ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জেলে ১০ বছর পূর্তিতে পার্টি দিয়েছিলেন শোভরাজ

প্রকাশিত: ২২:২৪, ১০ এপ্রিল ২০২০

জেলে ১০ বছর পূর্তিতে পার্টি দিয়েছিলেন শোভরাজ

অনলাইন ডেস্ক ॥ তার শিকারদের পরনে বেশির ভাগ সময়েই থাকত বিকিনি। ফলে ঘাতকের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘বিকিনি কিলার’। খুনের ধরন দেখে তাকে বলা হত ‘দ্য স্প্লিটিং কিলার’। হত্যাকাণ্ডের পরে সরীসৃপের মতো মসৃণ পথে পালানোর কায়দা তাকে নাম দিয়েছিল ‘দ্য সারপেন্ট’। বিশ্বের আপরাধ মানচিত্রে অন্যতম কুখ্যাত সে, চার্লস শোভরাজ। শোভরাজের জন্ম ১৯৪৪ সালের ৬ এপ্রিল, ভিয়েতনামের সাবেক সাইগনে। এখন এর নাম হো চি মিন সিটি। তার বাবা শোভরাজ হাতচন্দ ভাওনানি ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। মা, ত্রান লোয়াং ফুন ছিলেন ভিয়েতনামের নাগরিক। শৈশবেই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ দেখেছিলেন শোভরাজ। তার মা নতুন সংসার বেঁধেছিলেন ফরাসি প্রেমিকের সঙ্গে। ফরাসি সেনাবাহিনীর সেই লেফটেন্যান্ট দত্তকও নিয়েছিলেন শোভরাজকে। কিন্তু নতুন পরিবারে মানিয়ে নিতে পারেনি শোভরাজ। তার মায়ের পরে আরও সন্তান হয়। এর পরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়ে শোভরাজ। জড়িয়ে পড়ে ছোটখাটো অপরাধে। ১৯ বছর বয়সেই প্যারিসে ডাকাতির ঘটনায় প্রথম বার কারাবন্দি হন। কিন্তু কারাকর্তারা মুগ্ধ ছিলেন তার আচার আচরণে। নিজের সেলে বই রাখার বিশেষ অনুমতি পেয়েছিল সে। কারাবন্দি থাকার সময়ে আলাপ হয় এক ধনী স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে। প্যারোল থাকার সময় তাঁর সুবাদে শোভরাজ পরিচিত হয় প্যারিসের উপর মহলের সঙ্গে।জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও এই পরিচিতি জারি রেখেছিল শোভরাজ। সেইসঙ্গে এক অদ্ভুত বৈপরীত্যে সমানতালে চলছিল তার অপরাধও। ধীরে ধীরে প্যারিসের অন্ধকার দুনিয়াও চিনে নিল তাকে। এই সময়ে প্যারিসের রক্ষণশীল অভিজাত পরিবারের তরুণী শাঁতাল কোম্পাগ্যানন প্রেমে পড়লেন শোভরাজের। শোভরাজের অপরাধের ইতিহাস জানতেন তরুণী। এমনকি, এক গাড়িচুরি কাণ্ডে ফের হাজতবাসের পরেও অটুট ছিল সেই প্রেম। ১৯৭০ সালে গ্রেফতারি এড়াতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ফ্রান্স ছেড়ে এশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয় শোভরাজ। নকল নথিপত্র নিয়ে, পূর্ব ইউরোপ ঘুরে মুম্বই পৌঁছন তাঁরা। পথে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পর্যটকদের উপর লুঠপাট চালাত শোভরাজ। মুম্বইয়ে জন্ম হয় তাঁদের মেয়ে ঊষার। মুম্বই এসে শোভরাজ শুরু করে গাড়ি চুরির চক্র। চোরাচালানের পাশাপাশি তাঁর নতুন নেশা হয়ে দাঁড়াল জুয়া। আবার ডাকাতির ঘটনায় ধরা পড়ল সে। কোনওরকমে নিজের জামিনের টাকা পেল সৎ বাবার কাছ থেকে। তার পর সুযোগ বুঝে এক দিন স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে পালাল কাবুল। কাবুলেই শুরু হল শোভরাজের অপরাধের নতুন ধারা। এ বার তাঁর মূল নিশানা হল হিপি সম্প্রদায়। আবার ধরা পড়ল। এ বার অসুস্থতার ভান করে ভর্তি হল হাসপাতালে। সেখানে রক্ষীদের মাদকাসক্ত করে পালায় সে। এ বারের গন্তব্য ইরান এবং সে একা। মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী থাকলেন কাবুলেই। স্বামীর অপরাধ আর মেনে নিতে পারছিলেন না শাঁতাল। শিশুকন্যাকে নিয়ে তিনি ফিরে আসেন প্যারিসে। তখনও শোভরাজকে ভালবাসতেন তিনি। কিন্তু ঠিক করেছিলেন সুপথে না ফিরলে আর স্বামীর মুখদর্শন করবেন না। এর পরের দু’বছর শোভরাজ ছিল পলাতক। পর্যটকদের পাসপোর্ট চুরি করে চোরাই পাসপোর্টের সাহায্যে থাকত মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপের নানা দেশে। রত্ন ব্যবসায়ী বা মাদকের কারবারি হিসেবে পরিচয় দিত হিপি পর্যটকদের কাছে। তাঁদের বিশ্বাস অর্জন করতে সমস্যা হত না শোভরাজের। তার পর সুযোগ বুঝে পর্যটকের বিশ্বাসের সুবিধে নিয়ে তাঁকে সর্বস্বান্ত করত শোভরাজ। ক্রমে বড় হতে লাগল তার অপরাধ চক্র। অজয় চৌধুরি নামে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছিল তার অপরাধের মূল সঙ্গী। সৎ ভাই আন্দ্রেও ছিল অপরাধের কুচক্রী। ১৯৭৫ সালে প্রথম খুনের অভিযোগ উঠে আসে তাদের নামে। মূলত খুন করত নিজেদের চক্রের সদস্যদেরই। যারা দল ছেড়ে বেরিয়ে তাদের অপরাধ ফাঁস করে দেওয়ার শাসানি দিত, তারা নিষ্কৃতি পেত না। গোয়েন্দাদের খাতায় শোভরাজের প্রথম শিকার সিয়াটলের এক তরুণী। তাইল্যান্ডের সমুদ্রখাঁড়িতে তাঁকে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। নিথর তরুণীর পরনে ছিল বিকিনি। এর পর এশিয়ার বিভিন্ন শহরে চলতে থাকে শোভরাজের লুঠতরাজ এবং হত্যালীলা। ভারতও ছিল এই নৃশংস অপরাধীর বিচরণক্ষেত্র। ১৯৭৬ সালে দিল্লিতে একদল ফরাসি তরুণকে নিশানা করে শোভরাজ এবং তার তিন সঙ্গী। গাইড হিসেবে পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্তরের ছাত্র ওই তরুণদের সঙ্গে আলাপ করে শোভরাজ। বিশ্বাস অর্জনের পরে তাঁদের হাতে তুলে দেয় বিষ মেশানো পিল। মুখে বলেন, সেগুলি অমাশয়ের ওষুধ! কিন্তু তিন জন ছাত্র বুঝে ফেলেন তাদের দুরভিসন্ধি। আচ্ছন্ন অবস্থাতেও তাঁরা ধরাশায়ী করেন শোভরাজদের। গ্রেফতারের পরে তিহাড় জেলে জায়গা হয় তাদের। বিচারে ফাঁসির বদলে ১২ বছরের কারাদণ্ড হয় শোভরাজের। কিন্তু সে তিহাড় জেলে ছিল রাজার হালে।দেহের মধ্যে লুকিয়ে রাখা মূল্যবান রত্ন নিয়ে সে ঢুকেছিল তিহাড় জেলে। কারাকর্মীদের ঘুষ দিয়ে বশ করতে বেগ পেতে হয়নি। ১৯৮৬ সালে তিহাড়বাসের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কারারক্ষীদের জন্য পার্টি দেয় শোভরাজ। তার পর তাদের ঘুমের ওষুধ মেশানো খাবার খাইয়ে পালিয়ে যায়। আবার ধরা পড়ে গোয়ার এক রেস্তোরাঁ থেকে। আরও ১০ বছর বেড়ে যায় তার কারাবাসের মেয়াদ। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় ৫২ বছর বয়সি শোভরাজ। ভারত থেকে ফিরে যায় ফ্রান্সে। এর পর প্যারিসের শহরতলিতে বিলাসবহুল জীবন কাটাত শোভরাজ। সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার বা ফোটোগ্রাফ, সব কিছুর জন্য দাবি করত মোটা অঙ্কের টাকা। ২০০৩ সালে তাকে নেপালের কাঠমাণ্ডুতে দেখতে পান এক সাংবাদিক। সাংবাদিকের কাছ থেকে খবর পেয়ে একটি হোটেলের ক্যাসিনো থেকে শোভরাজকে গ্রেফতার করে কাঠমাণ্ডুর পুলিশ। ১৯৭৫ সালে নেপালে দুই বিদেশি নাগরিককে খুনের ঘটনায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে কাঠমাণ্ডু পুলিশকে সাহায্য করেছিল ইন্টারপোল। জীবনের যে কোনও পর্বেই শোভরাজ ছিল নিজের মেজাজেই। ২০০৮ সালে সে জানায়, নেপালে তার আইনজীবীর মেয়ে নিহিতা বিশ্বাস তার বাগদত্তা। নিহিতার মাধ্যমে সে আবেদন করে, খুন করার জন্য কোনও আদালত তাকে শাস্তি দেয়নি। তাই তাকে যেন ‘সিরিয়াল কিলার’ না বলা হয়। ২০০৮-এর অক্টোবরে শোনা যায়, নিহিতাকে বিয়ে করেছে শোভরাজ। কিন্তু এই দাবি উড়িয়ে দেন কারাগার কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি ছিল, বন্দিদের আত্মীয় পরিজনরা জেলে বড়া দশমী পালন করছিলেন। রীতি অনুযায়ী, সেই অনুষ্ঠানে গুরুজনরা মেয়েদের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেন, আশীর্বাদস্বরূপ। ফলে নিহিতার কপালের সিঁদুর বিয়ে উপলক্ষে ছিল না।নেপালের কারাগারেই এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বন্দি বিশ্বত্রাস চার্লস শোভরাজ। ইতিমধ্যেই একাধিক বার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে তার। গোয়েন্দাদের দাবি, অন্তত ১২টি খুনের ঘটনা সে স্বীকার করেছে। একাধিক ভাষায় পারদর্শী শোভরাজ তার সুদর্শন চেহারা এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগাত তুরুপের তাস হিসেবে। বিশ্বের বড় অংশের গোয়েন্দা ও পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া ছিল তার কাছে জলভাত।কিন্তু কেন সে হঠাৎ প্যারিস থেকে কাঠমাণ্ডু গেল, গোয়েন্দাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাঁদের ধারণা, হয়তো নিজের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জোরেই সে পা রেখেছিল নিজের পুরনো মৃগয়াক্ষেত্রে। কিন্তু এ বার আর এড়াতে পারল না যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রকা
×