ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জীব-জন্তু ও পাখির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ঘ্রাণ

প্রকাশিত: ১০:৪১, ১১ এপ্রিল ২০২০

জীব-জন্তু ও পাখির  জীবনে গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখে ঘ্রাণ

আবু জাফর সাবু ॥ বন্যপ্রাণী ও পাখিরা তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুধু কণ্ঠেই নয় নানাভাবে সঙ্কেত প্রদান করে থাকে। প্রাণী ও পাখি বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পেরেছেন ঘ্রাণের ভাষা, নাচের ভাষা এবং ধ্বনির ভাষা ছাড়াও পশুপাখির আরও অনেক ভাষা এবং সঙ্কেতের নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে। এদের মধ্যে প্রাণীদের গন্ধের ভাষা অন্যতম। বন্যপ্রাণী, কীটপতঙ্গ ও পাখিদের যে গন্ধের ভাষা রয়েছে, তা দিয়ে তারা স্বজাতি বা স্বগোত্রের প্রাণীকে অনেক তথ্য জানিয়ে দিতে পারে এবং নিজেদের মধ্যে তথ্যের বিনিময় করতে পারে। শুধু তাই নয়, খাবার খুঁজে বের করতেও প্রাণী ও কীটপতঙ্গকে সহায়তা করে থাকে এই গন্ধ। এ ছাড়া শত্রুর গায়ের গন্ধ থেকেও আগেভাগেই সচেতন হতে পারে প্রাণীরা। সে জন্য জীবন রক্ষায় গন্ধের ভাষা থেকেই প্রাণীরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। বিখ্যাত ফরাসী বিজ্ঞানী আরিফাবর দীর্ঘকাল কীটপতঙ্গ নিয়ে নিবিড় গবেষণা চালাতে গিয়ে প্রথম আবিষ্কার করেন কিভাবে স্ত্রী প্রজাতি গন্ধের ভাষায় বাতাসের অনুকূলে দু’থেকে তিন কিলোমিটার দূরে পুরুষ প্রজাতির কাছে ছড়িয়ে দিতে পারে আহ্বান বার্তা। প্রাণী বিজ্ঞানী ফাবর একদিন তার পরীক্ষাগারে জারে প্রজাতির মুককীট রেখে দিলে রাতেই মেয়ে প্রজাতির জন্ম হয়। পরদিন সকালে দেখা গেল বারান্দায় ঝোলানো মেয়ে প্রজাতির জারটি ঘিরে অসংখ্য পুরুষ প্রজাপতি এসে ভিড় জমিয়েছে। এ থেকে প্রাণী বিজ্ঞানী জানতে পারেন মেয়ে প্রজাপতি জন্মেই তীব্র গন্ধযুক্ত এক বিন্দু তরল পদার্থ নিঃসরণ করে, যার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে প্রজননে মতোয়ারা পুরুষ ছুটে আসে মেয়ে প্রজাপতির কাছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয় ঘ্রাণশক্তি বা ঘ্রাণ উপলব্ধির ক্ষমতা জীবজন্তুদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গন্ধ শুঁকে হিংস্র জীবজন্তুরা অন্ধকারের মধ্যেও তাদের লুকানো শিকারকে খুঁজে পায়। আবার গন্ধ শুঁকে জীবজন্তু বিপদ টের পায়। অন্ধকারে মাটির নিচে, গাছের কোটরে বা বালকের নিচে, পানির নিচে সর্বত্রই যেখানে দৃষ্টিশক্তি অথবা শ্রবণশক্তি কাজে আসে না সেখানে এই ঘ্রাণশক্তি তাদের জীবন রক্ষা করে, খাদ্যের সন্ধান দেয় এবং তথ্যের বিনিময়ে সাহায্য করে। খেকশিয়াল ও ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন কীটপতঙ্গভুক সজারুর খাদ্য অনুসন্ধানে গন্ধ একটি অপরিহার্য বিষয়। একমাত্র গন্ধ শুঁকেই তারা খাবার খুঁজে পায়। মৌমাছি, প্রজাপতি, গুবরে পোকা দুর থেকে গন্ধ অনুভব করতে পারে কোথায় ফুলের মধু বা গাছের মিষ্টি রস। মশা, ছারপোকা, ডাশ মাছিসহ প্রাণী রক্ত খেকো কীটপতঙ্গরা প্রাণীর নিশ্বাস পরিত্যাক্ত কার্বনডাই অক্সাইডের গন্ধের আকৃষ্ট হয়ে রক্ত পান করতে সেই গন্ধের উৎসের দিকে ছুটে যায়। আর যেসব পোকা-মাকড় সারাজীবন মাটির নিচে বা মাটির মধ্যেই কাটায় তাদের ঘ্রাণশক্তি এতই প্রখর যেকোন বস্তু তাদের কাছে এলে তারা ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে তার আকৃতি-আয়তন এবং শত্রুমিত্র না খাবার তাও। রাশিয়ায় বিজ্ঞানীরা বিশেষ প্রজাতির পুরুষ প্রজাপতিকে চিহ্নিত করে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে এক এক করে ছেড়ে দিতে থাকেন। এরপর ছিদ্রযুক্ত জারে মেয়ে প্রজাপতিকে ট্রেনের কামরায় রাখেন। তাতে দেখা যায় চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকেও বিশেষ প্রজনন গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে মেয়ে প্রজাপতির কাছে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে পুরুষ প্রজাপতি। কালো ভ্রমর উড়ে উড়ে বৃত্তাকারে একটি বিরাট অংশজুড়ে গন্ধ ছড়িয়ে রাখে গাছের ডালে ও পাতায়, ওদের চোয়ালের ক্ষুদ্র গ্রন্থির সাহায্যে। এই গন্ধ দ্বারা একটি পুরুষ ভ্রমর যেমন মেয়েকে আকৃষ্ট করে, অন্যদিকে তেমনি নিজের এলাকার দখলি স্বত্বও জাহির করে। এই গন্ধ শুঁকে অন্য পুরুষ জেনে যায় এ এলাকায় ঢোকা নিষেধ। বাঘ, সিংহ, বুনো কুকুর, ভাল্লুকসহ হিংস্র প্রাণীরা প্রস্রাব ও মলত্যাগ করে এবং গাছে আঁচড় কেটে এবং গা ঘঁষে তাদের গন্ধ রেখে নিজের এলাকা চিহ্নিত করে আবার মেয়ে প্রাণীরা প্রস্রাবের গন্ধের মাধ্যমে তাদের প্রজনন সক্ষমতার বার্তা রেখে যায় পুরুষ প্রাণীর জন্য। আবার শিকারী এসব হিংস্র প্রাণীর গায়ের গন্ধ থেকে হরিণ, মোঘ, হাতি, বুনো ছাগল, খরগোশসহ তৃণভোজী প্রাণীরা অনেকে টের পায় তাদের আগমন বার্তা। এ থেকেই তারা পালিয়ে জীবন বাঁচায়।
×