ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর পলাতক পাঁচ খুনীকে ফেরাতে জোর কূটনৈতিক প্রয়াস

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ১৩ এপ্রিল ২০২০

  বঙ্গবন্ধুর পলাতক পাঁচ খুনীকে ফেরাতে জোর কূটনৈতিক প্রয়াস

বিকাশ দত্ত ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী পলাতক পাঁচ আত্মস্বীকৃত খুনীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। পলাতক খুনীরা যে দেশেই থাকুক না কেন তাদেরকে ফিরিয়ে এনে উচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করা হবে। ক্যাপ্টেন বরখাস্ত মাজেদের দন্ড কার্যকর করার পর বিষয়টি আরও জোরালো হয়েছে। উচ্চ আদালত রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। এর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। একজন মারা গেছে। আর বাকি পাঁচ খুনী এখনও পলাতক রয়েছে। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীগণ জনকণ্ঠকে বলেছেন, খুনীরা যে সমস্ত দেশে পলাতক আছে সেখানকার সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চলছে। আমরা আশা করছি এই পলাতক খুনীদের দেশে ফিরিয়ে এনে দন্ড কার্যকর করা হবে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পলাতকদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, নুর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে। অন্যদিকে খন্দকার আবদুর রশিদ ও শরিফুল হক ডালিমকে কখনও স্পেন ও কখনও পাকিস্তান এবং মোসলেমউদ্দিনকে জার্মানিতে দেখা গেছে বলে অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে। তবে রাশেদ চৌধুরী ও নুর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। বাকি পলাতক আসামিদেরও দেশে এনে তাদের রায় কার্যকর করব। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করা। আমরা জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে এনে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করব। আমাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। এখনও যারা পলাতক আছে, তাদের ধরে এনে এই রায় কার্যকর করার পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে একজনকে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে পেরেছি, এটা অনেক স্বস্তি। বঙ্গবন্ধুর খুনী বরখাস্ত ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তিনি। প্রথম কথা হচ্ছে রায় কার্যকর হয়েছে। এতে অবশ্যই আমার একটু স্বস্তি আছে। এরা হচ্ছে প্রকৃত খুনী। এদের সমাজে রাখাটাই উচিত না। আমরা যে এটা কার্যকর করতে পেরেছি, নিশ্চয় এটা আমাদের জন্য এক বিরাট স্বস্তির ব্যাপার। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, আমার সময়ও দুইজন নুর চৌধুরী ও রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে চেষ্টা হয়েছে। কিন্ত তাদের দেশে কিছু আইন আছে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিকে তারা দেশে পাঠায় না। তবু কূটনৈতিক চ্যানেলে আলাপ-আলোচনা চলছে। আমি আশা করি হয়তো সহসা অন্য পলাতক খুনীদেরও দেশে ফিরিয়ে আনা হবে এবং আদালতের দন্ড কার্যকর করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেছেন, পলাতক পাঁচ খুনীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। সব দেশেরই কিছু আইন থাকে। কোন কোন দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান নেই। যে কারণে তাদের ফিরিয়ে আনতে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আমি আশাবাদী আমরা কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে আনবে। অন্যদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেছেন, প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদের খুঁজে বের করতে হবে। আরও খতিয়ে দেখতে হবে এদের খুঁজে না পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কোন ব্যর্থতা আছে কিনা? সুপ্রীমকোর্টের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিনুদ্দিন মানিক বলেছেন, পলাতক পাঁচ খুনীকে দেশে ফিরিয়ে এনে দন্ড কার্যকর করলে ১৬ কোটি মানুষ শান্তি পাবে। আমি আশা করছি শীঘ্রই তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে এবং আদালতের দন্ড কার্যকর করা হবে। ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে রেড এ্যালার্ট জারি করে বাংলাদেশ পুলিশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাসায় সপরিবারে হত্যার শিকার হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। নির্মম সেই হত্যাকান্ডের অন্যতম আসামি আবদুল মাজেদ। মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএস) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকা-ের ঘটনায় ধানম-ি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ নবেম্বর খুনীদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিবৃত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নবেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেয়। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। পরে হাইকোর্টে তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল থাকে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রীমকোর্টের সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপীল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে পাঁচ আসামিকে নিয়মিত আপীল করার অনুমতি দানের লিভ টু আপীল মঞ্জুর করেন। ২০০৯ সালের ১২ নবেম্বর চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নবেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করে। ওইদিন (১৯ নবেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাঁচ আসামির দায়ের করা আপীল আবেদন খারিজ করা হয়। পরে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপীলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। সর্বশেষ ১১ এপ্রিল রাত ১২টা ১ মিনিটে ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
×