রশিদ মামুন ॥ সারাদেশে নিম্নআয়ের মানুষের কোন তালিকা না থাকাতে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম এবং দুর্নীতি হচ্ছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণে সরকার নিম্নআয়ের মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে জেনারেল রিলিফ (জিআর) চালু করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সারাদেশে জিআর বিতরণেই সবচেয়ে বেশি অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। কারণ এখানে কে পাবেন আর কাকে দিতে হবে এমন কোন তালিকা নেই। দেখা যাচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের ইচ্ছামতো রিলিফ বিতরণ করে বাকিটা আত্মসাত করছেন। প্রায় প্রতিদিনই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ এই অনিয়ম দুর্নীতির কারণে আটক হচ্ছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
সূত্র বলছে, সরকার প্রত্যেকটি জেলায় বিনামূল্যে বিতরণের জন্য জিআরএর চাল সরবরাহ করেছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে এই চালের বরাদ্দ পাচ্ছেন পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যারা। চেয়ারম্যানরা আবার এই চাল বিতরণ করছেন পৌর কমিশনার এবং ইউপি সদস্যদের মাঝে। এখানে ইউপি সদস্যরা কাকে চাল দেবেন তা ঠিক করে দেয়া হচ্ছে না। ফলে একজন ইউপি সদস্য যে চাল পাচ্ছেন তার কিছু বিতরণ করছে কিছু আত্মসাত করছে। এই চিত্র কোন নির্দিষ্ট একটি বা দুটি পৌরসভা অথবা ইউনিয়নের নয় বরং সারাদেশের। যার বেশির ভাগই থেকে যাচ্ছে অপ্রকাশিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি করোনা প্রতিরোধে যে ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে সেখানে প্রান্তিক মানুষে তালিকা প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছে। তালিকাটি প্রস্তুত হলে বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন কোন মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হবে তা বোঝা যাবে। এতে করে সাহায্যেরও সুষম বণ্টন হবে। কেউ অনেকবার পাবেন আর কেউ প্রয়োজন হলেও পাবেন না এমন হবে না।
ত্রাণ বিতরণে কোন অনিয়ম হলে ছাড় দেয়া হবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বারবার বলেছেন, এই পরিস্থিতির কেউ সুযোগ নিলে ছাড় দেয়া হবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও দলের নেতাকর্মীদেন সতর্ক করেছেন। তিনিও বলেছেন এ ধরনের অনিয়ম মেনে নেয়া হবে না। এরপরও প্রায় প্রতিদিনই করোনা মোকাবেলায় দেয়া সরকারের খাদ্য সহায়তা নিয়ে দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় সরকার কাঠামোর মধ্যে রয়েছে।
ইতোমধ্যে সারাদেশে ত্রাণের চাল বিতরণে অনিয়ম নজরে এসেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয় শনিবার জারি করা এক আদেশে বলেছে, ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ধরা পড়লে অস্থায়ীভাবে বহিষ্কারের পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে। মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব মোঃ এরশাদুল হক স্বাক্ষরিত ওই আদেশে ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ পেলে প্রমাণসহ তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসকদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে। ওই আদেশে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কারণে শহর ও গ্রামে বিপুল সংখ্যক মানুষের আয়- রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খাদ্য সহায়তা হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, সংস্থা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব অর্থায়নে ত্রাণকার্যক্রম যেমন- চাল, নগদ অর্থ, শিশু খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদেরও তৃণমূল পর্যায়ে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
খাদ্য বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ ধরনের দুর্যোগের সময় প্রতিবারই এমন অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধানে কোন দিনই কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। তিনি বলেন, চালগুলো একেবারে তৃনমূলে পৌরসভার কমিশনার এবং ইউপি সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। কিন্তু এই চাল কে পাবেন তার কোন তালিকা নেই। ফলে ব্যক্তি সৎ হলে সাধারণ মানুষ খাদ্য সহায়তা পান। আর অসৎ হলে তিনি খাদ্য সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি করেন। এই সমস্যা সমাধানে তৃণমূলের প্রান্তিক মানুষের একটি তালিকা থাকা প্রয়োজন। এ ধরনের তালিকা থাকলেও চালের বরাদ্দের সঙ্গে কে কতটুকু করে চাল পাবেন তার পরিমাণ উল্লেখ করে দিলে আর দুর্নীতি করার সুযোগ কমে আসে। কিন্তু সেই কাজটি করা হয় না। পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সবক্ষেত্রেই প্রভাবশালী হয়। ফলে সাধারণ জনগণ রুখে দাঁড়িয়ে এসব অন্যায়ের প্রতিকার চাইবে এমনটি ভাবা উচিত নয়।
সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীতে জিআর ছাড়াও মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের মাধ্যমে প্রান্তিক গ্রামীণ মহিলাকে ভিজিডির চাল দেয়া হয়। এছাড়া উৎসবের সময় ভিজিডি বিতরণ করা হয়। এই দুই প্রক্রিয়াতেই এতে একেবারে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করা হয়। কিন্তু এখানে আগে থেকে একটি তালিকা রয়েছে। এই তালিকা ধরে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়। খাদ্য সরবরাহ নীতিমালা অনুযায়ী একটি জায়গা থেকে খাদ্য সহায়তা পেলে আরেকটি জায়গা থেকে একই ব্যক্তি খাদ্য সহায়তা পান না।
সরকার যে ১০ টাকা কেজি করে চাল বিক্রি করে সেটির দুটি ধরন রয়েছে। এরমধ্যে সরকার খাদ্যবন্ধব কর্মসূচীর আওতায় সারাদেশের ৫০ লাখ পরিবারকে মাসিক ১০ টাকা দরে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল সরবরাহ করে থাকে। মার্চ থেকে এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর থেকে নবেম্বর এই দুই সময়ে পাঁচ মাস চালের দাম বেশি থাকার সময় এই সহায়তা দেয়া হয়। এখানেও তালিকাভুক্ত গ্রাহক রয়েছে। অর্থাৎ যারা সহায়তা পাবেন তারা আগে থেকে নির্দিষ্ট। এক্ষেত্রে অনেক ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি গোষ্ঠী এই সুবিধা ভোগ করেন। সঙ্গতকারণে অনিয়ম হলে তা প্রকাশ এবং প্রতিকার পাওয়া সহজ বলে দুর্নীতির পরিমাণ কমে আসে। খাদ্য অধিদফতর খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীতে ডিলারদের ৮টাকা ৫০ পয়সা দরে প্রতি কেজি চাল দেয়। ডিলার াযা ১০ টাকায় বিক্রি করেন।
এর বাইরে সরকার করোনার কারণে ১০ টাকায় চাল বিক্রির আওতা বাড়িয়েছে। এতে ডিলারদের আরও ৫০ পয়সা করে কমিশন বাড়িয়ে। কেজি প্রতি দুই টাকা কমিশন নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর আগে বিশেষ ওএমএস এ ৩০ টাকা দরে যে চাল বিক্রি করত এখন তা কমিয়ে ১০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে ২৪ ডিলার প্রতিদিন তিন টন করে চাল বিক্রির জন্য পাবেন। এছাড়া রাজশাহী, খুলনা এবং চট্টগ্রামে ১০ জন করে ডিলার রয়েছেন। প্রতিদিন যারা দুই টন করে চাল বিক্রির জন্য সরবরাহ পেয়ে থাকেন। রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা, গাজীপুরে নয়জন করে ডিলার রয়েছে তারা বিক্রি করতে পারেন প্রতিদিন দুই টন করে। এছাড়া ক শ্রেণীর পৌরসভায় পাঁচজন ডিলার দুই টন করে এবং খ শ্রেণীর পৌরসভায় চার ডিলার দুই টন করে চাল বিক্রি করার অনুমোদন প্রাপ্ত। এসব ক্ষেত্রেও কোন তালিকা নেই। যে আগে যাবেন সেই চাল পাবেন। তবে দুর্নীতির পরিমাণ এখানে কারণে সীমিত। খাদ্য অধিদফতর যে চাল দেন সেই চালের সমমানের চাল বাজারে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে চালের পরিমাণের চেয়ে লাইনে অনেক বেশি মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে।
কিন্তু এখানেও একটি তালিকা প্রস্তুত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ওয়ার্ডগুলোর কমিশনার এবং মেম্বারদের দিয়ে এই তালিকা প্রস্তুত করার কাজ শুরু করেছে। যা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এই তালিকা প্রস্তুত হলেও কিছু প্রান্তিক মানুষ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিজিএফ, ভিজিডি এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর পাশাপাশি ১০ টাকা কেজির চালের আওতা অনেক বড়। এই তিনটি তালিকার মধ্যে সমন্বয় করে প্রতিটি ওয়ার্ডের কমিশনরা বা সদস্যদের তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলে ১৫ দিনের মধ্যে একটি তালিকা তৈরি করা সম্ভব। বিশষে করে শহরে সময় সাপেক্ষ হলেও গ্রামে দ্রুত এই তালিকা তৈরি করা যাবে। এর ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের নাম উল্লেখ করে ত্রাণ পাঠালে তখন আর কেউ নয় ছয় করতে পারবেন না।
কোন কোন ক্ষেত্রেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা বলে থাকেন উপজেলা খাদ্য অধিদফতরের গুদাম থেকে চাল আনার জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ থাকে না। এজন্য উপকারভোগীদের চাল কম দেয়া হয়। কিন্তু উপকারভোগীদের চাল বিক্রি করে সেই খরচ মেটানোর বিধানও নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেবল ভিজিএফ এবং ভিজিডির চাল দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ দেয়া হয়। জেনারেল রিলিফের ক্ষেত্রে কোন পরিবহন খরচ দেয়া হয় না। তবে প্রত্যেকটি ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব তহবিল থাকে। যেখানে এসব খরচ মেটানোর অর্থ জমা থাকে। ফলে কোনভাবে ইজিআরের চাল বিতরণ করে আর্থিক সুবিধা নেয়ার কোন সুযোগ নেই।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: