ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ চৈত্রসংক্রান্তি- বাঙালীর বর্ষ বিদায়ের ঐতিহ্যবাহী দিন

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ১৩ এপ্রিল ২০২০

 আজ চৈত্রসংক্রান্তি- বাঙালীর বর্ষ বিদায়ের ঐতিহ্যবাহী দিন

মোরসালিন মিজান ॥ পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে/কালের যাত্রায়...। কালের যাত্রায় কত কী যে ভেসে যায়! হারিয়ে যায় অমোঘ নিয়মে। ঠিক তেমনই কালের গর্ভে হারাচ্ছে আরও একটি বছর। বিদায় নিচ্ছে ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। আজ বাংলা সনের শেষ দিন ৩০ চৈত্র। বাঙালীর বর্ষ বিদায়ের বিশেষ দিবস চৈত্রসংক্রান্তি। দীর্ঘ এক বছরে কত সুখস্মৃতি! পাওয়ার আনন্দ, না পাওয়ার বেদনা। হাপিত্যেশ। ঘটনা-দুর্ঘটনা। বছরের শেষ সূর্যের সঙ্গে সবই অস্ত যাবে। পুরনো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয়/নতুনেরা আসিতেছে ব’লে...। নতুন বছর শুরুর প্রাক্কালে আজ পুরনোকে বিদায় জানাবে বাঙালী। সেই আবহমান কাল থেকে নানা লোকাচার ও উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্যাপন করা হয়ে আসছে। মূল আনুষ্ঠানিকতা গ্রামে হলেও, নগর সংস্কৃতিতে এর প্রভাব নেহায়েত কম নয়। শিকড় সন্ধানী মানুষ হরেক আয়োজনে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপন করে। তবে এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। প্রাণঘাতী করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এখন বিপর্যস্ত পৃথিবী। বাংলাদেশও বড় হুমকির মুখে। সংক্রমণ ঠেকাতে স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী সবাই। এ অবস্থায় বড় কোন আনুষ্ঠানিকতা ব্যতিরেকে ঘরে বসেই, যেটুকু সম্ভব, চৈত্রসংক্রান্তির আচার পালন করা হবে। আনুষ্ঠানিকতা না থাকলেও, হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে ঐতিহ্যবাহী বর্ষবিদায়ের দিনটিকে রঙিন করে তুলবে বাঙালী। শুধু পুরনো বছরকে বিদায় জানাবে না, পৃথিবীর সমস্ত জরা থেকে মুক্তি কামনা করবে। কারণ পুরনো মানেই ছুঁড়ে ফেলার নয়। সবই একদিন পুরনো হয়। গত হয়। সুখ, পাওয়া, না পাওয়া, পেয়ে হারানোর ব্যথা স্মৃতি হয়ে যায় একদিন। তাই বলে মূল্যহীন হয়ে যায় না। প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে হয়। প্রিয় সময়কে ফেলে আসতে হয় পেছনে। একই নিয়মে পুরনো হয় মাস। বছর। সকল পুরনো থেকে শিক্ষা নিয়েই সাজাতে হয় নতুনকে। অভিজ্ঞতার আলোকে গড়তে হয় ভবিষ্যত। চৈত্রসংক্রান্তির তাৎপর্য এখানেই। চৈত্রসংক্রান্তি পুরনোকে ছুড়ে ফেলে না। বিদায় জানায়। বুকে লালন করে। সংক্রান্তি মানে, এক ক্রান্তি থেকে আরেক ক্রান্তিতে যাওয়া। কিংবা বলা যায়, এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় পৌঁছানো। ক্রান্তির সঞ্চার। ক্রান্তির ব্যাপ্তি। সূর্যসহ বিভিন্ন গ্রহের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন। মহাকালের অনাদি ও অশেষের মাঝে ঋতু বদল করতে করতে এগিয়ে চলা। বর্ষ বিদায়ের এ দিনটি লোকজ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই উদ্যাপন করে থাকেন। গ্রামের ঘরে ঘরে চলে বর্ষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা। সনাতন প্রথা অনুসারীরা চৈত্রসংক্রান্তিকে গ্রহণ করেন পুণ্যের দিন হিসেবে। পঞ্জিকামতে, দিনটি মহাবিষুব সংক্রান্তি। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এই দিনে মহা আনন্দে মাতে। পাহাড়ে পাহাড়ে চলে বর্ণাঢ্য উৎসব আয়োজন। চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রামের নারীরা মাটির ঘরদোর লেপা-পোছা করেন। এমনকি গোয়ালঘরটি পরিষ্কার করা হয়। সকালে গরুর গা ধুয়ে দেয় রাখাল। ঘরে ঘরে বিশেষ রান্না হয়। উন্নতমানের খাবার ছাড়াও তৈরি করা হয় নক্সি পিঠা, পায়েস, নারিকেলের নাড়ু। দিনভর চলে খাওয়া দাওয়া। প্রিয়জন পরিজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। অতীতে গ্রামের গৃহস্থরা নতুন জামা কাপড় পরতেন। নাতি-নাতনিসহ মেয়েজামাইকে সমাদর করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। তাদের জন্যও থাকত নানা উপহার সামগ্রী। চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে কাটান। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করেন। ফোকলোরবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৈত্র মাসে স্বামী সংসার কৃষি ব্যবসার মঙ্গল কামনায় লোকাচারে বিশ্বাসী নারীরা ব্রত পালন করতেন। এ সময় আমিষ নিষিদ্ধ থাকত। থাকত নিরামিষ, শাকসবজি আর সাত রকমের তিতা খাবারের ব্যবস্থা। বাড়ির আশপাশ বিল খাল থেকে শাক তুলে রান্না করতেন গৃহিণীরা। এই চাষ না করা, কুড়িয়ে পাওয়া শাক ক্ষেতে বাগানে বেশি বেশি পাওয়া গেলে বিশ্বাস করা হতোÑ সারাবছরের কৃষিকর্ম ঠিক ছিল। মানুষ, তার চারপাশের প্রকৃতি ও প্রাণগুলোর আপন হয়েছিল কৃষি। একই কারণে নতুন বছর নিয়ে দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠতেন তারা। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা খুব আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। এ সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় চড়ক উৎসবের আয়োজন করা হয়। চৈত্রমাসজুড়ে সন্ন্যাসীরা উপবাস, ভিক্ষান্ন ভোজনসহ নানা নিয়ম পালন করেন। সংক্রান্তির দিন তারা শূলফোঁড়া, বাণফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঝোলেন। পাখির মতো শূন্যে উড়ে বেড়ান। গাছের চারপাশে ঘোরেন। হাজার হাজার মানুষ তা উপভোগ করেন। যে গ্রামটিতে আয়োজন সে গ্রামের আশপাশের, এমনকি দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন চড়ক উৎসবে দেখতে আসেন। এখানেই শেষ নয়, সন্ন্যাসীরা আগুনের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটেন! ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য শারীরিক কসরত বটে। তবে এর সঙ্গে ততোধিক আনন্দ যোগ হয়েছে। চৈত্রসংক্রান্তিতে চলে গাজনের মেলা। মেলার সঙ্গে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নাম সম্পৃক্ত। যেমনÑ শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি। এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পতœীরূপে কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিয়ে দেয়াই এ উৎসবের উদ্দেশ্য। গাজন উৎসবের পেছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতন বিশ্বাস ক্রিয়া করে। ধারণা করা হয়, চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচ- উত্তপ্ত থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় অতীতে কোন এক সময় কৃষিজীবী সমাজ এ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিল। গাজনের মেলা ছাড়াও যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। মেলায় মাটি, বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা ইত্যাদি বিক্রি হয়। বিভিন্ন প্রকার খাবার, মিষ্টি, দই পাওয়া যায়। এক সময় মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল বায়োস্কোপ, সার্কাস ও পুতুল নাচ। এসব আকর্ষণে দূর গ্রামের দুরন্ত ছেলেমেয়েরাও মেলায় যাওয়ার বায়না ধরত। এ সময় হালখাতার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো, লাঠিখেলা, গান, আবৃত্তি, সঙযাত্রা, রায়বেশে নৃত্য, শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। বর্তমানে এসব আচার অনুষ্ঠানের বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। ঐতিহ্যের প্রতি টান থেকে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপন করে বাঙালী। এবার পৃথিবীর দুঃসময়। মানুষ বড় বিপদে। এই বিপদ, এই দুঃসময়কেও আজ বিদায় জানাবে বাঙালী। সে প্রত্যয় নিয়েই উদ্যাপিত হবে চৈত্রসংক্রান্তি।
×