ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছয় ডাক্তারকে সাময়িক বরখাস্ত নিয়ে তোলপাড়

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ১৩ এপ্রিল ২০২০

 ছয় ডাক্তারকে সাময়িক বরখাস্ত নিয়ে তোলপাড়

বিভাষ বাড়ৈ ॥ করোনার ভয়াবহতার মধ্যেই রোগীদের চিকিৎসা করতে অপারগতার অভিযোগ এনে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের ছয় চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে চিকিৎসকসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে। বরখাস্ত চিকিৎসকরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, তারা কখনই করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাননি। অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা দেশের এই সঙ্কটের মধ্যেই চিকিৎসকদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানোর পাঁয়তারা করছেন। ঘটনাকে অগ্রহণযোগ্য অভিহিত করে দ্রুত চিকিৎসকদের মনোবল ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ। একই কথা বলেছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ আ ফ ম রুহুল হকও। শনিবার রাতে হঠাৎ করেই করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে অপারগতার অভিযোগ এনে স্বাস্থ্য অধিদফতর ছয় চিকিৎসককে বরখাস্তের ঘোষণা দেয়। যাদের মধ্যে দিনের পর দিন পরিবার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে হোটেলে বসবাস করে করোনার চিকিৎসা দিচ্ছেন এমন চিকিৎসকরাও আছে। ভুলভাবে নাম দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে আদেশে। এরপরই শুরু হয়েছে বিতর্ক। ইতোমধ্যেই ঘটনা গড়িয়েছে সরকারের শীর্ষ মহল পর্যন্ত। ছয় চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্তের সুপারিশ করেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সেহাব উদ্দিন। বরখাস্ত হওয়া চিকিৎসকদের একজন শারমিন হোসেন রবিবার বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক স্যার আমাকে কোন টেলিফোন না করে বা কোন কিছু না জানিয়ে আমার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতরে নাম পাঠিয়েছেন যে আমি নাকি কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিতে ইচ্ছুক না। এমন কথা আমি মৌখিক বা লিখিতভাবে কখনও স্যারের কাছে অথবা কারও কাছে প্রকাশ করেছি বলে আমার জানা নেই। তিনি ১ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত কাজ করেন। রাতের পালার কাজ সেরে বাসায় ফেরেন সকালে। একদিন পর তিনি জানতে পারেন তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শারমিন হোসেন তার হাজিরা খাতার অনুলিপি নিয়ে রবিবার সকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ বেলাল হোসেনের সঙ্গে দেখাও করেন। দিনের পর দিন পরিবার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে হোটেলে বসবাস করে করোনার চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসক মুহাম্মদ ফজলুল হক। তিনি নিয়মিত হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছিলেন জানিয়ে বলেছেন, আমি উত্তরায় একটি হোটেলে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছি। এভাবে আমাকের বরখাস্ত করে অন্যায়ভাবে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) বেলাল হোসেন বলেছেন, ডক্টর শারমিন হোসেন তার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি শারমিনকে তার বক্তব্য লিখিতভাবে স্বাস্থ্য সচিবকে জানাতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সুপারিশে চিকিৎসকরা সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তদন্তের পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে তারা নির্দোষ। এদিকে ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। সরকারের বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা করে এবং গণমাধ্যমের কাছে অবিলম্বে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন খোদ করোনা প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান। তিনি অভিযোগ এনেছেন, করোনা নিয়ে কর্মকর্তারা দিনের পর দিন যে মিথ্যাচার করেছেন। তাদের ব্যর্থতার কারণে আজ এই সঙ্কট। তারা তাদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে এখন ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। ওরা আসলে সঙ্কট সৃষ্টি করতে এটা করেছে। এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলছি। যারা এই সঙ্কটের সময় বিশেষ একটি চক্র এ কাজ করেছে। এদিকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ রুহুল হক ঘটনাকে অগ্রহণযোগ্য অভিহিত করে বলেছেন, যা হয়েছে তা অন্যায়। আমি অবশ্যই সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। তিনি আরও বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ সঙ্কট তৈরি করছে। এর আগেও মন্ত্রণালয় থেকে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আদেশ দেয়া হয়েছিল। পরে প্রতিবাদে তা প্রত্যাহার করা হয়। এটা কোনভাবেই ঠিক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রাশেদা রওনক খান তার প্রতিক্রিয়া বলেছেন, ছয় চিকিৎসককে বরখাস্ত করে কি প্রমাণ করল স্বাস্থ্য প্রশাসন? এই যে আপনারা দিনের পর দিন বলে গেলেন সব প্রস্তুতি আছে, অথচ কিছুই প্রস্তুতি নেই, জেলা শহরগুলোতে ঠিকমতো একটা ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা নেই, করোনা রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই, জেলা-উপজেলায় টেস্ট করানোর কিট নেই, সিলেটে একজন ডাক্তার ভেন্টিলেটরের অভাবে নিজ ব্যবস্থায় এ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় আসেন চিকিৎসা নিতে, একটা এ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত দিতে পারে না, এসবের জন্য স্বাস্থ্য প্রশাসনের কাউকে কি দায়ী করা হয়েছে, বরখাস্ত তো পরের বিষয়! কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সাংবাদিক পেটানোর জন্য বরখাস্ত হয়নি, প্রশাসনের একজন বৃদ্ধ মানুষদের কান ধরে ছবি তোলার জন্য বরখাস্ত হয়নি, একজন উপসচিবের জন্য ফেরি আটকে রাখার ফলে তিতাস নামের ছেলেটি মারা যাওয়ার পরও দায়ী ব্যক্তির বরখাস্ত হয়নি, কিন্তু জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে করোনা চিকিৎসার সময় চিকিৎসকদের বরখাস্ত করে কি প্রমাণ করা হলো? নিজেদের দৈন্যতা? প্রবাসী সংবাদিক শওগাত আলী সাগর বলেছেন, এটা হেলথ ইমার্জেন্সি, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় নয়। একটা বিষয় সবারই পরিষ্কারভাবে বোঝা দরকার, সারা বিশ্বে এখন হেলথ ইমার্জেন্সি চলছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ কিন্তু বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করছে না, বা কোন রাজনৈতিক সঙ্কটও নয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এই সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারী উদ্যোগের একদম সামনের সারিতে আছেন চিকিৎসকরা। নেতৃত্বে যেমন আছেন, পরিকল্পনায় এবং সরাসরি হাসপাতালে চিকিৎসাতেও তারাই আছেন। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজটা কিন্তু তারাই করছেন। সমস্যার সমাধান না করে চাকরিচ্যুতি, বরখাস্তের মাধ্যমে চিকিৎসকদের মনে আতঙ্ক তৈরি করা যাবে, কিন্তু তার ফলটা ভাল হবে না। এটা হেলথ ইমার্জেন্সি, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় নয় এইটুকু বিবেচনায় নিলেই অনেক পদক্ষেপ সহজ হয়ে যায়। আশা করি সরকার সেভাবেই ভাববেন।
×