ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কঠোর হচ্ছে সরকার ॥ করোনা সংক্রমণ রোধে ফের ছুটি বাড়ল ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ১১ এপ্রিল ২০২০

কঠোর হচ্ছে সরকার ॥ করোনা সংক্রমণ রোধে ফের ছুটি বাড়ল ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধ এবং আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যা অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় কঠোর হচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে জরুরী সেবা ছাড়া সন্ধ্যা ছয়টার পর বাইরে বের হওয়া নিষেধ করা হয়েছে। নিষেধ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে আইনানুগ ব্যবস্থা। তিন দফা সাধারণ ছুটির পর এবার আরেক দফা বাড়িয়ে তা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এই সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। একই সময় পর্যন্ত গণপরিবহন বন্ধ থাকার সিদ্ধান্তও আসছে। এদিকে করোনার সংক্রমণ রোধে রাজধানীজুড়ে লকডাউন এলাকার সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা লকডাউন করে দিচ্ছেন। আবার এলাকাবাসী নিজ উদ্যোগে লকডাউনের ব্যবস্থা করছেন। নগরীর ৬১টির বেশি বাসা-বাড়ি ও এলাকা ইতোমধ্যে লকডাউন করা হয়েছে। গেট লাগিয়ে মহল্লায় মহল্লায় গাড়ি ও মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ এ মোট আক্রান্তের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঢাকা। স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে আক্রান্ত মোট রোগীর মধ্যে অর্ধেকই রাজধানীর। শুক্রবার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪২৪ জনের মধ্যে ২২২ জন এই মহানগরীর। এরপর ঝুঁকিপূর্ণ জেলা নারায়ণগঞ্জ। করোনা ঠেকাতে দেশের কয়েকটি জেলা ইতোমধ্যে লকডাউন করা হয়েছে। ঢাকা থেকে বের হওয়া ও প্রবেশে আরোপ করা হয়েছে কড়াকড়ি। দুপুর দুইটার মধ্যে কাঁচাবাজার ও পাড়া-মহল্লার দোকান বন্ধ করা হয়েছে। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে সুপারস্টোরসহ ওষুধের দোকান বন্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে নেয়া পদক্ষেপ কঠোরভাবে মানতে বাধ্য করা হচ্ছে। আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সব পোশাক কারাখানা বন্ধের কথা জানানো হয়েছে শুক্রবার। একই সঙ্গে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত নগরীর সকল মার্কেট ও শপিংমল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মহানগর দোকান মালিক সমিতি। সন্ধ্যা ৬টার পর ঘর থেকে বের হওয়া মানা ॥ দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকায় অফিস-আদালত বন্ধ রেখে ঘরে থাকার মেয়াদ ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িয়ে সন্ধ্যা ৬টার পর বাইরে বের হতেও নিষেধ করেছে সরকার। সরকারের এই নির্দেশ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে শুক্রবার আদেশ জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, আগের ছুটির ধারাবাহিকতায় ১৫ ও ১৬ এপ্রিল এবং ১৯ থেকে ২৩ এপ্রিল সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো। সাধারণ ছুটির সময় আগামী ১৭-১৮ এপ্রিল এবং ২৪-২৫ এপ্রিল সাপ্তাহিক ছুটি সংযুক্ত থাকবে। বর্ণিত ছুটি অন্যান্য সাধারণ ছুটির মতো বিবেচিত হবে না জানিয়ে আদেশে এই ছুটির সময় যে সব নির্দেশাবলী কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে তাও বলে দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রশমনে জনগণকে অবশ্যই ঘরে অবস্থান করতে হবে। অতীব জরুরী প্রয়োজন ব্যতীত ঘরের বাইরে বের না হলে সবাইকে অনুরোধ করা হলো। সন্ধ্যা ৬টার পর কেউ ঘরের বাইরে বের হতে পারবেন না। এ নির্দেশ অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচল কঠোরভাবে সীমিত করা হলো। এছাড়া বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত সকল কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করতে হবে। আদেশে বলা হয়েছে, জরুরী পরিষেবার (বিদ্যুত, পানি, গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট ইত্যাদি) ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে না। কৃষিপণ্য, সার, কীটনাশক, জ্বালানি, সংবাদপত্র, খাদ্য, শিল্প পণ্য, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, জরুরী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন এবং কাঁচাবাজার, খাবার, ওষুধের দোকান ও হাসপাতাল এ ছুটির আওতার বাইরে থাকবে। জরুরী প্রয়োজনে অফিস খোলা রাখা যাবে জানিয়ে ছুটির আদেশে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে ঔষধশিল্প, উৎপাদন ও রফতানিমুখী শিল্প কারখানা চালু রাখতে পারবে। মানুষের জীবন জীবিকার স্বার্থে রিক্সা-ভ্যানসহ যানবাহন, রেল, বাস সার্ভিস পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে। জনগণের প্রয়োজন বিবেচনায় ছুটিকালীন বাংলাদেশ ব্যাংক সীমিত আকারে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু রাখার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে সরকার প্রথম দফায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সব অফিস আদালত বন্ধ রেখে সারাদেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সেই সঙ্গে সবাইকে যার যার বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেয়ায় বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষও ঘরবন্দী দশার মধ্যে পড়ে, যাকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বর্ণনা করা হচ্ছে ‘লকডাউন’ হিসেবে। সরকারী ভাষায় সেই ‘ছুটির’ মেয়াদ এরপর বাড়িয়ে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। পরে তৃতীয় দফায় সেই ছুটি ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর আগে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার ১৭ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। ঢাকার ৬১ এলাকা লকডাউন ॥ রাজধানীজুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে অন্তত ৬১ এলাকায় আংশিক কিংবা পরিপূর্ণভাবে লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় থানা পুলিশ। এ ক্ষেত্রে কখনও বিভিন্ন গলিপথের সকল বাড়ি কিংবা সুনির্দিষ্ট কিছু বাড়িতে লকডাউন ঘোষণা করে জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত বাড়িগুলোতে পুলিশ প্রহরায় কারও প্রবেশ এবং বাহিরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। লকডাউনের আগে কেউ বাসার বাইরে থাকলে তিনি বাসায় যেতে পারবেন, তবে কোন অবস্থাতেই বিনা অনুমতিতে বাস থেক কেউ বের হতে পারবেন না। অনেক বাসা বাড়িতে উড়ানো হয়েছে লাল পাতাকা। বেড়েছে পুলিশ, র‌্যাব ও সেনা টহল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দিনভর নগরীর অলিগলিসহ রাজপথে মাইকিং করে বাসা থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনায় আক্রান্ত বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত দেশের ২২ জেলায় করোনা শনাক্ত রোগী পাওয়া গেছে। রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হওয়ার কারণে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। কমেছে যান চলাচল। শুক্রবার বিকেলে সন্ধ্যা ছয়টার পর ঘরে বের হওয়া নিষেধ করার পর রাস্তাঘাটে লোকসমাগম একেবারেই ছিল না। যানজট আর মানুষে ঠাসা নগরীতে যেন ভুতুড়ে চিত্র ছিল। কোথাও কেউ নেই নাটকের মতো অনেকটা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড ও স্যার সৈয়দ রোড এলাকার বাড়ির মালিকরা তাদের এলাকায় যান চলাচল সীমিত করেছেন। এই এলাকার প্রবেশপথ ছয়টি থাকলেও পাঁচটি গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু মোহাম্মদপুর পোস্ট অফিসের পাশের গেটটি এলাকার মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে খোলা রাখা হয়েছে। বন্ধ প্রতিটি গেটে নোটিস টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। নোটিসে বলা হয়েছে, বর্তমান করোনাভাইরাসের কারণে গেটটি সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে, পোস্ট অফিসের নিকট ২ নম্বর গেট ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করা হলো। এর পাশাপাশি ২ নম্বর গেটে নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে দেয়া আছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং স্প্রে। তারা এলাকায় প্রবেশকারী রিক্সাচালক এবং সাধারণ মানুষদের স্প্রে ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেন। বাসাবো এলাকা ক্লাস্টার ঘোষণার পর আহাম্মদবাগ ও মায়াকাননের সবকটি গলিপথের গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় বাড়ির মালিকদের সংগঠন আহাম্মদবাগ ক্লাবের উদ্যোগে গেটে গেটে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে তালা। তবে পকেটগেট খোলা রাখা হয়েছে। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউ গেটের বাইরে যেতে পারছেন না। বাসাবো এলাকার বিভিন্ন মহল্লায় গেট লাগিয়ে দিতে দেখা গেছে। অনেক মহল্লায় বাঁশ দিয়ে চলাচল সংরক্ষিত করা হয়েছে। ইকবাল রোডের পাশেই লালমাটিয়া আবাসিক এলাকার বেশিরভাগ গেটই বন্ধ। ধানম-ি ২৭ নম্বরের দিকে বের হওয়ার একটি গেট এবং আড়ংয়ের পাশে একটি গেট খোলা রাখা হয়েছে এই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য। লালমাটিয়া এলাকার নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লালমাটিয়া কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে সীমিতভাবে গেট খোলা রাখা হয়েছে। বনশ্রী আবাসিক এলাকার স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকার অনেক বাসার মালিকের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যেন কোন আত্মীয় স্বজন না আসে এবং জরুরী প্রয়োজন ছাড়া যেন বাড়ির বাইরে না যায় কেউ। একইভাবে রাজধানীর নিকেতন আবাসিক এলাকা, শান্তিনগর এলাকার এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, ধানম-ি আবাসিক এলাকার বিভিন্ন বাসাগুলোয় সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই মেহমান থেকে শুরু করে গৃহকর্মী ও ড্রাইভারদের আসা-যাওয়াও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ জানায়, বুদ্ধিজীবী কবরস্থান রোডের জাফরাবাদে ‘বুদ্ধিজীবী মসজিদের’ স্টাফ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ওই খবর পাওয়ার পর মসজিদে প্রবেশ সংরক্ষিত ও মসজিদ সংলগ্ন গলি লকডাউন করা হয়েছে। এছাড়া, মাইকিং করে এলাকাবাসীকে সতর্ক করছে পুলিশ। ডিএমপির মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মোঃ রওশানুল হক সৈকত জানান, নতুন করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলে আইইডিসিআর-এর নির্দেশনা অনুযায়ী সেই এলাকায় লকডাউন করা হয়। মিরপুরের টোলারবাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় আবাসিক এলাকাও লকডাউন রয়েছে। জরুরী বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এই এলাকার সড়কে মানুষ দেখা যায় না। রাজধানীতে লকডাউন করা উল্লেখযোগ্য এলাকাগুলো হচ্ছে- মিরপুরের টোলারবাগ, মিরপুর-১০, মিরপুর সেকশন-১১, মিরপুর-১৩, কাজীপাড়া, সেনপাড়া, বুয়েট এলাকা, ইস্কাটনের দিলু রোড, উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের একটি সড়ক এলাকা। সেন্ট্রাল রোড, সোয়ারিঘাট, পল্টন, আশকোনা, নয়াটোলা, লালবাগের খাজে দেওয়ান রোড, ধানমন্ডি-৬ এলাকা ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন গলিপথ লকডাউন করা হয়েছে। অকারণে যারা বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন তাদের পড়তে হচ্ছে মোবাইল কোর্টের কবলে। গুনতে হচ্ছে জরিমানা।
×