ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তার পোশাক ছাড়াই নগরবাসীকে সেবা দিচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ২০ এপ্রিল ২০২০

 নিরাপত্তার পোশাক ছাড়াই নগরবাসীকে সেবা দিচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই নগরবাসীকে নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। এমন মহৎ কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অনেকেরই নিরাপত্তার পোশাক নেই। অথচ তারা মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে পাড়ামহল্লায় নিয়োজিত বিভিন্ন বেসরকারী কোম্পানির নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যেও এমন চিত্র চোখে পড়েছে। আবার যারা রাস্তায় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের বার বার তো দূরের কথা দুই তিন ঘণ্টা পর পরও হাত ধোয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। রাজধানীর অধিকাংশ জায়গায়ই এমন চিত্র চোখে পড়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের একমাত্র সম্বল হ্যান্ড স্যানিটাইজার। অনেকেই পকেটে হ্যান্ডস্যানিটাইজার রাখছেন, আর তাই মাঝে মধ্যেই হাতে ঘষে নিচ্ছেন। যদিও প্রায় সবারই মুখে মাস্ক দেখা গেছে। তবে সেই মাস্ক কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। শনিবার দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাঘুরে এমন চিত্রই চোখে পড়েছে। ঢাকার প্রায় প্রতিটি আবাসিক এলাকায় নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। বাড়ির মালিকরা আবার কোন কোন এলাকার ফ্ল্যাট মালিকরা মিলে এমন নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তুলেছেন। তারা বিভিন্ন আবাসিক এলাকার গেটে রাত দিন দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন। মানুষ প্রবেশ করা মাত্রই তাদের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে দিচ্ছেন। আবার জুতার তলায় স্প্রে করে দিচ্ছেন। অথচ যারা করোনাভাইরাসের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে এমন মহৎ কাজটি করছেন, তাদের নিজেদেরই নিরাপত্তা নেই। হাতে ভাল কোন গ্ল্যাভস নেই। মুখে সাধারণ মাস্ক। পায়ে তেমন কোন সুরক্ষিত জুতা নেই। এমন চিত্র চোখে পড়েছে ঢাকার কল্যাণপুর আবাসিক এলাকা, ষাট ফুটের আবাসিক এলাকাগুলো, কল্যাণপুর কাঁচাবাজার, কাওরানবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায়। একমাস পেরিয়ে গেলেও এসব নিরাপত্তারক্ষীদের করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচাতে কোন নিরাপত্তামূলত ব্যবস্থাই গড়ে তোলা হয়নি। যা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে বার বারই সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে। অনেক নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু কোন সাড়া মিলছে না। অনেকেই এভাবেই কাজ করতে বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। কাজ না করতে না পারলে বিদায় নিতে বলেছেন। এতে করে তাদের মাধ্যমেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলেও নিরাপত্তাকর্মীদের দাবি। শুধু চাকরি বাঁচানোর তাগিদে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই তারা মানুষজনকে নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছেন। শনিবার বিকেল চারটার দিকে ঢাকার বংশালের নয়াটোলা এলাকায় রাস্তায় দল বেঁধে যুবকদের আড্ডা দিতেও দেখা গেছে। সরকার আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। অথচ তার মধ্যেই বাইসাইকেলের দোকান খোলা রয়েছে বংশালে। বংশালের দোকানগুলো ছোট ছোট। সেই ছোট ছোট দোকানেই ৪/৫ জন করে বসে আড্ডা দিচ্ছেন মানুষ। অনেকের মুখে মাস্কও নেই। হাতে গ্ল্যাভস নেই অধিকাংশ মানুষের। গলিতে গলিতে লোকজনে ঠাসা। সামাজিক দূরত্ব তো দূরের কথা, অনেককেই গলাগলি করে ও হাত ধরে হাঁটতেও দেখা গেছে। যদিও অধিকাংশ বাণিজ্যিক দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তবে আড্ডা থামানো যায়নি। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ঘরে থাকার কোন বিকল্প নেই। সরকারের হিসেব মতে, দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ঢাকার। এরপর নারায়ণগঞ্জ। সম্প্রতি গাজীপুরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। ঢাকায় যেসব এলাকায় অধিকহারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে তার মধ্যে ঢাকার মিরপুর, টোলারবাগ, বাসাবো ও বংশালের নয়াটোলাও আছে। নয়াটোলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থাও আছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দফতর লাগোয়া পশ্চিম পার্শ্বের রাস্তায় ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে বেরিকেড দেয়া হয়েছে। বেরিকেড ভেদ করে অবাধে লোকজন ও রিক্সা চলাচল করছে। আর ভেতরের গলিগুলোতে বসছে জমজমাট আড্ডা। এসব এলাকায় পুলিশের তেমন কোন টহল দেখা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের সামনে বঙ্গবাজার হকার্স মাকের্টের সামনে, কদম ফোয়ারাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। পুলিশ সদস্যরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন। হাতে গ্ল্যাভস ব্যবহার করছেন। মুখে মাস্কও আছে। প্রচন্ড গরমের মধ্যে যেখানে পুলিশের হাফ হাতা পোশাক পরিধান করে দায়িত্ব পালন করার কথা, সেখানে অধিকাংশ পুলিশ সদস্যকে ফুলহাতা পুলিশের ড্রেস পরিধান করে দায়িত্ব পালন করছেন। এতে করে প্রচন্ড গরমে তারা হাফিয়ে উঠছেন। আবার গাড়ির অভাবে একটি পিকআপের মধ্যেই অনেক পুলিশকে একসঙ্গে গাদাগাদি করে বসে টহল দিতেও দেখা গেছে। রাস্তায় রাস্তায় হাত ধোয়ার কোন ব্যবস্থাও নেই। যাও আছে তা অনেক দূরে দূরে। এর কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, মাটির নিচ দিয়ে যাওয়া পানির লাইনগুলোর অধিকাংশেরই উপরে পানি পড়ার জন্য কোন ট্যাপের ব্যবস্থা নেই। ফলে হাত ধোয়ার কোন ব্যবস্থা বা বেসিন স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। যদিও ঢাকার অধিকাংশ পাড়া মহল্লায় সেই ব্যবস্থা আছে। তবে মূল সড়কগুলোতে সেই ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। পাড়ামহল্লার তরফ থেকে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি যেসব জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, তার অধিকাংশ জায়গায়ই হাত ধোয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে রাস্তায় চলাচলের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে বিনা কারণে বাইরে থাকা ব্যক্তিদের ঘরে ফেরাতে শক্ত অবস্থান নেয়া হয়েছে। শুধু পুলিশ নয়, এজন্য সশস্ত্র বাহিনীও কাজ করছে। সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচী পরিচালনা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী রাস্তায় টহল দিচ্ছে। টহলের সময় মাইকিং করে সম্মানিত নগরবাসীকে বিনা কারণে ঘরের বাইরে থাকার অনুরোধ করা হচ্ছে। তারপরেও কোন কোন নগরবাসী নিতান্তই কৌতুহলবশত ঘরের বাইরে বের হয়ে অহেতুক ঘোরাফেরা করছেন। এ কারণে পুলিশ ঢাকার ভেতরে ও ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়েছে। যাতে অহেতুক ঘোরাফেরা মানুষদের শনাক্ত করে ঘরে ফেরানো যায়। আর মানুষ যাতে ঢাকা প্রবেশ করতে না পারে এবং বের হতে না পারে এ জন্য ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়েছে। চেকপোস্টগুলোর অধিকাংশই বসানো হয়েছে মূল সড়কে। আবার কিছু কিছু চেকপোস্ট লিংক রোডেও বসানো হয়েছে। আবার কোন কোন পাড়ামহল্লায় সেখানকার মাদকাসক্ত যুবকরা রাস্তায় বাঁশ বেঁধে দিয়ে সামনে লকডাউন লিখে দিয়েছে। এতে করে পাড়া মহল্লার লোকজন খুবই খুশি। পাড়ামহল্লার ছেলেদের কর্মকান্ডে অধিকাংশ মহল্লাবাসী যুবকদের নেক নজরে দেখছে। অথচ ওইসব রাস্তায়ই অনেক দোকান পেছন দিক থেকে খোলা রাখা হচ্ছে। এসব দোকানে চায়ের আড্ডা বসছে। বসছে মাদকের আড্ডায়ও। আবার মাদক বেচাকেনাও হচ্ছে। মূলত মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে এভাবেই দেদারসে মাদকের ব্যবসা চলছে। ত্রাণ বা সাহায্যের নামে আনা জিনিসপত্রের আড়ালে মাদকের চোরাচালানও হচ্ছে। যেসব এলাকায় বস্তির সংখ্যা বেশি, সেসব এলাকায় এমন ঘটনা বেশি ঘটছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি চলবে। ছুটি আরও বাড়তে পারে। যদিও সেটি নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের সার্বিক পরিস্থিতির উপর। ইতোমধ্যেই ঢাকা মহানগর পুলিশ বিনাপ্র্রয়োজনে বাইরে থাকা ব্যক্তিদের ঘরে ফেরাতে এবং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে বেশ কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করেছে। পাড়া মহল্লার দোকান সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত খোলা রাখার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। আর কাঁচাবাজার সুপারশপ সকাল ছয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। পাশাপাশি গত ৯ এপ্রিল ঢাকা মহানগর পুলিশের তরফ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে মাঠে নামানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বিনা কারণে ঘরের বাইরে থাকা দুই শতাধিক মানুষকে কয়েক লাখ টাকা জরিমানা করেছে। গত ১০ এপ্রিল থেকে সন্ধ্যা ছয়টার পর জরুরী সেবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ছাড়াই সবাইকে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে চলছে নানামুখী তৎপরতা। তারপরেও উৎসুক মানুষকে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা থেকে নিভৃত করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই টহল আরও জোরদার করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর মুখোশ পরিধান করে যাতে সন্ত্রাসী কর্মকর্তা বা চুরি ডাকাতির মতো ঘটনা না ঘটে এজন্য পুলিশকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলামও জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিনাপ্রয়োজনে বাইরে থাকা লোকজনদের ঘরে ফেরাতে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অপ্রয়োজনে বাইরে থাকা ব্যক্তিদের সাজা দেয়া হচ্ছে। আমার মানুষকে ঘরে রাখতে সব ধরনের চেষ্টা করছি। প্রয়োজনে আরও কঠোর হতে হবে। বিনা কারণে ঘরের বাইরে থাকা ব্যক্তিদের ঘরে ফেরাতে প্রয়োজনে যে কোন ধরনের অবস্থান নিতে বাধ্য হবে পুলিশ।
×