ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন কাটছে করোনাকাল

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ১৯ এপ্রিল ২০২০

কেমন কাটছে করোনাকাল

ল’ এ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী শাহজাহান আলী। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারাদেশ লকডাউন। বন্ধ হয়ে গেছে প্রিয় ক্যাম্পাসও। তাই আমিও কার্যত হোম কোয়ারেন্টাইনে আছি। এ রকম দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ অবস্থায় আগে পড়তে হয়নি। তবে পরিবারের জন্য সময় দেয়া, তাদের সঙ্গে সুন্দর মুহূর্তগুলো কাটানোর জন্য বোধহয় এটা একটা বড় সুযোগ। ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আমরা পরিবারের সঙ্গে থাকছি। অফুরন্ত অবসর বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি সবার সঙ্গে গল্প করে, তাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে অবসর মানে বই পড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ। সময়টাকে কাজে লাগাতে আমি সচেষ্ট। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে গল্প, ভাই-বোনরা মিলে লুডু খেলে সময়গুলো পার হয়ে যাচ্ছে। আর ছোট পিচ্চি বোনের ভালবাসার আবদারগুলো মেটানো এখন অন্যতম প্রধান কাজ। ইন্টারনেটের এই যুগে অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সময় কাটানোর একটি উপায়। বিভিন্নভাবে সময় কেটে যাচ্ছে। পুরো পৃথিবী ফিরে যাক আবার সেই পুরনো রূপে। পরিবারের কাছে সময় দিচ্ছি আইন বিভাগের শিক্ষার্থী নিশাত নাবিলা তন্নী। তার অনুভূতি জানিয়ে বলেন, করোনা নামক এই ভয়াবহ মহামারীর সম্মুখীন পৃথিবী প্রথমবার। থেমে গেছে জনজীবন। গৃহবন্দী রয়েছে প্রতিটি মানুষ। আমি জীবনে প্রথমবার এতদিন একটানা ঘরে বন্দী। গৃহে আবদ্ধ দিনের অধিকাংশ সময় যাচ্ছে ফেসবুকিং আর টিভিতে করোনার সংবাদ দেখে। ফেসবুকে যতটা সম্ভব মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি বিভিন্ন সচেতনতামূলক পোস্ট শেয়ারের মাধ্যমে। এছাড়াও মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করা, ছোট ভাইকে পড়াশোনায় সাহায্য করার চেষ্টা করছি। বিকেলে চায়ের কাপে বাবা-মা আর ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা চলছে নিয়ম করে কারণ বাড়ির সবাই এখন অবসরে। এছাড়াও নিজে সতর্ক থাকার পাশাপাশি আশপাশের দুস্থ, অসহায় মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। এভাবেই দিন কাটছে করোনার এই ছুটিতে। চেষ্টা করছি অসহায় মানুষের পাশে থাকার ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী তামিম আদনান। ছুটি কেমন যাচ্ছে জানিয়ে বলেন, ‘ঈদ, পূজার ছুটি পেয়ে বাড়ি বেড়াতে আসা আর এবারের এই হোম কোয়ারেন্টাইনে পড়ে বাড়ি আসার বেপারটা ছিল একেবারেই আলাদা। ছিল না কোন উৎফুল্লতা, ছিল না বাড়ি ফেরার আনন্দ। হল থেকে বের হয়েছিলাম এক রাশ আতঙ্ক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সিদ্ধান্তে বাধ্য হয়ে। ঘরে ঢুকার পর থেকে আজ অবধি ঘর থেকে বের হয়েছি মাত্র ৩ কি ৪ বার। তাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজে। দিনগুলো কাটছে ৪-৫ ঘণ্টার জায়গায় ৮-৯ ঘণ্টা ঘুমিয়ে, মাঝে মাঝে পারিবারিক ছোটখাটো কাজে মাকে সাহায্য করে, ছোট ভাই-বোনের সঙ্গে টিভি দেখা, গেম খেলে। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার করায় মায়ের বকুনি তো শুনতেই হয়। তার পরেও দিন শেষে ভাল লাগছে এই জন্য যে বাড়ি থাকায় দেশের এই দুর্যোগ মুহূর্তে পরিবারের সঙ্গে থেকে পরিবারকে সতর্ক করতে পারছি প্রতি নিয়ত। নিজের অবস্থান থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষকে সচেতন করার। প্রিয় সংগঠন কনজুমার ইয়ুথ বাংলাদেশের হয়ে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছি সমাজের অসহায় মানুষের পাশে থাকার। আশা করি খুব দ্রুতই এই করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পাবে।’ বন্ধুদের আড্ডা ভীষণ মনে পড়ে শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগে পড়েন তামান্না সাদিয়া রিমি। করোনার সময়ে কাটানো ছুটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘সময়ের প্রয়োজনেই বেশ কিছুদিন হলে পুরোদস্তুর গৃহবন্দী জীবনযাপন করছি। প্রতি মুহূর্তে এতসব দুঃসংবাদের মাঝে একটা ভাল খবর এই যে, পরিবারের সঙ্গে একটা শ্রেষ্ঠ সময় পার করছি।আমার অতি ব্যস্ত বাবাও এখন আমাদের সঙ্গে লুডো খেলার অবসর পাচ্ছে। একসঙ্গে প্রার্থনা করা, টিভি নিউজ দেখা, বই পড়া, গল্প করা, একে অপরকে সচেতন করা, গৃহকর্মীদের পরিবারের ভাল মন্দ দেখার মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছে সময়গুলো। সর্বোপরি পরিবার এবং নিজের জন্য যথেষ্ট সময় পাচ্ছি। নতুন কিছু জানা ও শেখার মাধ্যমে সময়টাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। দুর্যোগের এ সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তারুণ্যর মাধ্যমে কিছুটা হলেও দুস্থদের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি। প্রিয় ক্যাম্পাস, বন্ধুদের আড্ডা, শিক্ষকদের শাসন-বারণকে ভীষণ মনে পড়ে। মনে পড়ে, খুব ব্যস্ত দিনের ক্লান্তিতে ঠিক এই রকম অবিরত ছুটির জন্যই মন কাঁদতো। আর এখন যখন ছুটির সাগরে ডুবে আছি, তখন একটাই প্রার্থনা, আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাক। আবার পৃথিবীটা সুস্থ-সুন্দরভাবে বাঁচুক। কাজ করছি নি¤œ আয়ের মানুষের সহযোগিতায় সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী ফারজানা আফরিন অনু। ভিন্ন রকম এ ছুটিতে তার অনুভূতি জানিয়ে বলেন, ‘করোনা নাম শুনলেই বুকে যেন কেমন একটা চিনচিন ব্যথা হয়। মনে হয় না জানি কখন কাকে হারিয়ে ফেলব। আমাদের দেশের মতো এতটা জনবসতিপূর্ণ দেশে করোনা মহামারী আকার ধারণ করলে কেমন হতে পারে এসব ভেবেই কাটছে ভয়ানক সময়গুলো। গ্রামের মানুষকে করোনার ভয়াবহতা বোঝাতে গেলে তারা বুঝতে চেষ্টা করছে না। তবুও নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি আশপাশের মানুষদের সচেতন করতে। লকডাউনের কারণে নি¤œ আয়ের মানুষগুলোর করুণ অবস্থায় তাদের সহযোগিতায় ভালবাসার সংগঠন স্বপ্নকাননের হয়ে অংশ নিয়েছি আমিও। যতটুকু পারি কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যেই গ্রামে একটা এ্যাাসোসিয়েশন করেছি বন্ধু আর বড় ভাইবোনদের নিয়ে। পরিবারের সকলের সঙ্গে চেষ্টা করছি করোনার হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতামূলম নিয়মগুলো মেনে চলতে। ছুটির এ সময়টা কাটছে একাডেমিক পড়ার পাশাপাশি কিছু সাহিত্য বই পড়ে। চেষ্টা করছি ধর্মীয় বিধানগুলো মেনে চলার। এতকিছুর পর ও বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাসের কথা। বার বার চোখের সামনে ভেসে আসছে চিরচেনা ও ভালবাসার মুখগুলো। মনের মধ্যে শুধু একটা প্রশ্নই বেজে চলছে যে আবার কবে ফিরে যাব আমার স্বপ্ন রাজ্য ভালবাসার ক্যাম্পাসে। বই পড়ে ও লেখালেখি করেই সময় যাচ্ছে এসএএইচ ওয়ালিউল্লাহ পড়েন আল-ফিকহ এ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে চলছে অঘোষিত লকডাউন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্যাম্পাস থেকে অপ্রত্যাশিত এই ছুটিতে আপাতত ঠিকানা গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতে এসে সতর্কতার মধ্যেই চলতে হচ্ছে। সুযোগ নেই বাইরে যাওয়ার। সময়টা আসলে আমাদের প্রত্যেকের জন্যেই চ্যালেঞ্জিং। দীর্ঘ অবসরে তেমন কিছু করার নেই। মাকে কিছুটা সাহায্য করি। বই পড়ে এবং লেখালেখি করেই সময়টা পার করছি। পাশাপাশি সংগ্রহে থাকা শখের প্রাচীন মুদ্রাগুলোর যতœ নিচ্ছি। আমার জেলা মাগুরার একমাত্র শিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী ‘খাতা- কলম’ এর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দুর্যোগের এই দিনে অসহায় পরিবারের কাছে কিছুটা ত্রাণসামগ্রী পৌঁছনোর জন্যও কাজ করছি করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের অভ্যাসেই বদল আনতে হবে। নিজেদের সচেতনতা এক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি জরুরী। যারযার সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং মহান আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। খুব দ্রুতই সব ঠিক হয়ে উঠবে আবার ফিরে যাব প্রাণের ক্যম্পাসে এটাই প্রত্যাশা।’ সবচেয়ে বেশি সময় নিচ্ছে আমার স্মার্টফোনটা কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী নিসরাত জাহান। ছুটি কাটানোর অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘করোনাভাইরাস আতঙ্কে বর্তমানে স্থবির হয়ে পড়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। আমার অবস্থাও সবার মতোই। ক্যাম্পাস ছুটিতে এসেছিলাম গ্রামের বাড়ি। সেখান থেকে পারিবারিক কাজে ঢাকাতে এসে আটকে পড়েছি। আবদ্ধ সময়ের সারাদিন কেটে যাচ্ছে নানা দুশ্চিন্তায়। তবে এর মাঝে আছে কিছু ভাললাগাও। এভাবে পরিবারের সবাই একসঙ্গে সময় কাটানো হয়নি। সবসময় সচেতন থাকা, অন্যকে সচেতন থাকতে বলা, মায়ের কাজে সাহায্য আর কাজিনদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় কেটে যাচ্ছে সময়গুলো। সবচেয়ে বেশি সময় নিচ্ছে আমার স্মার্টফোনটা। প্রায় বেশিরভাগ সময় কাটে তার সঙ্গেই। করোনা কোথায় কিভাবে হানা দিয়েছে কোথায় কত প্রাণ নিয়েছে এসব সংবাদ দেখেই কাটছে ছুটির সময়। তবে মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। ইচ্ছে করে বেরিয়ে পড়ি, ঘুরে আসি বাইরে থেকে। গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্যও মনটা আঁকিবুকি করছে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে ক্যাম্পাস আর বন্ধুদেরকে।’ ক্যাম্পাসের প্রিয় মানুষগুলোকে মনে পড়ে আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম। করোনার এ সময়টাতে তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, ‘দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করায় আমাকেও ক্যাম্পাস ছেড়ে মায়ের কোলে ফিরে আসতে হয়েছে। বাসায় এসে ফিরে পেলাম মায়ের কোলের আদর আর বাবার মায়াময় ভালবাসা। কিন্তু ক্যাম্পাস কথা স্মরণে এলেই বুকের মাঝে কেমন যেন একটা মৃদু আওয়াজ হয়। ক্যাম্পাসের স্মৃতিময় প্রিয় স্থান আর মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে সারাক্ষণ। করোনা সচেতনতায় ক্যাম্পাস বন্ধ হলেও বাসায় এসে মনে হলো এলাকার মানুষের মস্তিষ্কে কোন রেখাপাত হয় নাই করোনা নিয়ে। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম তারা এটাকেও গুজব বলে পার করে দিচ্ছে। বোঝাতে গেলে উল্টো মুখ লুকিয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে। তবুও মুখে লাগাম না দিয়েই জনমুখে বোঝাতে চেষ্টা করছি। পদক্ষেপ নিলাম গ্রামের যারা শিক্ষিত সমাজ তাদের কে সঙ্গে নিয়ে ক্ষুদ্র আকারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামের মানুষকে সচেতন করার। ভাল সাড়া পাওয়া গেল। ইতোমধ্যে কাজ শুরু“করে দিয়েছি। আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভাল থাকুক চারপাশের মানুষগুলো।
×