ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তদন্ত করছে গোয়েন্দারা

এ সময়ে মাজেদের ঢাকা আসা নিয়ে নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: ১১:১৬, ৯ এপ্রিল ২০২০

এ সময়ে মাজেদের ঢাকা আসা নিয়ে নানা প্রশ্ন

শংকর কুমার দে ॥ নিশ্চিত ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হবে জেনেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের বাংলাদেশে ফিরে আসার ঘটনা নিয়ে গোয়েন্দা মহলে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। তাও আবার এমন সময়ে তার ফিরে আসার ঘটনাটি ঘটেছে যখন কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদেশ্যে ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল তখন আরেকবার বাংলাদেশে এসেছিল খুনী চক্রের সদস্যরা, তখন ক্ষমতায় ছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এখন আবার বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদ নিশ্চিত মৃত্যুদ- জেনেও বাংলাদেশে ফিরে আসার ঘটনটিকে অস্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে। পর্দার অন্তরালের কোন অদৃশ্য মহল কলকাঠি নাড়িয়ে তাকে অভয় দিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনেছে কিনা এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি ও ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদের দেশে ফিরে আসার ঘটনার একটির সঙ্গে আরেকটির কোন যোগসূত্র বা ষড়যন্ত্র আছে কিনা তার খতিয়ে দেখছে করছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ মার্চ প্রায় ২৫ মাসের সাজা ভোগ করে ৬ মাসের জন্য মুক্তি পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। বলা হচ্ছে, মুক্তি পেয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে তিনি বিএনপির কলকাঠি নাড়ছেন এবং দলকে পুনর্গঠিত করার কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। বাসায় থেকেই তিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। বিগত নির্বাচনের সময়ে বিএনপি যেই ড. কামালা হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন সেই ঐক্যফ্রন্টও করোনা ভাইরাস ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকারের কাছে দাবি জানানোর নামে আবার রাজনৈতিক মাঠে অবতীর্ণ হয়েছে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দেও সঙ্গে দীর্ঘদিন পর বিএনপির নেতৃবৃন্দের এক সঙ্গে বসে সংবাদ সম্মেলন করে করোনাভাইরাস ইস্যুতে দাবি জানানোর ঘটনাটিতে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার ইঙ্গিত বহন করছে বলে মনে করে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, সরকারবিরোধী একটা বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়ার ৬ মাসের মুক্তিকালীন সময়ের মধ্যেই এই আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার খুবই শক্ত অবস্থানে আছে এবং আন্দোলন করে সরকার পতনের বাস্তবতা নেই এখন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে। আগাগোড়াই ক্যান্টনমেন্টের লোকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিএনপি। বিশেষ করে বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই আন্দোলনের চেয়ে ষড়যন্ত্র করাতেই দক্ষ ও পারদর্শী। বিএনপির ষড়যন্ত্রের প্রধান অংশীদার ছিল পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর খুনীচক্র এবং একাত্তরে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। এদের সঙ্গে নিয়েই বিএনপি বিভিন্ন সময় ‘সফল ষড়যন্ত্র’ করতে পেরেছে। তাই বেগম খালেদা জিয়া যখন ’৯১-এ প্রথম সরকার প্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন তখনই তিনি পঁচাত্তরের খুনীদের পদোন্নতি দিয়েছিলেন। বেগম জিয়া গণদাবি সত্ত্বেও সে সময় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেননি। পঁচাত্তরের খুনীদের খুশি রাখতেই তিনি ১৫ আগস্ট জাতির পিতার শাহাদাত দিবসের শোকাবহ দিনে জন্মদিনের উৎসব পালন করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়া এক দলীয় প্রহসনের নির্বাচন করেছিলেন সেই নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার জন্য তিনি পার্টনার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের খুনী আবদুর রশিদ ও তার ভায়রাভাই ফারুক রহমান। পবিত্র জাতীয় সংসদে তাকে নিয়ে এসে বসিয়েছিলেন। সেই বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির কিছু দিনের মধ্যেই দীর্ঘ সময় ভারতে অজ্ঞাতবাসে থাকা খুনী মাজেদ ঢাকায় এসে ধরা পড়লেন। এমনভাবে ঢাকা আসলেন যে বর্ডারে কেউ তাকে ধরতে পারল না, চিনতে পারল না। তিনি একটি রিক্সায় করে ঢাকায় ঘুরছিলেন। নিজেই এক পর্যায়ে পরিচয় দেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনী। তারপর তাকে গ্রেফতার করা হয়। একবার বলা হয় তাকে গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার বলা হচ্ছে, তার স্ত্রীর অবস্থানরত ক্যান্টনমেন্টের এলাকার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, করোনার ভয়ে তাকে সংশ্লিষ্ট দেশ পুশব্যাক করেছে। নিশ্চিত মৃত্যুদ- কার্যকর জেনেও ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদের দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পলাতক থাকার পর ফিরে আসার ঘটনাটি খুবই অস্বাভাবিক। বিশেষ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। এ সময়টায় নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বঙ্গবন্ধুর খুনীর দেশে ফিরে আসার ঘটনাটিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, পঁচাত্তরের খুনীদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপীল বিভাগ মৃত্যুদ-ে দ-িত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানাও রয়েছে। ইন্টারপোল বিশ্বে তাদের বিরুদ্ধে রেড এলার্ট জারি করেছে। বাংলাদেশের সব সীমান্ত এলাকাগুলোতে তাদের সম্পর্কে তথ্য থাকা উচিত। কারণ তারা মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি। তারপরও সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে মাজেদ ঢাকা এলেন কিভাবে? মাজেদ করোনার ভয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য? করোনার ভয় ভারতে আছে, বাংলাদেশে নেই? তাছাড়া ঢাকায় তিনি এলেন, আর আসার পর তিনি এভাবে ঘুরছিলেন কীভাবে? তার পেছনে কি কোন মদদদাতা নেই, কোন পৃষ্ঠপোষক নেই? নাকি তিনি ¯্রফে কাকতালীয়ভাবে এসেছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির পর বিএনপির যে চেষ্টা, বিএনপির যে রাজনৈতিক তৎপরতা। তার সঙ্গে মাজেদের দেশে ফেরার কোন যোগসূত্র কিংবা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের কিছু আছে কি? গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদেশ্যে ২০০৪ সালের যে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছিল, সে সময় এই খুনী চক্রের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ যোগসাজশ ছিল। খুনী রশিদ, খুনী ডালিম, এরা ভয়ঙ্কর। এদের এখন একমাত্র টার্গেট আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে রকম কোন নীল নক্সার বাস্তবায়নের জন্যই মাজেদ ঢাকায় এসেছিল কিনা সেটা ভাবতে হবে। নাহলে কোন রকম সংকেত ছাড়া মাজেদের ঢাকায় আসার কারণ নেই বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এর সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তির কোন সম্পর্ক আছে কিনা সেটাও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সেই বিষয়টি সামনে রেখে মাজেদের দেশে ফেরার ঘটনাটির বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে এর মূল উৎস ও রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ মাজেদের মতো একজন ঘৃণিত খুনী করোনার ভয়ে ঢাকা আসবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং মাজেদের ঢাকায় ফেরার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন যোগসাজশ থাকতে পারে। এই খুনীচক্র বাংলাদেশে নতুন কোন ষড়যন্ত্র করছে কিনা সেটাও দেখার বিষয়। এই খুনী নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দেশে ফিরে আসার নেপথ্যে পর্দার অন্তরালের কোন অদৃশ্য মহলের কলকাঠি নাড়াচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি।
×