ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ১৬ জেলার জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা করোনার কারণে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আগামী বাজেটে সারে আরও ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি ;###;করোনা সংক্রমণ রোধে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ

এবার কৃষিতে প্রণোদনা ॥ পাঁচ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ১১:৪১, ১৩ এপ্রিল ২০২০

এবার কৃষিতে প্রণোদনা ॥ পাঁচ হাজার কোটি টাকা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ক্ষুদ্র-মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প খাতের পর এবার কৃষিতে প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন। ৫ হাজার কোটি টাকার এই প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় গ্রাম এলাকার ক্ষুদ্র চাষীরাও সহায়তা পাবেন। একই সঙ্গে করোনার কারণে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আগামী বাজেটে সারের ক্ষেত্রে আরও ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। রবিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ১৬টি জেলার জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, সংসদ সদস্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, সিভিল সার্জন এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সর্বশেষ প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টাব্যাপী মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবার গত বছরের তুলনায় বেশি, অর্থাৎ দুই লাখ টন চাল ক্রয় করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধান কাটা ও মাড়াই যান্ত্রিকীকরণের জন্য ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়কে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। এছাড়া বীজ, চারা রোপণের জন্য আরও দেড়শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। এখন সবচেয়ে বড় কথা মানুষ বাঁচানো। মানুষের জীবনযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া। দেশবাসীকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্যোগ আসে, সেই দুর্যোগ সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হয়। বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে, আমরা বিজয়ী জাতি। কাজেই করোনাভাইরাস থেকেও নিশ্চয়ই আমরা দেশকে সুরক্ষিত রাখতে পারব, মানুষকে সুরক্ষিত করতে পারব। এই অবস্থাও আমরা মোকাবেলা করতে পারব। তবে আপনারা সবাই সুরক্ষিত থাকুন, ভাল থাকুন, সেভাবেই নিজেদের নিজেরা সুরক্ষিত করেন। অযথা ঘোরাফেরা না করে ঘরে থাকুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেরা ভাল থাকুন, অন্যদের সুরক্ষিত রাখুন। ত্রাণ সরবরাহে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে এ ধরনের ঘটনার তাৎক্ষণিক শাস্তি বিধান করা হবে। কারণ এ ধরনের দুর্নীতি আমরা কখনই বরদাশত করব না। আর পহেলা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এবার তো আমরা যেভাবে জনসমাগম করতে পারব না। যেটুকু সীমিত আকারে ঘরে বসে করা যায়, সেটুকু করবেন, তবে জনসমাগম যেন না হয়। ইনশাল্লাহ, এ অবস্থা চলে গেলে সকল অনুষ্ঠানই আমরা ভালভাবে করতে পারব। তিনি দেশের একটি মানুষও যেন কষ্টে না থাকে, সেজন্য তালিকা তৈরি করে তাদের ঘরে ঘরে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেন। সকাল ১০টা থেকে বেলা সোয়া ১টা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী গণভবন প্রান্ত থেকে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬টি জেলার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং করোনা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া, প্রেস সচিব ইহসানুল এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ভিডিও কনফারেন্সে গণভবন প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন। কৃষিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ॥ এবার কৃষিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বিশেষ সহায়তা প্রদানের জন্য সর্বাধিক ৫ শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছি। কৃষি খাতে চলতি মূলধন সরবরাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার নতুন একটি পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করবে। এখান থেকে শুধু কৃষি খাতে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ দেয়া হবে। যার সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৫ শতাংশ। এই তহবিল থেকে গ্রাম অঞ্চলে যারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষী তাদের জন্য ঋণ দেয়া হবে। কৃষি, ফুল, ফল, মৎস্য, পোল্ট্রি, ডেইরি ফার্ম ইত্যাদি সকল কর্মকা-েÑ এখান থেকে সহায়তা পাবেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের কোন মানুষ যেন কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করছি। কৃষি মানে গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষী। কারণ আমাদের দেশের কৃষক শ্রমিক দিনমজুর থেকে শুরু করে কামার-কুমার তাঁতি জেলে সবার জন্য সাহায্য করতে আমরা প্রস্তুত। পাশাপাশি সারের ভর্তুকি হিসেবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৯ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হবে। যাতে কৃষকের উৎপাদন ব্যাহত না হয়। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ইতোমধ্যে শিল্প খাতের জন্য ৭২ হাজার কোটি টাকার বেশি কয়েকটা প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে বোরো ফসল উঠবে। কৃষক যেন সঠিক মূল্য পায় বিষয়টি লক্ষ্য রেখে খাদ্য মন্ত্রণালয় গত বছরের তুলনায় এবছর বেশি ধান চাল ক্রয় করবে। অর্থাৎ দুই লাখ টন চাল বেশি ক্রয় করবে, সেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ধান কাটা ও মাড়াই যান্ত্রিকীকরণের জন্য ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়কে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। এছাড়া বীজ, চারা রোপণের জন্য আরও দেড়শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। সরকারপ্রধান বলেন, কেউ পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ মসলা জাতীয় কিছু উৎপাদন করলে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার আরেকটি উদ্যোগ বর্তমানে চলমান রয়েছে। আগেই চালু এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। এছাড়া করোনাভাইরাসের ক্ষতি মোকাবেলায় বেশ কিছু প্রণোদনা দিয়েছি। শিল্প-কৃষি সব ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। করোনার কারণে অনেক উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় কথা মানুষ বাঁচানো। মানুষের জীবনযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা ॥ মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমরা যদি নিজেরা উৎপাদন ঠিক রাখি তাহলে এই সঙ্কট মোকাবেলা করতে পারব। এজন্য আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে, যাতে আমার দেশের মানুষ কষ্ট না পায়। পাশাপাশি আমরা অনেক দেশকে সহযোগিতা করতে পারি, রফতানি করতে পারি সেই বিষয়টা মাথায় রেখেই আপনারা ফসলের উৎপাদন বাড়াবেন। কারও এতটুকু জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। আপনারা বাড়ির পাশে এবং ছাদে টবের মধ্যেও গাছ লাগান। যেটাই উৎপাদন করবেন সেটাই কাজে লাগবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, অনেকেই তাদের ছোট ব্যবসাটুকুও করতে পারছে না। তাই যারা হাত পাততে পারে না তাঁদের সকলের ঘরে খাদ্য পৌঁছে দেয়ার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, কাজ না থাকায় অনেকে কাজ করতে পারছেন না, আবার রিলিফও চাইতে পারছেন না। এরকম বহু পরিবার রয়েছে। তাঁদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা আমরা ইতোমধ্যে নিয়েছি। সেটা সংশ্লিষ্টদের নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক এলাকায় পৃথক তালিকা তৈরি করে তাদের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিতে হবে। তিনি বলেন, ১০ টাকা কিলোয় চাল বিক্রি, ওএমএসের চালেরও দাম কমিয়ে দেয়া হয়েছে। কাজেই, আমাদের খাদ্যের কোন অভাব নেই বরং যথেষ্ট খাদ্যসামগ্রী রয়ে গেছে। সেটা আমরা প্রয়োজনে দিতে পারব। আর ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়ে যাওয়ায় এবং অনেকেরই হাতে কাজ না থাকায় দিনমজুর শ্রেণীর লোকজন ধান কাটায় সম্পৃক্ত হতে পারেন এবং সেই সুযোগ তাঁর সরকার করে দেবে। এ ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী ধান কাটা ও মাড়াইয়ে বিশেষ বরাদ্দ রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ শুরু হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। আমরা দেখেছি, অন্যান্য বছর ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যায় না। তবে এবার যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তারা এখন ধান টাকা ও মাড়াইয়ে কাজ করতে পারবেন। তারা কাজ করতে চাইলে সে ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। আর এই কাজের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে আমরা ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেবো। অর্থাৎ ধান কাটা ও মাড়াইয়ে মোট ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। ঘরে থাকুন, নিজেসহ অন্যকে সুরক্ষিত রাখুন ॥ মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী করোনা সংক্রমণরোধে সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নিজেদের রক্ষাটা নিজেকেই উদ্যোগ নিয়ে করতে হবে। সে ব্যাপারে সবাইকে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ যত কমানো যায় সেটাই ভাল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে কষ্টকর পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষ সুস্থ হয় এটা ঠিক। এখানে মৃতের হার পারসেনটিজ অনুযায়ী কম থাকলেও এটা মানুষকে ভোগায়, মানুষকে কষ্ট দেয়। বিশেষ করে বয়স্ক, যাদের হার্টের অসুখ আছে, কিডনির অসুখ আছে, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগ আছে তাদের জন্য খুব মারাত্মক এই ভাইরাসটি। দেশের মানুষকে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচাতে সবকিছু বন্ধ করা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই একটা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্ব স্থবির। স্বাভাবিক জীবন-যাপন সম্পূর্ণ স্থবির, সারা বিশ্বের মানুষ কিন্তু ঘরে বন্দী। আমরাও এই ভাইরাস থেকে দেশবাসীকে বাঁচানোর জন্য সব কর্মসূচী বন্ধ করে দিয়েছি। তাই সবাইকে অনুরোধ করছি আপনারা যার যার নিজের ঘরে থাকুন। আপনার ছেলে-মেয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘরে থাকুন। কারো সঙ্গে মেশার দরকার নেই। করোনা পরিস্থিতিতে সবার কষ্টকর জীবন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কষ্ট হচ্ছে সবার। কষ্ট লাঘবে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ২৩টি গাইড লাইন প্রস্তুত করেছে। এগুলো স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে দেয়া আছে। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে গণমাধ্যমে আমরা অনবরত প্রচার করে যাচ্ছি। সেসব বিষয়ে নজর দেবেন, মেনে চলবেন। সবাইকে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেকে মুখে মাস্ক ব্যবহার করবেন। এটা ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। মাস্ক ব্যবহার করলে নিজেকে অনেকটা সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। হাত না ধুয়ে চোখে মুখে হাত লাগাবেন না। হাঁচি-কাশি এলে কাপড়, রুমাল, টিস্যু ব্যবহার করেন অথবা আপনি কনুই দিয়ে হাঁচি-কাশি দেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে নিজ নিজ এলাকা সুরক্ষিত রাখতে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকে যার যার এলাকা সুরক্ষিত করেন। হঠাৎ করে বাইরে থেকে কাউকে যেতে দেবেন না। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের এখানে একটা জেলা থেকে এখন অন্য জেলায় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। অন্তত এ কয়েকটা দিন আপনারা আপনার নিজের এলাকাকে সুরক্ষিত করেন। আর কেউ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অকারণে ছুটোছুটি করবেন না। কেউ শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাবেন, এটা পরে গেলেও পারেন। কেউ বাড়িতে যাবেন, পরে গেলেও পারেন। এগুলো এখন অন্তত আপাতত বন্ধ রাখেন। বন্ধ রেখে অন্তত আমরা এই অবস্থা থেকে উত্তোরণ ঘটাতে পারি, সেজন্য সবাই সহযোগিতা করুন। দেশবাসীকে উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা সবাই নিজেরা সবাই সুরক্ষিত থাকেন, সুস্থ থাকেন, ভাল থাকেন। সেভাবে নিজেরা নিজেদের সুরক্ষিত করেন। যে নির্দেশনাগুলো আমরা দিয়েছি আর স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে দেয়া হচ্ছে বা প্রতিনিয়ত বেতার-টেলিভিশন বা সোশ্যাল মিডিয়াতে যেগুলো নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে- দয়া করে সেগুলো একটু মেনে চলুন। এটি মেনে চললে নিজে যেমন ভাল থাকবেন, অপরকে আপনি সুরক্ষিত করবেন। আপনার নিজের দায়িত্ব নিজের ওপর যেমন আছে, আবার অন্যের জন্যও সে দায়িত্ব আছে। সে কথাটা সবাইকে মনে রাখতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান আরও বলেন, যেটি আপনার (জনগণ) অধিকার, সেটি অপরের যেমন দায়িত্বভার, আপনার দায়িত্ব যেটি অন্যের অধিকার, কাজেই সকলের বেঁচে থাকার অধিকার আছে। কিন্তু আপনার নিজেই সেটা করতে পারেন। আর প্রত্যেকে যার যার এলাকা সুরক্ষিত করেন। তিনি বলেন, বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে, আমরা বিজয়ী জাতি। কাজেই করোনাভাইরাস থেকেও নিশ্চয়ই আমরা দেশকে সুরক্ষিত রাখতে পারব, মানুষকে সুরক্ষিত করতে পারব। এই অবস্থাও আমরা মোকাবেলা করতে পারব। তিনি এ সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের এবং বাংলাদেশে যেন কেউ ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন এবং কেউ ঢুকে পড়লে তাকে সেখানেই কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ প্রদান করেন। দেশবাসীকে সম্পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে ॥ অদৃশ্য শক্তির মতো করোনা বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস সম্পর্কে দেশবাসীকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এটি সংক্রামক। কখন সংক্রমিত হবে তা বোঝা খুব কষ্টকর। এটাই হচ্ছে এ ভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, অদৃশ্য শক্তির মতো করোনাভাইরাস আমাদের ভেতরে হানা দিয়েছে। এ ভাইরাসে শুধু একটি দেশ নয়, পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে। করোনাভাইরানের কারণে দেশে-বিদেশে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাবিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৩ হাজারের মতো মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছেন এবং লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। বিভিন্ন উন্নত দেশ এটা মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। সেসব দেশে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা সারাদেশে এ ভাইরাস মোকাবেলায় কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছি। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু খুব কম থাকলেও এটা মানুষকে ভোগায় বেশি। এ ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য সব কর্মসূচী বন্ধ করে দিয়েছি। সবাই ঘরে থাকুন। বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। জানি, মানুষের কষ্ট হবে কিন্তু আমরা করণীয় করে যাচ্ছি। এজন্য আমরা ২৩টি নির্দেশনা তৈরি করেছি। প্রধানমন্ত্রী এ সময় সর্দি-কাশি হলে সকলকে প্রচুর গরম পানি খাওয়ার এবং ঘরে থাকারও পরামর্শ দিয়ে বলেন, হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন খোলা হয়েছে। করোনা রোগীর জন্য হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ড করে দিয়েছি। সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছি। তাঁর সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের সংবাদমাধ্যম অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে সচেতনতামূলক জিনিস প্রচার করে যাচ্ছে। খোলা মাঠে হাট-বাজার ॥ করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে হাট-বাজারগুলোকে মাঠ বা খোলা জায়গায় নেয়ার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সামাজিক দূরত্বে নিশ্চিতে হাট-বাজারগুলোকে মাঠ, বড় রাস্তা বা খোলা কোন জায়গায় নেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাজারেও সেই দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। যেখানে হাট হয়, হাটগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ না রেখে কোন বড় মাঠ থেকে সুনির্দিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করে দূরত্ব বজায় রেখে রেখে হাটে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে এটা করলে মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হবে এবং সংক্রমণ ছড়াবে কম। মাঠ বা খোলা জায়গায় দূরত্বটা বজায় রেখে যার যার পণ্য নিয়ে বসবে। সবাই সেখান থেকে কিনে নিয়ে চলে যাবে। কোন ভিড় যেন না হয়। সে বিষয়ে সকলকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। কৃষি পরিবহন ও কৃষকদের ফসল তুলতে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা মিলিতভাবে এবং পরিকল্পনা করে যদি এ ধরনের উদ্যোগ নেন তাহলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যত কমানো যায়, সেটিই ভাল। ফসল তরি-তরিকারি, ফলমূল আর নষ্ট হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। কারণ এগুলো বিক্রয় কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য তাঁর সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি এ সময় সাতক্ষীরার সঙ্গে মতবিনিময়কালে দুধের মূল্য নিশ্চিত করতে এটি রিলিফে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণে এবং দুগ্ধজাত সামগ্রী প্রস্তুত করে এই দুধকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণেরও আহ্বান জানান। নববর্ষের সব অনুষ্ঠান বন্ধ ॥ প্রধানমন্ত্রী নববর্ষের সব অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে জানিয়ে বলেন, বাংলা নববর্ষে বাইরে কোন প্রোগ্রাম করা যাবে না। ঘরে বসে বেতার-টেলিভিশনে অনুষ্ঠান হবে বা স্যোশাল মিডিয়ায় উদযাপন করা যাবে। কিন্তু কোন জনসমাগম করা যাবে না। জনসমাগম করলে এই ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবে। সব অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কোথাও কোন ধরনের লোক সমাগম না করতেও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, বাড়তি সমাগমের কারণে কোথাও কোথাও করোনার সংক্রমণ হয়েছে। অনেক জেলায় এরই মধ্যে সংক্রমণ হয়েছেন। তাই আপনারা নববর্ষের অনুষ্ঠান ঘর করেন। উৎসব পরিবার নিয়ে করেন। আমরা সেটিই চাই। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে যেসব স্বাস্থ্য উপকরণ ব্যবহার করা হয় সেগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্যোগ নিতে পারে। আর খাবারের দোকানপাট সীমিত সময়ের জন্য খোলা রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যাতে বাসা-বাড়িতে দরকার হলে খাবার সরবরাহ করা যায়। এতে কিছু লোকের কর্মসংস্থান হবে। ভিডিও কনফারেন্সে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উপস্থিত একজন ইমাম জানান, তাঁরা নির্দেশনা অনুযায়ী জুমার নামাজ দশজনে পড়েছেন এবং ওয়াক্তর নামাজে পাঁচজনের বেশি উপস্থিতি রাখছেন না। এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসলে সবাইকে দোয়া করতে হবে। যেন এ করোনাভাইরাস থেকে আমরা রক্ষা পাই। আপনারা জানেন, সৌদি আরবে পবিত্র মক্কা এবং মদিনাতেও কারফিউ দিয়ে দেয়া হয়েছে। আর ঘরে বসে দোয়া করলেও আল্লাহ সে দোয়া কবুল করবেন। কাজেই, ঘরে বসে যত বেশি দোয়া পড়া যায়। আর এখন তো কাজ নেই বেশি। কাজেই, বেশি বেশি করে দোয়া করতে হবে। যাতে আল্লাহ আমাদের এ বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
×