ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস কোন্ প্রজন্মের উপর কেমন প্রভাব

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ১৩ এপ্রিল ২০২০

করোনাভাইরাস কোন্ প্রজন্মের উপর কেমন প্রভাব

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে করোনাভাইরাস। পুরো পৃথিবীকে একই সঙ্গে একই সময়ে উল্টে-পালটে দিচ্ছে। ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, বড়-ছোট, কেউই তার কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। তাই এই কোভিড-১৯ রোগটি রয়েছে প্রত্যেকের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও আমাদের প্রতিটি প্রজন্মের চিন্তাধারা ও চিন্তার বিষয়গুলো কিন্তু এক নয়। এরই জন্য কোভিড-১৯ একেকটি প্রজন্মের ওপর প্রভাব ফেলছে একেকভাবে, তাদের বদলে দিচ্ছেও ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। তবে চলুন দেখে আসা যাক, কোন্ প্রজন্মের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে করোনাভাইরাস। বয়োজ্যেষ্ঠ করোনাভাইরাসের এই মহামারী শুরু এবং লকডাউনের ঘোষণা আসার পর থেকে যাদের ঘরে আটকে রাখতে এবং তাদের অন্যান্য আচরণ পরিবর্তন করাতে গিয়ে আমরা সকলেই কম-বেশি হিমশিম খেয়েছি, তাদের মনে হয় আমরা সবাই চিনি। আপনারা ঠিকই অনুমান করেছেন, তারা হচ্ছেন আমাদের পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা। অর্থাৎ আমাদের বাবা-চাচা বা দাদা-নানারা। প্রজন্ম গবেষকরা এদের বলে থাকেন বেবি বুমার। এদের জন্ম মূলত ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালের মাঝে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। বেবি বুমারদের বয়স বর্তমানে ৫৬ থেকে ৭৪ বছর। তারা ইতোমধ্যেই তাদের জীবনে অনেক কিছু দেখে এসেছেন, বহু প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তারা যুদ্ধ পরবর্তীকালীন দুর্ভিক্ষ দেখেছেন, বিভিন্ন রোগের মহামারী দেখাও তাদের জন্য এবার প্রথম নয়। কিন্তু যেভাবেই হোক এসব প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে আজ জীবনের এই পর্যায়টিতে পৌঁছেছেন। তাই তাদের অনেকেই মনে করছেন, এই বিপদটিও তাদের না ছুঁয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। এ জন্য কিছুটা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বেশিরভাগই নারাজ। তার ওপর জীবনের এতটা পথ তাদের নিজেদের জোরে কাটিয়ে দেয়ার পর, অনেকেই তাদের দৈনন্দিন জীবনে অন্যদের বাড়তি হস্তক্ষেপ পছন্দ করেন না, আর সেই অন্য ব্যক্তিটি তার পরিবারের খুব কাছের সদস্যই বা হোক না কেন। তাদের মনোভাব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকটা এমন থাকে যে, ‘পৃথিবী কি তুমি আমার থেকে বেশি দেখেছ না আমি তোমার থেকে বেশি দেখেছি!’ তবে অন্যদিকে আবার পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, করোনাভাইরাসের খবর রাখার ক্ষেত্রে এবং এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার ক্ষেত্রে বেবি বুমাররাই অন্য প্রজন্মের থেকে এগিয়ে রয়েছেন। যেমন, ৮৫% বেবি বুমার নিয়মিত করোনাভাইরাসের খবর রাখেন, যেখানে প্রজন্ম-এক্স রাখেন ৭৬%, মিলেনিয়াল এবং প্রজন্ম-জেড রাখেন ৬১%। আবার, দুশ্চিন্তার দিক থেকেও দেখা যায়, তারাই এগিয়ে রয়েছেন। যেমন- করোনাভাইরাস নিয়ে বেবি বুমারদের দুশ্চিন্তার হার হচ্ছে ৬৩%, যেখানে, প্রজন্ম-এক্সদের ৫৪%, মিলেনিয়ালদের ৫০% এবং প্রজন্ম-জেডদের ৪৪%। তাহলে, এত খবর রাখা এবং দুশ্চিন্তার পরেও ঘরে থাকার ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য নিয়ম মানার ক্ষেত্রগুলোতে কেন তাদের এতটা অনীহা? কারণটা আসলে খুবই সাধারণ। প্রথমত, এদের অনেকেই এখন অবসরে চলে যাবার কারণে এ মুহূর্তে খবর দেখা এবং দুশ্চিন্তা করা ছাড়া আর বেশি কিছু আসলে তাদের করার নেই। আর দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে তাদের আলট্রুুইজম এবং বয়োজ্যেষ্ঠতা। পরিবারের বড় হওয়ায় এবং এখনও তাদের অনেকের শরীরে কিছুটা শক্তি থাকায়, পরিবারের অনুজ সদস্যদের আদেশ মেনে চলা তাদের জন্য কিছুটা কঠিন। মধ্যবয়সী এবার চলুন কথা বলা যাক যারা এই মুহূর্তে অনেকটা স্যান্ডউইচের মাঝের পেটির মতো অবস্থায় আছেন, প্রজন্ম এক্সকে নিয়ে। তাদের জন্ম ১৯৬০ থেকে ১৯৭৯ সালের মাঝে। সুতরাং তাদের বয়স বর্তমানে ৪০ থেকে ৬০ এর ঘরে। এই মানুষগুলো বর্তমানে বিভিন্ন ব্যবসা এবং ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মালিক হিসেবে রয়েছেন। তাদের অধিকাংশের ঘরেই আবার একদিকে বয়স্ক বাবা-মা, অপরদিকে স্কুল কলেজে পড়ুয়া সন্তান রয়েছে। তাই একই হাতে তাদের ঘর এবং বাইরে দুটোই সামলাতে হচ্ছে। আবার ঘরেও যে তাদের একদিক সামলালে হচ্ছে, তা নয়। যাদের একই সঙ্গে বুমার বাবা-মা এবং স্কুল পড়ুয়া সন্তান রয়েছে, তাদের কিন্তু একই সঙ্গে দু’জনের সমান খেয়াল রাখতে হচ্ছে। যেহেতু বুমাররা এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন, তার ওপর অনেকেই কথা শুনতে চান না, তাই এ সময়ে তাদের খেয়াল রাখাটা বেশ চাপের ব্যপার। আর এর সঙ্গে যদি স্কুল পড়ুয়া সন্তান থাকে, তবে তো কথাই নেই। একদিকে তাদের মহামারীটির ভয়াবহতা বোঝানো বেশ কঠিন ব্যাপার, তার ওপর তারা যেন বেশি আতঙ্কিত হয়ে না যায়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হয়। তাই ঘরেও প্রজন্ম-এক্সদের বেশ উভয় সঙ্কটের মাঝে কাটাতে হচ্ছে। এতক্ষণ তো হচ্ছিল শুধু ঘরের কথা। এবার বাইরের ব্যাপারটাও একটু চিন্তা করা যাক। এই মুহূর্তে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চাকরির ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের মানুষগুলো কিন্তু নেতৃত্বস্থানীয় জায়গাগুলোতে রয়েছে। তাই এই সঙ্কটময় সময়টিতে সবাই তাদের দিকেই পরবর্তী নির্দেশনাগুলোর জন্য তাকিয়ে রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজারে ধস নামার রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা, বিভিন্ন কল-কারখানা লম্বা সময়ের জন্য বন্ধ রয়েছে এবং সামনে থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে। এই মুহূর্তে তারা এই জিনিসগুলো কীভাবে সামাল দেবেন, তার নেতৃত্ব কিন্তু তাদের হাতেই রয়েছে। তাই এ সময় তাদের বেশি চাপে থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই প্রজন্মের মানুষগুলো তাদের ক্যারিয়ারের শুরুতে প্রথমে ৯/১১ এর সময়ের অর্থনৈতিক ধসটি এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের স্টক মার্কেট ক্র্যাশের কারণে অর্থনৈতিক মন্দাটিও দেখে এসেছেন। এ কারণে প্রজন্ম-এক্সের মানুষেরা তাদের পরবর্তী মিলেনিয়াল এবং প্রজন্ম-জেডদের তুলনায় এসব ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞতাসম্পন্নই বলা চলে। তবে, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি তাদের দেখা পূর্ববর্তী সঙ্কটগুলোর সঙ্গে কতটা সদৃশ হবে এবং পূর্বলব্ধ জ্ঞান তারা কতটা কাজে লাগাতে পারেন, এটাই এখন দেখার বিষয়। মিলেনিয়ালস ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মাঝে জন্মগ্রহণকারীদের বলা হয়ে থাকে মিলেনিয়ালস। মিলেনিয়ালদের বয়স বর্তমানে ২৪ থেকে ৩৯ এর মাঝে। অর্থাৎ তাদের অনেকেই এখন তাদের ক্যারিয়ার শুরু করে দিয়ে একটি সুপ্রতিষ্ঠ অবস্থায় রয়েছেন, আবার অনেকে তাদের শিক্ষা জীবনের শেষের দিকে বা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে রয়েছেন। অনেক মিলেনিয়ালরা আবার তাদের পারিবারিক দিক দিয়েও সুপ্রতিষ্ঠিত এবং কারও কারও হয়ত ছোট সন্তানও রয়েছে, আবার অনেকে হয়ত মাত্র তাদের পরিবার শুরু“করার কথা ভাবছেন। মিলেনিয়ালরা বর্তমানে একটি পরিণত বয়সে চলে এসেছেন এবং এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে তারা আসলেই তাদের এই পরিপক্বতার ছাপ রেখে চলেছেন। গবেষকরা বলছেন, কেউ যদি এই করোনাভাইরাসকে নির্মূল করতে পারে, তারা মিলেনিয়ালরাই হবে। ইতিবাচক আচরণগত পরিবর্তন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘরে থেকে কাজ করা, সব দিক থেকেই অন্য প্রজন্মের তুলনায় মিলেনিয়ালসরা এগিয়ে আছেন। পরিসংখ্যান বলছে, সামজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে ৯০% মিলেনিয়াল সঠিকভাবে এটি মেনে চলছেন। এরপর আছেন প্রজন্ম-এক্স, তাদের ৮৫% সঠিকভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন, এরপর বেবি-বুমারদের ৭৯% এবং প্রজন্ম-জেডদের ৭৪% সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটি মেনে চলছেন। এ ছাড়াও ঘরে থেকে কাজ করা, গণপরিবহন ব্যাবহার না করা, বিভিন্ন সমাজসেবামূলক পদক্ষেপগুলো নেয়ার ক্ষেত্রগুলোতেও মিলেনিয়ালরাই এগিয়ে রয়েছেন। পরিসংখ্যানের তথ্য অনুসারে ৪৮% মিলেনিয়াল ঘর থেকে কাজ করছেন। এরপর আছে প্রজন্ম-এক্স, তাদের ৪৫% ঘর থেকে কাজ করছেন, জেনারেশন জেডদের ক্ষেত্রে ৪১% ঘর থেকে কাজ করছেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই বেবি-বুমাররা আছেন এক্ষেত্রে একদম নিচে, তাদের ২৭% ঘর থেকে কাজ করছেন। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে মিলেনিয়ালরা বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন- সমাজসেবামূলক কাজগুলো, অন্যদের সচেতন করা, নতুন ধরনের সময়োপযোগী পদক্ষেপগুলো নেবার ক্ষেত্রেও এই প্রজন্মের মানুষদেরই নেতৃত্ব দেখা যাচ্ছে। প্রজন্ম-জেড বর্তমান এই সময়টিতে যেই প্রজন্মটি সবচেয়ে বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে, তারা প্রজন্ম-জেড। প্রজন্ম-জেডদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মাঝে। সুতরাং জেনারেশন জেডদের মাঝে যারা সবচেয়ে বড় তাদের বয়স এখন ২৩ এবং যারা সবচেয়ে ছোট, তাদের বয়স হচ্ছে ৮ বছর। এদের প্রত্যেকেই এখন স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রেও যে প্রজন্মটির সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, তারাও সম্ভবত এই প্রজন্মেরই মানুষ। ব্যাপারটি একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়। এ প্রজন্মের বড় একটি অংশ এনখও কিশোর-কিশোরী বা তার থেকেও ছোট। প্রতিদিন এদের বড় একটি সময় এতদিন কাটত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। তাই হঠাৎ করে তাদের থেকে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা তাদের জন্য একটি বেশ চাপেরই ব্যাপার। এ ছাড়াও এদের অনেকে যেহেতু এখন বয়সে ছোট, তাই এই পরিস্থিতিটির ভারিত্ব বোঝাও তাদের পক্ষে এখনও সম্ভব হচ্ছে না। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, এই করোনাভাইরাসের সঙ্কটটি প্রজন্ম-জেডের জন্য অনেকটা ৯/১১ পরবর্তী সময়ের মতো ভূমিকা পালন করবে। এই ঘটনাটি তাদের মনে এবং জীবনে দীর্ঘদিনের জন্য একটি ছাপ রেখে যাবে যেমনটি ৯/১১ প্রজন্ম-এক্স এবং মিলেনিয়ালদের ক্ষেত্রে রেখেছিল। বদলে যাবে সবাই! তবে যে প্রজন্মের সদস্যই হোক না কেন, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের এই মহাসঙ্কট বদলে দেবে সবাইকেই। কারণ, এমন দুর্যোগ খুব কমই দেখা গেছে, যখন হাসপাতালে হাসপাতালে দেখা যাচ্ছে বেডের সঙ্কট, পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক ও পিপিই পাওয়া যাচ্ছে না, ভেন্টিলেটর পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো পৃথিবীই যেন একসঙ্গে থমকে গেছে। তবে মনে করা হচ্ছে, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবটা পড়বে মূলত মিলেনিয়ালস এবং প্রজন্ম-জেডদের ওপরই। তাদের বর্তমান জীবনযাত্রা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুর ওপরই এই সময়টির একটি গভীর ছাপ থেকে যাবে। এখন এই পরিবর্তনটি কেমন করে তাদের মাঝে আসে, এটি দেখাই সময়ের ব্যাপার। তবে আমরা সকলেই আশা করব, এই করোনাভাইরাস যেমনভাবে পুরো বিশ্বকে একসঙ্গে আক্রমণ করেছে, তেমনি যেন পুরো বিশ্বকে একসঙ্গে ভালর জন্য বদলে দেয়। মানুষ যেন তাদের সীমা বুঝতে পারে। সবকিছু ভুলে গিয়ে শুধু নিজের জন্য বাঁচতে গেলে প্রকৃতিও যে ছাড় দেয় না, এটি বুঝতে পেরে তারা যেন পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণের কথা মাথায় রেখে নতুন আঙ্গিকে নিজেদের জীবনকে গড়ে তোলে।
×