ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এখন পর্যন্ত বাজার মনিটরিং টিমও মাঠে নামেনি

কোন বাজার বা খুচরা দোকানে মূল্য তালিকা টানানো হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ২০ এপ্রিল ২০২০

কোন বাজার বা খুচরা দোকানে মূল্য তালিকা টানানো হচ্ছে না

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ রাজধানীসহ দেশের সব বাজারের প্রবেশ পথে এবং প্রতিটি খুচরা দোকানের সামনে নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা টানানো বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই আদেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনও রাজধানীর কোন বাজার বা খুচরা দোকানেও এই আদেশ মানা হচ্ছে না। মূল্য তালিকা টানানো এবং তার চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি না করার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। তবে এ বছর এখন পর্যন্ত বাজার মনিটরিং টিম মাঠে নামেনি। সম্প্রতি সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আবদুর রহিম খান বলেছেন, ‘মন্ত্রণালয়ের দুটি সংস্থা বিশেষ করে ট্রেডিং কর্র্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর থেকে প্রতিনিয়তই বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং টিমগুলো আগামী সপ্তাহেই বাজারে অভিযান পরিচালনা শুরু করবে।’ ক্রেতারা বলছেন, বাজারে মূল্য তালিকা থাকলে ক্রেতারা প্রতারণার শিকার কম হবেন। এছাড়া ব্যবসায়ীরা চাইলেও অনৈতিক মুনাফা করতে পারবেন না। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৪ নবেম্বর প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজস্ব খাতে দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল গঠিত হয়। এই সেল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা, আমদানির পরিমাণ, মজুদ ও সংগ্রহ পরিস্থিতি এবং বিতরণ ব্যবস্থাসহ বিবিধ তথ্যের পর্যালোচনা এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার দরের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে। এই কাজের অংশ হিসেবে এই সেল বিভিন্ন সংস্থা থেকে পণ্যের উৎপাদন, মজুদ, সংগ্রহ পরিস্থিতি ও বিতরণ ব্যবস্থা, পণ্যের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারদর, বন্দরে পণ্য খালাসের পরিমাণ, পণ্যের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের করণীয় নির্ধারণে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার ২৪ কর্মকর্তার নেতৃত্বে ২৪টি বাজার মনিটরিং কমিটি সারাবছর বাজার মনিটরিং করার কথা। সে জন্যই বছরে দুবার এই কমিটি গঠিত হয়। এছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী কমিটি পুনর্গঠনও করা হয়। সারা বছর না হলেও অন্তত রোজা শুরুর আগে অর্থাৎ শব-ই বরাতের পর থেকেই মাঠে নামে বাজার মনিটরিং কমিটিগুলো। কমিটিতে ঢাকা জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটসহ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), বাংলাদেশ আনসার, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), স্বরাষ্ট্র, অর্থ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা থাকেন। রমজানে কমিটিগুলো সচল থাকে এবং অভিযান থেকে ফিরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এবছর এখনও পর্যন্ত বাজারে নামেনি এসব কমিটি, অথচ সবকিছু ঠিক থাকলে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৪ এপ্রিল থেকেই শুরু হচ্ছে রোজা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং কমিটিসহ মোট ১২টি সরকারী সংস্থা বাজার মনিটরিংয়ের কাজ করছে। সংস্থাগুলো হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নিরাপদ খাদ্য অধিদফতর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), সব জেলা প্রশাসন এবং সরকারের চারটি গোয়েন্দা সংস্থা। এসব সংস্থার আলাদা টিমের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই বাজার পরিস্থিতির খোঁজ-খবর নেয়ার কথা। প্রতিদিন বাজারে যাওয়া এবং নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি বিশেষ করে পণ্যের মজুদ, আমদানি সরবরাহ পরিস্থিতি দেখে বাণিজ্যমন্ত্রী ও সচিবের কাছে প্রতিবেদন দেয়ার কথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমের। মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কাজ পণ্যের দাম বৃদ্ধি, মেয়াদ ও জাল-জালিয়াতি হয় কিনা, সেদিকে নজর রাখা। বিভিন্ন প্যাকেটজাত পণ্যের গায়ে দাম লেখা আছে কিনা, তার বেশি দাম নিচ্ছে কিনা, উৎপাদন ও ব্যবহারের মেয়াদ ঠিকমতো আছে কিনা, কেউ কোন পণ্যে ভেজাল দিচ্ছে কিনা, তা দেখভাল করার কথা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। আর বাজার স্থিতিশীল রাখতে মজুদ, সরবরাহ ঠিক রাখা ও ভেজাল প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন র‌্যাব-পুলিশ এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নিরাপদ খাদ্য অধিদফতরের। এছাড়া সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একাধিক টিমের পক্ষ থেকে বাজারে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্য আমদানি, সরবরাহ ও মজুদ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার কথা। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসব সংস্থার টিমগুলোর বাজারে ঠিকমতো কাজ করে না। এদিকে রমজান মাস শুরু হতে হাতে সময় আছে এক সপ্তাহেরও কম। এছাড়া দেশে মহামারী করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলছে সাধারণ ছুটি। রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা লকডাউন করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যৌক্তিক, স্বাভাবিক, স্থিতিশীল এবং সরবারহ নিশ্চিত করতে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযানকালে হ্যান্ড মাইকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যতালিকা যথাযথভাবে প্রদর্শন, সেই মূল্যের চেয়ে বেশিতে বিক্রি না করা এবং করোনা পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে অতি মুনাফা করা থেকে বিরত থাকতে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করা হচ্ছে। এমনকি ক্রেতা-বিক্রেতার স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ও হাত ধোয়ার পরামর্শ, অযথা ঘরের বাইরে ঘোরাফেরা না করার কথাও বলা হচ্ছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় টিসিবি’র ট্রাক সেল কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৮টি ভ্রাম্যমাণ মনিটরিং টিম কাজ করছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব পণ্য সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রির নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাওরানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অতীতে দেখেছি, আমরা সে নির্দেশ মানলেও অনেক ব্যবসায়ীই তা মানেন না। যারা এই নির্দেশ মানেননি, তাদের বিষয়টি কেউ দেখতেও আসেন না। এরকম নানা ধরনের সিদ্ধান্ত হয়। রেডিও টেলিভিশনে দেখি, সংবাদপত্রেও পড়ি, ওটুকুই। এর বেশি কিছু তো কিছু দেখি না।’ কাওরানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন জানিয়েছেন, পণ্যের মজুদ পরিস্থিতি দেখতে বাবসায়ীদের গুদাম পরিদর্শনে আসেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তারা এ সময় গুদামের পণ্য দেখে নানা রকমের হয়রানি করেন। কী পরিমাণ, কোন পণ্য কত দিন গুদামে রাখা যায়, সে সম্পর্কে অনেকেরই প্রাথমিক ধারণা পর্যন্ত থাকে না। তাই এ নিয়ে বেশিরভাগ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের নানা ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়তে হয়। এতে অনেক ব্যবসায়ী হয়রানির শিকার হন। এসব প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘বাজার মনিটরিং চলছে। বাজারে রমজানের প্রয়োজনীয় সব পণ্যের অতিরিক্ত মজুদ রয়েছে। সরকারের একাধিক টিম কাজ করছে। সামনে আরও টিম নামবে।’
×