ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যাদের এগিয়ে আসা উচিত তারা নেই

অসহায় মানুষের পাশে মানবিক পুলিশ

প্রকাশিত: ১১:০৫, ৯ এপ্রিল ২০২০

অসহায় মানুষের পাশে মানবিক পুলিশ

রশিদ মামুন ॥ ঘটনা-১. রাজধানীর উত্তরার একটি বাড়ির গৃহকর্তা গভীর রাতে হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত হন। তার স্ত্রী একে একে সব ভাড়াটিয়ার দরজায় কড়া নাড়েন। সাহায্যের জন্য পাগলের মাতো কান্নাকাটি করেন। কিন্তু কোন ভাড়াটিয়া ওই রাতে দরজা খুলে সাহায্য করতে রাজি হননি। পাশেই ভদ্র মহিলার ভাই থাকেন। তাকেও ফোন করেন। কিন্তু শ^াস কষ্টের অসুস্থতা শুনে তিনিও আসতে রাজি হননি। একজন ভাড়াটিয়া পুলিশকে ফোন করেন। পুলিশ আসার আগেই গৃহকর্তার মৃত্যু হয়। ঘটনা-২. নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর বাড়ির পাশে গিটারিস্ট হিরো লিসানের লাশ পড়ে থাকার খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিউজ ফিডে ঘুরে ফিরে আসছে। ঠা-া, জ্বর, শ^াসকষ্টে ৭ এপ্রিল ভোররাতে হিরোর মৃত্যু হয়। ভোরেই হিরোর বাড়ি দেওভোগ কৃষ্ণচূড়া এলাকা থেকে মরদেহ একটি এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকাবাসী বাধার মুখে পড়ে চালক মরদেহ ফেলে রেখে চলে যায়। এসময় পরিবারের লোকও কাছে আসেনি। পরে পুলিশ খবর পেয়ে মরদেহটিকে দাফন করেছে। ঘটনা-৩. রাজধানীর দক্ষিণখানে করোনা আক্রান্ত এক যুবককে খুঁজছে পুলিশ। আক্রান্ত ওই যুবকের ঠিকানায় গিয়ে তাকে না পেয়ে আশপাশে খুঁজেও তাকে পায়নি। দক্ষিণখান থানা এলাকার আশকোনার তালতলার একটি বাসা থেকে ওই যুবক নিখোঁজ হন। রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) থেকে পুলিশকে ওই যুবকের ঠিকানা দেয়া হয়েছিল। কারোনা পজেটিভ ওই যুবকের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেছিল আইইডিসিআর। ঘটনা-৪. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। রাজধানীর তালতলা কবরস্থানে পুলিশ সদস্যরা কবর খুঁড়ছেন। তারাই জানাজা পড়ছেন। তারাই দাফন করছেন। করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তির লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে প্রশাসন থেকেই দাফন করা হচ্ছে। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী আইইডিসিআর বিষয়টির তত্ত্বাবধান করছে। এখন পুলিশের উদারতার এমন হাজারো ঘটনা মিলছে। এইসব ঘটনা একটি বিষয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা কি একটু বেশি অমানবিক আচরণ করছি না। হার্ট এ্যাটাকের রোগীর তো শ্বাসকষ্ট হতেই পারে। তাই বলে কি তার সাহায্যে কারও এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল না! আবার দক্ষিণখানের করোনাআক্রান্ত যুবকের কি উচিত হয়েছে পালিয়ে যাওয়া। তিনি তো আরও বহু মানুষের মধ্যে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারেন। এতদিন যারা পুলিশকে বলে এসেছেন আপনারা তো মানুষ নয় পুলিশ। বাক্যটি শুনতে কেমন গালির মতো শোনালেও সেই পুলিশই এখন দিন রাত মানুষের সেবা করছে। অমানবিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে মানবিক পুলিশ। সময়ের বৈরিতাকে যিনি ভয় না পেয়ে সেবার হাত প্রসারিত করেন তিনিই আসলে মানবিক। গত সোমবারের ঘটনা রাজধানীর মৌচাক মোড়ে রাত পৌনে নটায়। রিক্সা করে বাসায় ফিরছিলাম। একজন সাব-ইন্সপেক্টর হাতের ইশারায় থামালেন। পরিচয় পেয়ে ছেড়ে দিলেন। এরপর তিনি রিক্সাওলাকে বোঝাতে শুরু করলেন। দেখুন এই সময়ে দয়া করে রিক্সা নিয়ে বের হবেন না। আপনি তো জানেন না আপনি কোন করোনা রোগীকে পরিবহন করছেন কি না। তার মাধ্যমে আপনিও সংক্রমিত হতে পারেন। সাবধানে থাকুন, বের হবেন না। অনেকেই বলেন, পুলিশ কথা বলার আগে দু’ঘা দিয়ে নেয় কিন্তু এই সাব-ইন্সপেক্টরের কথা আশা জাগানিয়া। তিনি নিজেও জানেন না রাস্তায় যে মানুষ ঘুরছেন, যাদের তিনি থামিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা কেউ করোনা রোগী নয়? কিন্তু এরপরও নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মানুষকে বাঁচাতে তিনি কাজ করে চলেছেন। শুধু তিনি নন রাস্তায় যত পুলিশ রয়েছেন তারা মানুষকে বোঝাচ্ছেন। ঘরে থাকার অনুরোধ জানাচ্ছেন। প্রয়োজনে আপনার আমার জীবন বাঁচানোার জন্য পুলিশ হাত জোড় করে ঘরে থাকার অনুরোধ জানাচ্ছেন। একবার ভাবুন তো জীবনটা আপনার, আর সেটি বাঁচাতে হাত জোড় করছেন অন্য একজন। কে মহানুভব। আপনি না তিনি? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেছেন, যাদের মানবিকতা নেই তাদের দিয়ে আসলে কিছু হবে না। হওয়া সম্ভবও নয়। জোর করে কোন কিছু হয় না। ঠিক এর বিপরীত চিত্র পুলিশের মধ্যে। রাজধানী তো বটেই সারাদেশে পুলিশ এখন খাবার না থাকলে খাবার কিনে দিচ্ছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ ফুরিয়ে গেলেও ফোন করলে দিয়ে যাচ্ছে। তবে এই সুযোগ পেয়ে চট্টগ্রামে কেউ একজন পাঁচফোড়ন কিনে দিতে পুলিশকে ফোন করেছেন। ওষুধ বা নিত্য প্রয়োজনীয় অন্য কিছু লাগলে বলুন থানার ইনচার্জের (ওসি) এমন উত্তরে রেগেমেগে তিনি ফোন রেখে দিয়েছেন। আসলে মানুষ আপদকালীন এই সময়ের সুযোগটাও ঠিক ঠাক ব্যবহার করতে পারছেন না। কেউ কেউ বলছেন জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে পুলিশের স্লোগান ছিল ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার পুলিশ হবে জনতার’। এই স্লোগানটি সত্যি সত্যি পুলিশেরই হয়ে রইলো। পুলিশ এখন জনতার পুলিশেই পরিণত হলো। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হতো পুলিশ জনগণের বন্ধু। তবে কিছু বিপথগামী মানুষের জন্য এই বন্ধুত্বে যে ছেদ পড়েছিল পুলিশ তা এবার ঝালাই করে নিয়েছে। এই বিপদের দিনে মানুষ বুঝতে পেরেছে পুলিশের চেয়ে ভাল বন্ধু আর নেই। বছর কয়েক আগে কোলকাতা পুলিশের একটি উদ্যোগ আলোচনায় এসেছিল। নগরের নিঃসঙ্গ বয়স্ক মানুষদের জন্য এই সেবা চালু করেছিল তারা। নিঃসঙ্গতা অনুভব করলে পুলিশে ফোন করবেন বয়স্ক ব্যক্তিরা। একজন পুলিশ সদস্য সেই ব্যক্তির বাড়ি যাবেন। তাকে সঙ্গ দেয়ার পশাপাশি তার ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়ে আসবেন। আমাদের এখানেও স্বেচ্ছায় যেসব সদস্য এমন সেবা দিতে চান তাদের বাছাই করে এমন মানবিক উদ্যোগ নিতে পারে পুলিশ। এতে সারাদিন কেবল অপরাধীর সঙ্গে থাকার এক ঘেয়েমি কেটে যাবে। আবার বিষয়টি অন্যভাবে দেখলে শহরে অপরাধ কমে গেলে পুলিশের কাজও কমে যায়। যে সময়টা তারা অপরাধীদের পেছনে ব্যয় করত সেই সময়টি তারা মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতে পারে। সাবেক পুলিশ প্রধান নূর মোহাম্মদ কিভাবে দেখছেন পুলিশের এই সময়ের ভূমিকাকে জানতে চাইলে বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা যখন চাকরিতে যোগ দেন তখনই তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ই। এটি সারা দুনিয়াতেই হয়। ফলে আমাদের এখানেও সেটির ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। সেখানেই বিতর্কের জন্ম দেয়। কিন্তু এখন পুলিশ যে দায়িত্ব পালন করছে তা অভাবনীয়। প্রত্যাশা করব সারাবছরই পুলিশ এভাবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাক। তিনি বলেন, পুলিশ এবং ডাক্তার যেভাবে মানুষের জন্য সরাসারি কাজ করতে পারে অন্য পেশার মানুষের সেই সুযোগ কম। মানুষ বিপদে পড়লে এই দুই শ্রেণীর মানুষের কাছে সবার আগে যায়। পুলিশ মানবিক সেবার আওতা বৃদ্ধি করলে মানুষ বেশি উপকৃত হবে।
×