ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি

চালের বাজার অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা ব্যবসায়ীদের

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ২০ এপ্রিল ২০২০

  চালের বাজার অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা ব্যবসায়ীদের

রশিদ মামুন ॥ করোনার সুযোগ নিয়ে মৌসুমের শেষে এসে চালের বাজার অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছেন ব্যবসায়ীরা। গত শুক্রবার থেকে দেশের অর্ধেকের বেশি অটোরাইস মিল বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা। গত সপ্তাহের শুরু থেকে মিল মালিকরা চাল কল বন্ধ রাখতে শুরু করেন। আর শুক্রবার থেকে দেশের মোট অটোরাইস মিল ৫৫০টির মধ্যে এখন ২২৫টির বেশি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে বাজারে চালের কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। করোনার তা-বের মধ্যে গত মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মিল মালিকরা। অনেক ব্যবসায়ীর কাছে ধান থাকলেও মিল চালানো হচ্ছে না। ধানের মজুদ শেষ পরিবহন জটিলতা আর শ্রমিক না থাকার দোহাই দিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। বোরো মৌসুম শুরুর আগে এক মাসের ফারাকে চালের বাজার অস্থির করে ফায়দা লুটের চেষ্টা করছে সিন্ডিকেট। নোভেল করোনাভাইরাসে সারাবিশ্ব বিপর্যস্ত। বিশ্লেষকরা বলছেন, সারাবিশ্বে কৃষি উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে আসন্ন বোরো মৌসুম এবং সামনের আউস মৌসুম খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই মৌসুমে দেশে চাহিদার উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন না করতে পারলে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। এই সঙ্কট সমাধানের জন্য ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে এখন চাল ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এজন্য সরকারীভাবে মোটা চালের পাশাপাশি সরুচাল সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। খাদ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা কেবল মোটা চাল সংরক্ষণ করি। বাজারে এই চালের ভোক্তা নির্দিষ্ট শ্রেণীর গ্রাহক। বাজারে চালের দাম বাড়লে আমরা সরকারীভাবে কম মূল্যে চাল বিক্রি করি তার গ্রাহকও নির্দিষ্ট। যাদের কেউই সরু চাল খান না। ফলে মোটা চালের দাম কমলেও কমে না সরু চালের দাম। এসব বিষয়েও সরকারের নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলেন, মৌসুমের শুরুতে মিল মালিকরা ধান কেনেন তখন এক কেজি চালের উৎপাদন খরচের সঙ্গে মুনাফা যোগ করার পর ৩৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন একজন মিল মালিক। কিন্তু এখন সেই চাল মিল গেটেই ৩৮ থেকে ৩৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে কেজিপ্রতি আরও তিন টাকা বাড়ছে। তিনি বলেন, কঠোরভাবে এদের পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি দাম নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। যাতে কেউ বেশি দামে বিক্রি করতে না পারে। কিন্তু সেই উদ্যোগই নেই। একইভাবে সরু চালের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে মিল মালিকরা। তিনি প্রশ্ন তোলেন এখনতো নতুন ধান ওঠেনি। বাজারে ধানও নেই। ব্যবসায়ীরা যেহেতু শুরুতেই ধান কিনে রেখেছে তাই দাম বৃদ্ধি করা কোন বিবেচনাতেই যৌক্তিক নয়। করোনাভাইরাসে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে প্রকার ভেদে মোটা চালের দর ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। কিন্তু এই সময়ে যা বেড়ে সর্বোচ্চ ৪২ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ কেজি প্রতি চালের দাম বেড়েছে আট টাকার মতো। আর গ্রেইন রাইস না সরু লম্বা চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়েছে। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে মিনিকেট ৫০ থেকে ৫৫, নাজির শাইল প্রকার ভেদে ৫৫ থেকে ৬০, আবার ৬০ থেকে ৬৫ এবং ৬৫ থেকে ৭০ টাকা হয়েছে। খুচরা বাজারে কোথাও কোথাও এর থেকে বেশি দামেও চাল বিক্রি হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে কুষ্টিয়ার একজন চাল ব্যবসায়ীর হাতে দেশের ৬০ ভাগ চালের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ওই ব্যবসায়ীর গুদামে এখনও বিপুল পরিমাণ ধানের মজুদ রয়েছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তিনি মিল চালাচ্ছেন না। আবার এই মিল মালিকের ৩০০ খানা ট্রাক রয়েছে যা কেবল চাল পরিবহন করে। এসব ট্রাক এখন আর চাল নিয়ে ঢাকায় আসতে দেয়া হচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার চালের বাজারের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রিত হয় কুষ্টিয়া থেকে। কিন্তু মিল না চলার পাশাপাশি ঢাকায় পর্যাপ্ত সরবরাহ না করাতে দাম অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। কথা বলার জন্য ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে কয়েক দফা চেষ্টা করেও তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন মিল মালিকরা মিল সংলগ্ন যে গুদামে ধান রাখেন কেবল ওইসব গুদামে কি পরিমাণ ধান রাখেন তার হিসেব দিয়ে থাকেন। অন্য গুদামের কোন হিসেব কারও কাছে থাকে না। ফলে এসব গুদামে হানা দিলে ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আর অন্য গুদামগুলো থাকছে নজরদারির বাইরে। জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি ফুড) মনোয়ার হোসেন বলেন, কুষ্টিয়াতে ৪৬টি অটোরাইস মিলের মধ্যে এখন মাত্র তিন থেকে চারটি চলছে। বাকি সবগুলো বন্ধ রয়েছে। যেখানে প্রতি দিন ৯০০ টন চাল উৎপাদন হতো এখন সেখানে উৎপাদন ৭৫ টনে নেমে এসেছে। কুষ্টিয়ার পর নওগাঁ এবং দিনাজপুরের অটোমিলগুলোতে বেশি চালের উৎপাদন হয়। দুই জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে অর্ধেকের বেশি মিল বন্ধ রয়েছে। এতে চালের উৎপাদন না হওয়াতে বাজারে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। নওগাঁও এর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জিএম ফারুক হোসেন পাটোয়ারি বলেন, তার এলাকায় ৫৩টি অটোরাইস মিল রয়েছে যার মধ্যে এখন ২৭টি মিল চলছে। বাকিগুলো বন্ধ রয়েছে। মৌসুমের এই সময়ে রমজানের আগে কিছু কিছু রাইস মিল মুড়ির চাল উৎপাদন করে। ফলে স্বাভাবিক চালের উৎপাদন আরও কমে যায়। এর মধ্যে মিল বন্ধ থাকাতে বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি হবে। দিনাজপুরের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিসের একটি সূত্র জানিয়েছে জেলার ১৮৯টি মিলের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মিল বন্ধ রয়েছে। আর এসব মিল বন্ধর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছে তারা শ্রমিক পাচ্ছে না। করোনার কারণে মিলে কাজ করতে চাইছে না শ্রমিকরা। অন্যদিকে ধানের সঙ্কট থাকায় প্রতিদিন একটি মিল যে পরিমাণ উৎপাদন করতে পারে তার অর্ধেকও উৎপাদন করছে না। অর্থাৎ জেলায় প্রতিদিনের চালের উৎপাদন আগের তুলনায় ২৫ ভাগে নেমে এসেছে। দেশে বোরো মৌসুম শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে হাওড় অঞ্চলে ধান কাটা শুরু হচ্ছে। এর বাইরে বোরো ধানের পুরো মৌসুম শুরু হতে আরও ১৫ থেকে ২০ দিন বাকি রয়েছে। আবার কৃষক ধান কাটলে সঙ্গে সঙ্গেই তা মাড়াই করে বাজারে সরবরাহ শুরু করা যায় না। ফলে এখন এক দেড় মাসের যে সময়টি পাওয়া যাবে সেখানে একটি বড় ফায়দা লুটের চেষ্টা করছে ব্যবসায়ীরা। অটোরাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী জনকণ্ঠকে বলেন, চালের দাম বৃদ্ধির একক দায় মিল মালিকদের নয়। তিনি বলেন, শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবহন জটিলতা রয়েছে। আবার মৌসুমের শেষের দিকে ধানের সঙ্কটও রয়েছে। এসব কারণে মিল চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমাদের ৫৫০টি অটোরাইস মিল রয়েছে কিন্তু এখন আর মধ্যে ২০০ থেকে ২২৫টি চলছে। তিনি বলেন, আমরা চালের দাম ৫০ পয়সা কেজিতে বৃদ্ধি করলে খুচরা ব্যবসায়ীরা পাঁচ টাকা বৃদ্ধি করে। এসব যাদের দেখার কথা তারাও দেখে না। এককভাবে আমাদের ওপর দায় চাপানো হয় যা সমীচীন নয়।
×