ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টুটুল মাহফুজ

করোনা যোদ্ধা কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসা

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২০ এপ্রিল ২০২০

করোনা যোদ্ধা কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসা

‘গত (১৫ এপ্রিল) সিমেন্ট ক্রসিং চেকপোস্ট করার সময় এক নারী এক বোতল শরবত দিয়ে রাস্তার ওপারে এক মাঝ বয়সী নারীকে দেখিয়ে বললেন, তিনি পাঠিয়েছেন। আকস্মিক ঘটনাটা আমি না বুঝেই আমার সহকর্মী কনস্টেবলকে তা গ্রহণ করতে ইশারা করলাম। ব্যাপারটা আমার জন্য এতটাই আকস্মিক যে হতভম্ব হয়ে বাসাটার দিকে তাকালাম। দোতলা বারান্দার গ্রিলের ফাঁক থেকে অপলক দুটি চোখ আমাদের দিকে চেয়ে আছে। মায়ের বয়সী মানুষটিকে দেখে হুঁশ ফিরে এলো। এই বিপর্যয়ের এই সময়টাতে রোদের মধ্যে সকাল থেকেই তার বাসার সামনেই কাজ করছিলাম দেখে তার পক্ষ থেকে এই অসামান্য উপহার। কিন্তু অযোগ্য এই আমি নিজে গ্রহণ না করাতে হয়ত তিনি শঙ্কিত যে, আমরা শরবতটা খাব কি-না। নিজের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হতেই বোতলটি হাতে নিয়ে কয়েক ঢোঁক গিলে ফেললাম আর হাতের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করতে পারলাম। মুখে একটি তৃপ্তির হাসি দিয়ে তিনি চলে গেলেন আর আমি পেলাম ছোট্ট চাকরি জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি।’ চট্টগ্রামে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তা রাজু আনোয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এভাবেই তার ভাললাগার কথা বলছিলেন। কোভিড-১৯-এ এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যাটা বিশ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন সাড়ে চার লাখের মতো। এই সুস্থ করে তোলার ক্লান্তিহীন যুদ্ধে সামনে থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। চিকিৎসক, নার্স এবং হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের মাঝে সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েও প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আক্রান্ত রোগীদের। একইসঙ্গে নানা জরুরী সেবাকাজে প্রতিনিয়ত নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন নানা পেশার মানুষেরা। তাদের এই অবদান সত্যিকার অর্থেই প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দাবি রাখে। সার্চ ইঞ্জিন গুগল যেমন গত ৬ এপ্রি থেকে ‘Thank you coronavirus helpers’ শিরোনামে সেবাদানকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে ডুডল প্রকাশ করছে, ঠিক তেমনই বিভিন্ন সরকার-বেসরকারী, এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও নানাভাবে কৃতজ্ঞতা আর উৎসাহিত করার চেষ্টা চলছে তাদের। গুগল বলছে ‘কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী মানবসম্প্রদায়ের ওপর যেমন প্রভাব ফেলছে, লোকেরা একে অপরকে এখনকার চেয়ে আরও বেশি সাহায্য করার জন্য একত্র হচ্ছে। আমরা প্রথম সারিতে থাকা অনেককে চিনতে ও সম্মান জানাতে একটি ডুডল সিরিজ চালু করেছি।’ গুগলের এই সিরিজ ডুডলে এখন পর্যন্ত (১৭ এপ্রিল) ১০ ধরনের পেশার মানুষদের ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। স্টিভেন বার্গেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের সাত বছর বয়সী এক শিশু। সে কোভিড-১৯ মহামারীতে যারা সামনে থেকে যুদ্ধ করছেন রোগীদের নিয়ে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় দিন-রাত এক করে দিচ্ছেন, তাদের জন্য অভিনব এক উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার বাড়ির লনে প্রতদিন ছয় ঘণ্টা করে দৌড়াবে। আমেরিকার ডব্লুুওয়ে চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে স্টিভেনের মা এলিজা বার্গেস বলছিলেন ‘আমি মনে করি আমাদের এতটা সমর্থন পাওয়ার কারণ ছিল, মানুষ সত্যিই এমন সহায়তার সঙ্গে যুক্ত হতে চায় এবং তারা একে অপরকে উৎসাহিত করতে চায়।’ এখন পর্যন্ত ৩৭ হাজার পদক্ষেপ দিয়ে স্টিভেন ১ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহ করেছে। এই উৎসাহ দেয়ার ব্যাপারটিতে সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করায় সহায়তা করছে হাততালি দেয়ার একটি কর্মসূচী। বিশ্বব্যাপী করোনা আক্রান্ত বেশকিছু দেশে স্থানীয়ভাবে ঠিক করা একটি নির্দিষ্ট সময়ে সকল মানুষ যার যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা অভিবাদন জানাচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে মানবকল্যাণে কাজ করে যাওয়া কর্মীদের। আয়োজকরা আশা করছেন, চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, মুদি দোকানদার, ডেলিভারি ড্রাইভার, ডাক কর্মচারী, জরুরী সেবাদানকারী এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কর্মী যারাই কোভিড-১৯-এর সংস্পর্শের ঝুঁকিতে থেকেও মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিতে এবং সুস্থ রাখার চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের উৎসাহিত করবে এই তালি দেয়া কর্মসূচী। ব্রিটেনের জাতীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের এক নিবন্ধে কলাম লেখক ওয়েন জোনস এই ক্রান্তিলগ্নে পাঁচ ধরনের পেশার মানুষের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সুপারশপের কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং সবশেষে শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানিয়ে জোনস বলেন, ‘ধন্যবাদ দেয়া গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটাই যে যথেষ্ট, এমনটা ভাবার কারণ নেই। যদি এই কৃতজ্ঞতার অর্থ বোঝাতে হয়, তবে এটি সমাজে আমরা কাকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করি এবং আমরা তাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করি, তা আরও একবার ভাবার অবকাশ রাখে। এত সংখ্যক শ্রমিককে কীভাবে অল্প বেতনের, অনিরাপদ এবং বাজে আচরণের মাধ্যমে একটা সমাজে বেঁচে থাকতে হয়, সেটি দেখতে এমন একটি মহামারীর অপেক্ষা করা কাম্য ছিল না।’ সম্মিলিত প্রচেষ্টাগুলোর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর এই অসুস্থতা কেটে যাক, ফিরে আসুক চেনা সেই ব্যস্ততার দিন। সকলের প্রত্যাশা এখন এমনই।
×