াও বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শাঁওইল গ্রামে তাঁতিরা চাদর ও কম্বল তৈরি করে দেশজুড়ে সুনাম অর্জন করেছে। হস্তশিল্পের এই সামগ্রী রফতানির পথে পা বাড়িয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় তাঁত প্রধান এলাকা বৃহত্তর পাবনা (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ)। তাঁতের শাড়ি ও লুঙ্গি বানিয়ে ব্রিটিশ শাসনামলেই প্রতিষ্ঠা পায়। গত শতকের আশির দশকের শুরুতে পারিবারিক বন্ধনের ধারায় বগুড়ার কাহালু উপজেলা এলাকার গ্রামগুলোতে তাঁতের বিস্তার লাভ করে। প্রথমে তৈরি হতো শুধু গামছা। দ্রুত গামছার সঙ্গে শাড়ি লুঙ্গি মশারি বানানো শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শাঁওইল গ্রামের তাঁতিরা হকার্স মার্কেট থেকে উল-সুতা কিনে এনে চাদর বানানো শুরু করে। এরপর চরকার পুরাতন উল রিফাইন করে তৈরি করে কম্বল। অগ্রগতির ধারাবহিকতায় তারা তাঁতে কম্বল বানানো শুরু করে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শাঁওইল নামের গ্রামের পরিচিতি পায় কম্বল গ্রামে। তারপর প্রায় প্রতি ঘরেই চাদর কম্বল বানানো শুরু হয়। এদিকে কাহালু থেকে যে তাঁতের যাত্রা শুরু তাও সম্প্রসারিত হতে থাকে। এই তাঁতের কাপড় বিপণন শুরু হয় জয়পুরহাট, নওগাঁ ও গাইবান্ধায়। কাহালুর তাঁতিরা ওই জেলাগুলোতে গিয়ে তাঁত শিল্প স্থাপন করে। ওই এলাকার লোকও বসে থাকেনি। তারাও তাঁত বসিয়ে নিজেরা স্বাবলম্বী হতে থাকে। ঐতিহ্যের এই শিল্পের বিকাশে সরকারও এগিয়ে আসে। ১৯৯৯ সালে কাহালুতে স্থাপিত হয় তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টার। এই সেন্টার থেকে তাঁত শিল্পের উন্নয়নে তাঁতিদের ঋণ সুবিধা দেয়া শুরু হয়। বগুড়ার তাঁতের কাপড়ের চাহিদা বাড়তে থাকে। তাঁতের কাপড় বেচাকেনার বড় হাটের শাড়ি লুঙ্গির পাইকারি বিক্রেতারা কাহালু থেকে শাড়ি গামছা অন্যান্য পণ্য কিনে নিয়ে যায়। বেসিক সেন্টারের কর্মকর্তা মজিবর রহমান জানান, চার জেলায় অন্তত ছয় হাজার তাঁতি আছেন। এদের মধ্যে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রায় ৫শ’ জন। ২১৩ জন তাঁতিকে ১০ শতাংশ সরল সুদে অন্তত তিন কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। উল্লেখিত চার জেলায় তাঁতের কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৮ সালের নবেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কাহালুতে তাঁতিদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বহুতল ভবনের নির্মাণের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। সকল আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল চলতি বছর জানুয়ারি মাসে। শুরুর সময় বৈশি^ক করোনার থাবা এসে পড়ে বাংলাদেশে। বিঘœ ঘটে ভবন নির্মাণ কাজে। একই কারণে (করোনা) তাঁতিরা যে পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাতের অপেক্ষায় ছিল তাতেও বাধা পড়ে। যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের মাথায় বাজ পড়েছে বেচাকেনা না থাকায়। কয়েকজন বললেন, নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছিলেন। এখন বিপাকে পড়েছেন। বর্তমানে কোন ফ্যাক্টরি চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কাহালুর মালঞ্চা গ্রামের তাঁতি জাবেদ আলী বললেন, তার পাঁচটি তাঁত চালু ছিল। বিদ্যুতচালিত উইভিং ও নিটিংয়ে সুতা রং এবং অন্যান্য সরঞ্জাম কিনে এক মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার শাড়ি লুঙ্গি গামছা উৎপাদন করতে পারতেন। যদিও করোনা ক্রান্তিকালের আগেই সুতার দাম অনেক বেড়ে গেছে তারপরও উৎপাদন চালু রেখে পণ্য বিক্রি করে কিছু লাভ আসছিল। এখনও তো বিক্রিই বন্ধ। কাহালু বুরইল গ্রামের আম্বিয়া খাতুনের কথা- তাঁত বন্ধ থাকায় এখন বাড়িতে বসে টুকটাক দর্জির কাজ করছেন। গ্রামের দেড় শ’ তাঁতই এখন বন্ধ। তাঁত শ্রমিকরা কাজ না পেয়ে কোন রকমে দিন গুজরান করছেন। কেউ সাহায্য করলে খাবার জুটছে। তাঁতি সমিতির নেতা এনামুল হক জানালেন, বগুড়ার উঠতি এই শিল্পের বড় ধস নেমেছে। বগুড়ার তাঁতিরা পাবনার ঐতিহ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাপড় বুনতো। বৃহত্তর পাবনার হাট বাজারেও বগুড়ার তাঁতের পণ্য গেছে। মান উন্নত হওয়ায় ক্রেতারা সহজে বুঝতে পারে না কোনটি পাবনার আর কোনটি বগুড়ার। তবে আদমদীঘির তাঁতে বোনা কম্বল ও চাদর একেবারেই আলাদা। যা বগুড়ার ব্রান্ড ধরে রেখেছে। করোনার থাবায় এগিয়ে চলার বগুড়ার তাঁত শিল্প থমকে গিয়েছে। এই ধস সামলাতে কত দিন সময় লাগবে এ নিয়ে মহা ফাঁপরে পড়েছে তাঁতিরা।
×