ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ॥ সমস্যা ও সমাধান

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ১৩ এপ্রিল ২০২০

উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ॥ সমস্যা ও সমাধান

(গতকালের পর) বাংলাদেশে স্বাক্ষরতার হার শতকরা ৭২ এর কিছু বেশি। এদের মধ্যে মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কত তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তাই উচ্চতর আদালতের রায় বাংলায় প্রদান করলে শতকরা ৭২ জন লোকই যে পড়তে পারবে সেটি বলা যায় না। এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে তাই এমনকি বাংলায় লেখা রায়ের মর্মার্থ বুঝতে হলে শিক্ষিত একজনের সাহায্য নিতে হবে। আর ইংরেজীতে রায় দিলে তা পড়ে এর মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করার মতো মানুষের সংখ্যা শতকরা কুড়ি জনের বেশি হবে বলে মনে হয় না। কিছুদিন পূর্বে দৈনিক প্রথম আলোতে সাংবাদিক মহিউদ্দীন ফারুকের একটি লেখা বেরিয়েছিল। সমীক্ষাধর্মী লেখা। আদালতে বাংলায় রায় দেয়ার ওপর লেখাটি অনেকের মতো আমারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। লেখাটিতে বেশ কয়েকজন বিচারপতির নাম তিনি উল্লেখ করেছেন যারা কিছু কিছু রায় বাংলায় দিয়েছেন। সে তালিকায় আমার নামও রয়েছে। তবে বাংলায় রায় প্রদানের সংখ্যার দিক থেকে আমার অবস্থান খুব ভাল নয়। আমি বিনয়ের সঙ্গে আমার এ দুর্বলতা মেনে নিচ্ছি। তবে মহিউদ্দীন ফারুক যদি প্রদত্ত রায় ও আদেশের সংখ্যা পৃথক পৃথকভাবে দেখাতেন তাহলে ভাল হতো। উচ্চ আদালতের দেয়া আদেশের পরিধি দুই-তিন বাক্যে বা এক স্তবকে বা দেড় স্তবকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু রায়ে অনেক প্রাসঙ্গিক আইনি প্রশ্নে সিদ্ধান্ত দিতে গিয়ে লিখতে হয় অনেক কিছু। ঘটনার বিবরণ, উভয় পক্ষের বক্তব্য, যুক্তিসমূহ এবং সর্বোপরি বিচারকের নিজস্ব মতামত, পর্যবেক্ষণ ও সবশেষে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। তাই কোন আদেশের চেয়ে একটি রায়ের পরিধি অনেক বিস্তৃত। উচ্চতর আদালতের বার্ষিক কর্মদিবস হলো ১৮০ থেকে ১৮৫ দিন। এর মধ্যে কেউ ছুটি নিতে পারেন বা অসুস্থ হতে পারেন। দশ বছরে এই কর্মদিবসের সংখ্যা আঠারশত থেকে আঠারশত পঞ্চাশ দিন। কোন বিচারক প্রতিদিন যদি একটি করে রায় দেন তবে দশ বছরে তার প্রদত্ত রায়ের সংখ্যা আঠারশত বা আঠারশত পঞ্চাশ এর বেশি হবে না। তবে গড়ে প্রতিদিন একজন বিচারকের পক্ষে একটি করে রায় লেখা খুবই দুরূহ। পক্ষান্তরে প্রতিদিন আদেশ দেয়া যেতে পারে ভূরি ভূরি। দেয়াও হয়ে থাকে তাই। লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের বিচারাঙ্গনে একটি প্রশ্ন প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে। আমরা কি চাই? মানসম্মত রায় না কি শুধু বাংলায় লেখা রায়? আমাকে উত্তর দিতে বললে আমি বলব দুটিই চাই। কারণ বাংলা ভাষায় যেমন রায় দেয়া প্রয়োজন ঠিক তেমনই প্রয়োজন উচ্চ মানসম্মত রায় দেয়া। বাংলা ভাষায় কি মানসম্মত রায় দেয়া যায় না? নিশ্চয়ই যায়। সাবেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বাংলায় লেখা বেশকিছু রায় অত্যন্ত মানসম্মত। আমাদের যে সকল মাননীয় বিচারকগণ এখন বাংলায় রায় লিখছেন তারা অবশ্যই একটি মহৎ কাজ করছেন। বাংলায় লেখা তাদের অনেক রায়ই হয়তো বেশ মানসম্মত। তবে এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, এখনও অধিকাংশ মানসম্মত রায় ইংরেজী ভাষাতেই প্রদান করা হচ্ছে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, রায়ের মান খারাপ হলে তা ইংরেজীতেই হোক আর বাংলাতেই হোক এর সমালোচনা শুনতেই হয়। আমাদের ভুললে চলবে না যে, কোথাও লেখা থাকুক আর নাই থাকুক দীর্ঘ অনুশীলন ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ইংরেজী কিন্তু আমাদের কর্মক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভাষার স্থান করে নিয়েছে। কারণ আমরা দেখছি যে, আমাদের দৈনন্দিন বিচারিক কর্মযজ্ঞে ইংরেজীর যে ব্যবহার তার পরিধি কম নয়। আমাদের সরকার কর্তৃক প্রকাশিত আইন বইয়ের সংকলন (Bangladesh Code) এর ৪২ খন্ডের মধ্যে এখনও ২৫ খন্ড ইংরেজীতে লেখা। আমাদের এই আইন পেশার প্রধান চারটি বই ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড ১৮৯৮, পেনাল কোড ১৮৬০, সিভিল প্রসিডিওর কোড ১৯০৮ ও এভিডেন্স এ্যাক্ট ১৮৭২। এই চারটি আইনের কোনটিই সরকারীভাবে বঙ্গানুবাদ করা হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ কেউ করেছেন কিন্তু সেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। বিচারিক কার্যক্রমে পক্ষগণ কর্তৃক উপস্থাপিত বিশ্বের যে সকল দেশের নজির আমরা পর্যালোচনা করি সেগুলোও ইংরেজী ভাষার। ইংরেজী ভাষা না জানা অনেক দেশের বিচার ব্যবস্থাও অনেক উন্নত। ফরাসী বিচার ব্যবস্থা, জার্মান বিচার ব্যবস্থাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত অনেক দেশের বিচার ব্যবস্থা বেশ উন্নত। কিন্তু যেহেতু, তাদের নিজস্ব ভাষায় আমাদের বিচারকদের বা আইনজীবীদের কোন বু্যুৎপত্তি নেই তাই আমরা সে দেশগুলোর বিচারের কোন নজির আদালতে উত্থাপিত হতে দেখি না। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের মানসম্মত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষকবৃন্দ পাঠদান করেন তারা প্রায় সবাই বিদেশের নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী মাধ্যমে লোখাপড়া করে এসে ও উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে এসে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা পেশায় নিবেদিত থাকেন। তাদের অর্জিত নিজস্ব শিক্ষার একটি প্রভাব ছাত্রদের ওপর পড়বেই। আমাদের দেশে দেশীয় শিক্ষা পদ্ধতির পাশাপাশি ইংরেজী মাধ্যমেও লেখাপড়া করা যায়। এতে সরকারী কোন বিধিনিষেধ নেই। আমাদের যে সকল ছেলেমেয়ে ইংরেজী মাধ্যমে পড়ালেখা করে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, ডক্টরেট বা ব্যারিস্টারি সনদ নিয়ে আসছে তাদের বিষয়টিও মাথায় রাখা প্রয়োজন। তাদের অধিকাংশই চায় দেশে এসে আইনপেশা শুরু করতে। আমরা যদি এখনই আদালত পাড়া থেকে ইংরেজীকে বিতাড়িত করি তবে এদের ভবিষ্যত কি হবে? কষ্ট করে হয়ত কেউ কেউ টিকে যাবে তবে অধিকাংশই বিদেশে পাড়ি জমাবে। এটি অবশ্যই দেশের জন্য খুব একটা কল্যাণ বয়ে আনবে না। সার্বিক মেধায় একটা বৈকল্য সৃষ্টি হবে। চলবে... লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২
×