ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা ভীতি পালটে দিল মানুষের মনোজগৎ

প্রকাশিত: ২৩:১২, ৮ এপ্রিল ২০২০

করোনা ভীতি পালটে দিল মানুষের মনোজগৎ

অনলাইন ডেস্ক ॥ করোনা ভাইরাস যেভাবে আমাদের চিন্তাভাবনার জগত্ দখল করে ফেলেছে, এর আগে তেমনটা অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে হয়নি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিটি সংবাদমাধ্যম রেডিও, টেলিভিশন জুড়ে করোনা ভাইরাস-সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত, পরামর্শ, গুজব ইত্যাদি। একই সঙ্গে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির খবরে মানসিক উদ্বেগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে; স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়ছে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। করোনা ভাইরাস নিয়ে অব্যাহত ভীতি মানুষের মানসিকতার ওপর ফেলতে পারে বিরূপ প্রভাব। করোনা-ভীতিতে মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষ করে সামাজিক মেলামেশা, বিচারক্ষমতা আরো বেশি রক্ষণশীল হয়ে উঠতে পারে। অভিবাসন, যৌন স্বাধীনতা ও সমতা নিয়ে মানুষের ভাবনার পরিবর্তন আসতে পারে। এমনকি আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শেও পরিবর্তন ঘটাতে পারে করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের কারণে এর মধ্যেই অহেতুক ভীতি ও বর্ণবিদ্বেষের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার পূর্বাভাস যদি সঠিক হয়, তাহলে সামাজিক ও মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে বড়ো ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। মানব মনস্তত্ত্বের অন্যান্য বিষয়ের মতো রোগব্যাধির ক্ষেত্রে আচরণের বিষয়টি বোঝার জন্য ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। আধুনিক চিকিত্সাব্যবস্থা আবিষ্কারের আগে সংক্রামক ব্যাধি ছিল মানুষের টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে বড়ো হুমকি। তখন মানুষের শরীরে যে প্রতিরোধব্যবস্থা কাজ করত, তার ফলে মানুষ খানিকটা ক্লান্ত, ঘুমকাতুরে বোধ করত। তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের নিয়মিত কার্যকলাপ—যেমন শিকার করা, জড়ো হওয়া বা শিশুদের লালন-পালন করার মতো কাজগুলো ঠিকভাবে করতে পারত না। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে মানুষের এই ভীতি তৈরি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আচরণগত প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা। যা কিছু আমাদের শরীরের জন্য খারাপ হতে পারে, সেটা আমরা এড়িয়ে যেতে চাই, তার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিরোধমূলক আচরণ তৈরি করি। ভ্যাংকুভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার অধ্যাপক মার্ক স্কলার বলছেন, এটা অনেকটা মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্সের মতো। এটা থাকা ভালো, কিন্তু যখন আপনি সেটা ব্যবহার করা শুরু করবেন, তখন দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব জিনিস আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়েছে, সেগুলো আমাদের মনের ভেতরে থেকে যায়। ফলে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে, যা আমাদের ভবিষ্যতে বিপদে ফেলতে পারে, সেগুলো আমরা এড়িয়ে যাই। মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, অনেকের সঙ্গে একত্রে মিলেমিশে থাকতে অভ্যস্ত, তাই রোগের বিস্তার ঠেকাতে তখন মানুষের সঙ্গে চলাফেরা, মেলামেশার ধরনের ওপরেও পরিবর্তন আসে। ফলে রোগের সংক্রমণ এড়াতে মানুষ সামাজিক দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করে। আর্থাউস ইউনিভার্সিটি অব ডেনমার্কের অধ্যাপক লেনে অ্যারোয়ি বলছেন, অনেক সময় এ ধরনের আচরণ ভুল হতে পারে, হয়তো ভুল তথ্যের ভিত্তিতে হতে পারে, হয়তো আমাদের নীতিগত অবস্থান বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করেও হতে পারে। লেখক অ্যারোয়ি যেমন দেখতে পেয়েছেন, সংক্রামক রোগের ভীতির কারণে অভিবাসন নিয়ে অনেক মানুষের মনোভাব বদলে গেছে। তিনি মনে করেন, মানুষের ভেতরে যে আচরণগত প্রতিরোধব্যবস্থা আছে, যার কারণে মানুষ মনে করে যে ‘দুঃখিত হওয়ার চেয়ে নিরাপদ হওয়া জরুরি’, সে কারণেই তারা এরকম আচরণ করতে পারে। অ্যারোয়ি বলছেন, কিছু মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে স্পর্শকাতর আচরণগত প্রতিরোধব্যবস্থা কাজ করে, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি আছে, এসব কিছুর ক্ষেত্রে তারা জোরালো আচরণের প্রকাশ ঘটায়। করোনা ভাইরাস আমাদের ব্যক্তিগত আচরণের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, সেটাই বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি অন্যদের প্রতি বেশি সচেতন হয়ে উঠছি? অন্যদের আচরণ বিচার-বিশ্লেষণ করছি? নিয়মকানুনের গুরুত্ব কি বুঝতে পারছি? আমাদের চিন্তাভাবনা কি স্বাভাবিক রয়েছে? নাকি হাজার বছর আগে সংক্রামক রোগ ছড়ানোর সময় আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে আচরণ করেছিলেন, সেটাই আমরা অবচেতনে প্রকাশ করে চলেছি? সূত্র-বিবিসি
×