ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুঃসময়ের মাস এপ্রিল, সতর্ক থাকুন;###;সকলেই পাবেন স্বাস্থ্যবীমা সুবিধা ;###;সাহায্য নিয়ে দুর্নীতি করলে ছাড় নয় ;###;যারা কষ্টে আছেন তাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ;###;সম্মিলিত চেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে

করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিতদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার ঘোষণা

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ৮ এপ্রিল ২০২০

করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিতদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার ঘোষণা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোভেল করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করা চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের বিশেষ স্বাস্থ্যবীমা প্রদানের পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। একইসঙ্গে দিনমজুর, ভ্যান-রিক্সাচালক, চা-বিক্রেতাসহ যেসব পেশাজীবীর সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে, তাদের চিহ্নিত ও তালিকা করে সাহায্য পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি করারও নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সামাজিক নিরাপত্তার বাইরে থাকা যারা হাত পাততে পারে না তাদের তালিকা তৈরি করে ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছে দিন। এই এপ্রিল মাসটা অনেকটা দুঃসময়ের খবর পাচ্ছি, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই সতর্ক থাকুন। তবে যাদের কাছ থেকে রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাননি, সেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা স্বাস্থ্যবীমার সুযোগ পাবেন না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের দুর্ভোগের সময় কেউ যদি সুযোগ নেয়, সাহায্যের জিনিস নিয়ে নয়ছয় কিংবা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয় তারা ধরা পড়বেই। তাদের কিন্তু এতটুকু ছাড় দেব না, এটা হলো স্পষ্ট কথা। আর দেশবাসীর প্রতি আমার আহ্বান, ঘরে বসে আল্লাহ’র দরবারে দোয়া প্রার্থনা করুন, তিনি যেন করোনাভাইরাস থেকে সবাইকে মুক্তি দেন, সবাই যেন সুরক্ষিত থাকেন। আর অসুস্থ হলে কেউ লুকাতে যাবেন না। কারণ আপনি লুকাবেন, আপনি আরও দশজনকে সংক্রমিত করবেন। তাই অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিন, দ্রুত আরোগ্য লাভ করুন। মানুষের কষ্ট লাঘবে এবং সুরক্ষায় সরকার থেকে যা যা দরকার আমরা তা করে যাচ্ছি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় যেখানে যতরকম, যা যা দরকার আমরা তা দিতে সবরকম চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাই দেশের কোন মানুষ যেন কষ্ট না পায়, চিকিৎসা সেবা পায় তা সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। মঙ্গলবার গণভবন থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১৩টি জেলার জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সংসদ সদস্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন, চিকিৎসক, নার্সসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আহ্বান জানান। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী এই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। গণভবন প্রান্ত থেকে প্রধানমন্ত্রী একে একে ওই দুই বিভাগের হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সুনামগঞ্জ, ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লা জেলার জেলা প্রশাসক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ নেতা, পুলিশ সুপার, সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি, সিভিল সার্জন, ধর্মীয় নেতা, নার্সসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন এবং এসব জেলার সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের বিশেষ স্বাস্থ্য বীমা ॥ করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে সামনে থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় যুক্ত থাকা চিকিৎসক সংশ্লিষ্টদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে, তার সম্মুখভাগ থেকে সরকারী স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছে। আমাদের সরকারী চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, যারা করোনা সেবায় অবদান রেখেছেন, তাদের সকলকে আমি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ আমি দেখেছি, সরকারী হাসপাতালগুলোতে যারা কাজ করেন, তারাই কিন্তু এখানে এগিয়ে এসেছেন এবং তারা কোন গাফিলতি করেননি, নিজেদের ঝুঁকি জেনেও তারা কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই কাজে যারা সবসময় নিয়োজিত ছিলেন তাদের শুধু ‘খালি মুখে ধন্যবাদ’ দিতে চাই না। আমি তাদের পুরস্কৃতও করতে চাই। যে সমস্ত সরকারী চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরু থেকেই চিকিৎসা সেবা প্রদানে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন, তাদের তালিকা করার জন্য ইতোমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি। কারণ তাদের পুরস্কৃত করতে হলে তাদের তালিকাটা আমাদের দরকার। যারা এই ধরনের সাহসী স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের উৎসাহ দেয়া আমাদের প্রয়োজন। উৎসাহের সঙ্গে আমি বিশেষ একটা সম্মানীও দিতে চাই। সেজন্য ইতোমধ্যে তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছি এবং তালিকাটা প্রস্তুতের কাজ ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে।’ দেশের এমন পরিস্থিতিতে এই সাহসী স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘উৎসাহ’ দেয়া প্রয়োজন মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা সম্মানীও দিতে চাই। এই তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, ত্রাণ বিতরণে যুক্ত অন্যান্য কর্মচারী, যারা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় দিনরাত কাজ করছেন, তাদেরও ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তাদের সবার জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এটা আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী, অর্থ সচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। কাজেই আমরা একটা ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দায়িত্বপালনকালে যদি কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন, তাঁর চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা সরকার নেবে। তাদের জন্যও একটা স্বাস্থ্য বীমা আমরা করে দেব। যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের জন্য ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা, অর্থাৎ পদমর্যাদা অনুযায়ী ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার একটা স্বাস্থ্যবীমা আমরা করে দেব। আর মৃত্যুর ঝুঁকি আছে বা কেউ যদি খোদা না করুক মৃত্যুবরণ করেন, তাদের জন্য এই বীমাটা আমরা ৫ গুণ বৃদ্ধি করে দেব। এ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান আরও বলেন, ‘মনে রাখতে হবে এটা তাদের জন্যই করব যারা এই করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকে কাজ করেছেন। অর্থাৎ জানুয়ারি মাস থেকে শুরু। মূলত মার্চ মাস থেকে এটা ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। এই মার্চ মাসে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন এই প্রণোদনাটুকু তাদের জন্য। আর যারা কাজ করেন নাই, যারা নিজেদের সুরক্ষা করার জন্য পালিয়েছেন, যেখানে রোগীরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে চিকিৎসা পায়নি, অন্য সাধারণ রোগীরাও চিকিৎসা পায়নি। তাদের জন্য এই প্রণোদনা নয়। তারা এটা পাবেন না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ যদি মনে করেন যে সরকার প্রণোদনা দিলে তারা কাজে নামবেন, তাহলে সরকার আগে তাদের কাজ দেখবে। আমি বলব প্রণোদনা নিতে হলে আগামীতে কীভাবে কাজ করেন, এই দুঃসময় যে যাবে তা আমরা পর্যবেক্ষণে রাখব। অন্তত এই তিন মাস তাদের কাজ দেখব। সেখানে দেখব কেউ সত্যিকারভাবে মানুষের সেবা দেন কিনা। তারপরে তাদের কথা আমরা চিন্তা করব। কিন্তু শর্ত দিয়ে কাউকে আমি কাজে আনব না। যাদের মধ্যে এই মানবতাবোধটুকু নেই, তাদের জন্য প্রণোদনা দেয়ার কোন যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। অনিয়ম করলে কাউকে ছাড়ব না ॥ প্রধানমন্ত্রী পুনর্বার সবার প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আমরা দেখি এবং সবসময় দেখা গেছে। এই ধরনের দুঃসময় আসলে কিছু লোক তাদের ভাগ্যে পরিবর্তনের চেষ্টা করে বা নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে। মানুষের দুর্ভোগের সময় কেউ যদি সুযোগ নেয় কিংবা নিজেদের সুযোগ হিসেবে টাকা-পয়সা বানাতে চায় বা আমরা যাদের কষ্ট করে সাহায্য দেব, সেখান থেকে কেউ নয়ছয় করে বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয়, তারা কিন্তু ধরা পড়ে যাবেন। লুকাতে পারবেন না। ধন-সম্পদ লুকানো যায় না। এমনটা হলে আমি কিন্তু তাদের ছাড়ব না। আমি এতটুকু তাদের ছাড় দেব না, এটা স্পষ্ট কথা। তিনি বলেন, আমাদের যারা বিভিন্ন জেলায় কর্মরত আছেন, তারা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কষ্ট করে যাচ্ছেন। যেহেতু মানুষ স্বাভাবিক জীবনে বের হতে পারছে না। মানুষ কাজ করে খেত, সেই কাজটা করে খেতে পারছে না। তাদের জীবন-জীবিকার পথ অনেকটাই প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। যারা চাকরিজীবী বা বেতন পাচ্ছেন- তাদের কথা আলাদা। কিন্তু প্রতিদিনই যারা দিন আনে দিন খায়, ছোট ছোট ব্যবসা করে খেত, অল্প পুঁজি দিয়ে সামান্য কামাই করে সংসার চলতো- তাদের সেই কাজগুলো বন্ধ হয়ে আছে। এইভাবে বহু লোককে কিন্তু এখন নানা কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। আমাদের সাধ্যমতো তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে কোন ধরনের নয়ছয় সহ্য করা হবে না। এপ্রিল মাসটা বড় দুঃসময় ॥ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা জানি যে, এপ্রিল মাসটা আমাদের জন্য খুব একটা দুঃসময়ের মাস আসছে। এটা সব জায়গা থেকে খবর পাচ্ছি। কাজেই কারোর মধ্যে যদি এতটুকু করোনাভাইরাসজনিত অসুস্থতা দেখা দেয়, দয়া করে তিনি সঙ্গে সঙ্গে খবর দেবেন। চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা আছে, আমরা প্রচুর চিকিৎসা ব্যবস্থা করে রেখেছি। আর যারা চিকিৎসা সেবা দেবেন, তাদের পিপিইসহ সব ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে। দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘অসুস্থতা কেউ লুকাতে যাবেন না। কারণ আপনি লুকাবেন, আপনি আরও দশজনকে সংক্রমিত করবেন। কাজেই সেটা লুকাবেন না। আর কিছু কিছু মানুষ আছে যে, এই রকম অসুখ হলেই মনে করছে সে বুঝি অচ্ছুৎ হয়ে গেল। তাকে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, তার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। এটা কিন্তু না। কাজেই এই মানসিকতাটা সকলকে পরিহার করতে হবে। এখানে সবাইকে মানবিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ রোগ এটা, কার কখন হচ্ছে কেউ বলতে পারে না। আজকে যিনি একজনকে ঘৃণার চোখে দেখবেন, কালকে আপনিও সংক্রমিত হতে পারেন। তখন আপনার কী হবে।’ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মানসিকতাটা সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। মানুষ মানুষের জন্যই। মানবতা নিয়ে সবাইকে এগুতে হবে। কাজেই আপনারা সেভাবেই এবং সেই মানসিকতা নিয়ে চলুন। দেশবাসীর প্রতি এটাই আমার আহ্বান। কারণ আমরা বাঙালী। আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি। কাজেই এই ঐক্যের একটা মূল্য আছে। ত্যাগের একটা মূল্য আছে। কাজেই সেই কথাটা মনে রেখেই আপনারা সবাই কাজ করবেন। যারা হাত পাততে পারে না তাদের ঘরে খাদ্য পৌঁছে দিন ॥ ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী সামাজিক নিরাপত্তার বাইরে যারা রয়েছেন, তাদেরও সহায়তা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য জেলা প্রশাসকসহ জনপ্রতিনিধিদের প্রতি নির্দেশনা দেন। মাঠের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, যাদের আমরা সামাজিক নিরাপত্তায় সাহায্য দিচ্ছি, তাদের তো দিচ্ছিই। কিন্তু এর বাইরের যে শ্রেণীটা, যারা হাত পাততেও পারছে না, তাদের তালিকা তৈরি করে তাদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া, এই কাজটা আপনারা করবেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে দেশবাসীর প্রতি আবারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। এপ্রিল মাস নিয়ে চিন্তা থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে চিন্তার কিছু নেই, এগুলো আমরা সবসময় মোকাবেলা করেছি, আমরা মোকাবেলা করতে সক্ষম হব। তবে কারও মধ্যে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে তা গোপন না করে দ্রুত চিকিৎসা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কোভিড-১৯ করোনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য যে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেই নির্দেশনাগুলো দয়া করে আপনারা মেনে চলবেন। তবে সবাইকে বলব, কেউ লুকাতে যাবেন না। সুরক্ষিত থাকবেন। কারও এতটুকু খারাপ লাগলে, অসুখ মনে হলে ডাক্তারের কাছে যাবেন, চিকিৎসা নেন, দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন। যারা কষ্টে আছেন তাদের তালিকা করুন ॥ মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের মধ্যে যারা কষ্টে আছেন তাদের দ্রুত তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভ্যানচালক, রিক্সচালক, দিনমজুর, চা বিক্রেতাসহ যেসব পেশাজীবীকে চলমান লকডাউনের মধ্যে সংসার চালাতে বেগ পেতে হচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই কমিটি করে তাদের দেয়া তালিকা অনুযায়ী কষ্টে থাকা মানুষগুলোর ঘরে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ারও নির্দেশ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সামাজিক সুরক্ষার কাজগুলো অব্যাহত থাকবে। কিন্তু তার বাইরে শ্রেণীটা কাজ করে খেত কিন্তু এখন সেই উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে- সেই শ্রেণীটা যেন কষ্ট না পায়। দেশের কোন মানুষ যেন কষ্ট না পায়। তাই তাদের খুঁজে বের করা, তাদের তালিকা করা। আমি অনুরোধ করব, এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি এলাকার সংসদ সদস্য, চেয়ারম্যান, মেয়র, কমিশনারদের নিয়ে কমিটি গঠন করে এই তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটা ইউনিয়নে একটা ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি থাকবে এবং সেই কমিটি আমরা ভিজিএফ, ভিজিডি যাদের দেই তাদের জন্য না। তাদের তো তালিকা আছেই। তাদের বাদ রেখে বা সরকারের ভাতা যারা পাচ্ছে এর বাইরে যেই শ্রেণীটা যারা নিজেরা খেটে খেত, রিক্সাচালক, ভ্যানচালক, চায়ের দোকানদার এমন অনেক ধরনের মানুষ কিন্তু জীবন জীবিকা করে খেত তাদের একটা তালিকা করতে হবে। সকলে মিলে এই তালিকাটা এমনভাবে করা যেন সত্যিকার যার অভাব রয়েছে, কষ্ট পাচ্ছে তাদের তালিকাটা যেন হয়। তাদের কাছে যেন সাহায্যটা পৌঁছে। সবাই মনে রাখবেন- অনেকে হাত পারততে আসবে না, অনেকে চাইতে পারবে না। তাকে মুখ বুজে কষ্ট সহ্য করতে হবে। এটা আমি চাই না। অদৃশ্য করোনা গোটা বিশ্বকে স্থবির করেছে ॥ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, সারাবিশ্বে যুদ্ধ হয় বড় বড় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। আর এখানে সামান্য একটা করোনাভাইরাস, যা কেউ চোখে দেখছে না। কারো চোখে পড়েনি এই জিনিসটি কি? কিন্তু এই ভাইরাসটি এতই শক্তিশালী যে, সমস্ত বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। সমস্ত বিশ্বই এখন বলতে গেলে স্থবির। ধন-সম্পদ-টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, অথবা যারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মনে করত বিশ্বে সব থেকে শক্তিধর, কথায় কথায় অন্য দেশে বোম্বিং করছে, কথায় কথায় গুলি করছে, কথায় কথায় মানুষ মারছে। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, এখন কোথায় গেল সেই শক্তি। শক্তি নেই, সব শেষ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের খেলা বুঝা খুব ভার। যার কারণেই আমি বলব, এই ধন-সম্পদ রেখে কোন লাভ হবে না। বরং যার যা আছে, বিত্তশালী যারা আছেন আপনারাও এই দুঃসময়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। আপনাদের প্রতিবেশী যারা তারা কী অবস্থায় আছে, সেটা একটু আপনারা দেখেন। তাদের দিকে নজর দেন, সাহায্য করেন। এই সাহায্যটাই থাকবে। এটাই মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখবে। সম্মিলিত প্রয়াসে এখনও স্বাস্থ্যপরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ॥ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখনই এই রোগের প্রাদুর্ভাবটা দেখা গেল, সেই জানুয়ারি মাস থেকে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছিলাম। তবে ধীরে ধীরে এটা বাড়তে শুরু করল। কিন্তু আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যথাযথ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তার ফলে এখন পর্যন্ত এটা অন্যান্য দেশে যেমন ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছে, সেটা এখনও হয় নাই। তবে আমাদের স্বাস্থ্যপরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণ এখনও রয়েছে। আমরা রাখতে সক্ষম হয়েছি। আর এটা সম্ভব হয়েছে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে। তিনি বলেন, আমরা এই করোনা পরিস্থিতি সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করেছি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আমি বিশ^াস করি যে, সামনে যে আশঙ্কাটা দেখা দিচ্ছে সেটাও আমরা মোকাবেলা করতে সক্ষম হব। তাতে সকলে যদি একটু সচেতন থাকেন। আমি এই ক্ষেত্রে আমাদের সরকারী চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, যারা করোনা সেবায় অবদান রেখেছেন তাদের সকলকে আমি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ আমি দেখেছি যে সরকারী হাসপাতালগুলোতে যারা কাজ করে তারাই এগিয়ে এসেছে এবং তারা কোন গাফিলতি করেনি। তারা নিজেদের ঝুঁকি জেনেও কাজ করেছে। সেই জন্য তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। চিকিৎসকসহ করোনা মোকাবেলায় দায়িত্বপালনকারী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই করোনার বিরুদ্ধে আমরা যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি, সেই যুদ্ধের সম্মুখভাবে থেকেই আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে আমি আমাদের মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, ত্রাণ বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মচারীগণ- যারা কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন- তাদের সকলকেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। কারণ আপনারাও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ এই অবস্থার মধ্যে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, যার ফলে আমরা এটা এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। অর্থনৈতিক গতিশীলতা কিছুটা থেমে গেছে ॥ ভিডিও কনফারেন্সে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে সূচনা বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল। উন্নয়নের গতি যখন অব্যাহত, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে যখন কাজ করে যাচ্ছি, ঠিক তখনই এলো করোনাভাইরাস। সারাবিশ্বে এটি প্রলয় সৃষ্টি করেছে। সবকিছু স্থবির এবং তার প্রভাবটা বাংলাদেশে এসেও পড়েছে এবং আসাটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ সমগ্র বিশে^র প্রায় ২০২টা দেশ আজকে ভুক্তভোগী এবং প্রতিনিয়ত এটা বাড়ছে। তিনি বলেন, এই অবস্থায় আমরা শুরু থেকে চেষ্টা করেছি করোনার প্রভাবে মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অন্যান্য দেশ থেকে আমরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি, তাতে আমাদের দেশেও এই ধাক্কাটা এই এপ্রিল মাসে আরও ব্যাপকভাবে আসার কথা। এরকমই একটা আলামত পাওয়া যাচ্ছে এবং এই ধরনের কিছু প্রতিবেদনও আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিছু প্রেডিকশনও দেখতে পাচ্ছি। কাজেই সেই অবস্থায় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের এমনভাবে চলতে হবে যেন, এর প্রভাবে আমাদের দেশের মানুষের ক্ষতি কম হয়। তবে এটা ঠিক যে, একটা স্থবিতরা যেটা এসে গেছে। অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সবক্ষেত্রেই তার ফলে দেখা যাচ্ছে যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গতিশীলতা আমরা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম- সেটাও কিন্তু থেমে গেছে। এটা শুধু আমাদের দেশে না, সারাবিশ^ব্যাপীই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই অবস্থাকে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে এবং আমাদের দেশের মানুষের জানমাল রক্ষা করতে হবে। আর আমাদের অর্থনৈতিক গতিশীলতা অব্যাহত রাখতে হবে। যেহেতু এখন একটা বিশ^ব্যাপী ঘটনা ঘটেছে, খুব স্বাভাবিকভাবে উন্নত দেশলোও হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের বাঙালীরাও অনেক জায়গায় মৃত্যুরণ করছে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক আমাদের জন্য। মৃত্যুবরণকারীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তিনি বলেন, আমাদের সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার সংখ্যাটাও অনেক বেশি। এটা আমাদের জন্য অনেকটা ভাল খবর। কিন্তু আমরা চাই না, এই রোগের প্রাদুর্ভাবটা আরও বৃদ্ধি পাক। আমরা চাই, এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশকিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং সবাইকে কাজ করতে হবে। করোনাভাইরাসের যে প্রাদুর্ভাবটা, এটা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার জন্য সকলকে কাজ করে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। ঘরে বসেও আল্লাহকে ডাকা যায় ॥ ভিডিও কনফারেন্সকালে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে দুটি জেলায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা বিশিষ্ট আলেমদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের হাত থেকে মুক্তি পেতে পবিত্র মক্কা শরীফ-মদিনা শরীফও কিন্তু বন্ধ করে দিয়ে দেয়া হয়েছে। মসজিদে অনেক লোক একসঙ্গে জমা হলে সেখানে সংক্রমিত হওয়ার একটা ভয় থাকে। সবাইকে মসজিদে যেয়েই নামাজ আদায় করতে হবে তা না, ঘরে বসেও করতে পারে। আল্লাহকে যেকোন জায়গায় বসেই ডাকা যায়। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন আলেম-ওলামারাও। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, সামনে আমাদের শব-ই-বরাত। সবাই যেন ঘরে বসে দোয়া-খায়ের করে। কারণ মসজিদে ভিড়টা না করা ভাল। আপনারা জানেন যে, পবিত্র মক্কা শরীফ মদিনা শরীফও কিন্তু বন্ধ এবং কারফিউ দিয়ে দেয়া হয়েছে। যেখানে মক্কা শরীফ-মদিনা শরীফই যখন কেউ যেতে পারছেন না, এই যে মসজিদে অনেক লোক একসঙ্গে জমা হওয়া, এটাও কিন্তু সংক্রামক হওয়ার একটা ভয় থাকে। সরকারপ্রধান বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ডাকা, যেকোন জায়গায় বসেই ডাকা যায়। কাজেই সবাই ডাকবেন। যেহেতু শব-ই-বরাত সামনে, এবারের বরাত যেন আল্লাহ আমাদের লেখেন যে, করোনা থেকে মুক্তি পাই। তাই সবাই সেই দোয়াটাই চাইবেন। এটা আপনার মাধ্যমে আমি বাংলাদেশের সবার কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, সেই দোয়া চাওয়ার জন্য। অন্তত বাংলাদেশটাকে যেন রক্ষা করতে পারি। জানি না আল্লাহর কী ইচ্ছা। এমন এক শক্তিশালী কিছু পাঠাল যা চোখেও দেখা যায় না। কিন্তু তার অপরিসীম শক্তি। সারাবিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। তাই করোনাভাইরাসে যেন আক্রান্ত না হয়, সেজন্য চাচ্ছি সবাই ঘরে বসেই দোয়া করুক। প্রধানমন্ত্রী প্রবাসী অধ্যুষিত চট্টগ্রামসহ অন্য জেলাগুলোর কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ করে বলেন, এখন বিমান বন্ধ। তবুও প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনদের বলে দিতে হবে, যাতে এখন কেউ যেন দেশে না আসে। আর বিদেশ থেকে যারাই আসবে তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখার পর আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মেলামেশার পরামর্শ দিতে হবে। এ বিষয়টার দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। আর ১৩টি জেলার সঙ্গে কথা বললাম। দেখতে পাচ্ছি প্রায় জেলাগুলোতেই করোনার ছোবল পড়েনি। এভাবেই সবাইকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।
×