ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একটি নয়, দুই রাক্ষসের কবলে বিশ্ব

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ৮ এপ্রিল ২০২০

একটি নয়, দুই রাক্ষসের কবলে বিশ্ব

করোনাভাইরাসের প্রকোপ এখনও কমেনি। কিন্তু ইতোমধ্যেই আরেকটি আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সেটি হলো এই ধ্বংসের পর সারা পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেবে তা কিভাবে মোকাবেলা করা যাবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন আগামী দিনের মন্দা করোনাভাইরাসের চাইতেও ভয়াবহ হবে। ব্রিটেনের অবস্থা কি হবে তা নিয়ে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদরা কোন আশার বাণী উচ্চারণ করতে পারছেন না। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারে আছেন। ব্রেক্সিটের ধাক্কা ব্রিটেন কিভাবে সামাল দেবে তা স্থির হয়নি। ব্রেক্সিট ছাড়ার পর ব্রিটেন এখন একা। ব্রিটেনের রানী আশা করছেন ৫৪টি কমনওয়েলথ দেশ ব্রিটেনের পাশে থাকবে। কিন্তু মুশকিল হলো কমনওয়েলথ এখন আর একটি সক্রিয় প্রতিষ্ঠান নয়। তার ওপর এই দেশগুলো করোনায় আক্রান্ত। সুতরাং কে কাকে কতটা সাহায্য করতে পারবে তা সন্দেহের বিষয়। ইউরোপের দেশগুলোও এখন ভাবছে, এই মন্দা তিরিশের মন্দার চাইতেও খারাপ হবে। ইউরোপ উৎপাদন বাড়িয়ে মন্দাকে প্রতিহত করবে সে সম্ভাবনা কম। আমেরিকারও একই সমস্যা। সাধারণ জিনিসপত্রের জন্য চীনের ওপর নির্ভর করে আমেরিকা সামরিক উৎপাদন বাড়িয়েছে। ইদানীং দুদেশের মধ্যে চলছিল ট্রেড ওয়ার। এখন চীনের উৎপাদনও ব্যাহত। চীন কতটা আমেরিকার সাহায্যে এগুতে পারবে এবং আমেরিকা তা নিতে পারবে কিনা তা সন্দেহের বিষয়। এশিয়া আফ্রিকার বহু দেশের অর্থনীতি চীনের ওপর নির্ভরশীল। চীনের অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত হওয়ায় দেশগুলো আর আগের মতো চীনের ওপর নির্ভর করতে পারবে না। সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশও রেহাই পাবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে। এই প্রভাব থেকে দেশকে কিভাবে বাঁচানো যায় তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা আলোচনা শুরু করেছেন। সম্প্রতি ঢাকায় করোনাভাইরাস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে শীর্ষক একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলেছেন বাংলাদেশের উচিত চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা। এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান বিপর্যয় চীন শীঘ্রই কাটিয়ে উঠবে এটা আশা করা যায়। কারণ উহান প্রদেশে করোনার বিপর্যয় চীন কাটিয়ে উঠেছে মনে হয়। চীনের জনশক্তি বিপুল। এই জনশক্তি দ্বারা তারা চাইবে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং বিশ্ব বাজারে তাদের রফতানি বাজার ঠিক রাখা। এটা পুরোপুরি ঠিক না করা গেলেও তারা পশ্চিমা দেশের চাইতে আগে মন্দা কাটিয়ে উঠবে। চীনের সঙ্গে অবশ্যই আমাদের অর্থনৈতিক নির্ভরতা ক্রমশ কমিয়ে আনা উচিত এবং নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানো আবশ্যক। এটা শুধু এই বিপর্যয়ের সময়েই নয়, সব সময়ই করা উচিত। তবে এই নির্ভরতা কমানোর নামে যেন চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ক্ষুণœ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আসন্ন মন্দা রোখার জন্য প্রত্যেক দেশেরই উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে দেখা যাবে এই বিশ্বমন্দা মোকাবেলা করার জন্য সব দেশের মধ্যেই সহযোগিতা বাড়ছে। চীন ও আমেরিকার মধ্যেও এই সহযোগিতা বাড়বে। নইলে বিশ্বমন্দাকে রোখা যাবে না। তবে ট্রাম্প প্রশাসন এই বিপদের দিনেও নতুন ফন্দি আঁটতে পারে। এশিয়া আফ্রিকায় চীনের কাছে তারা যে বাজার হারিয়েছে, তা শুধু উদ্ধার নয়, ওই বাজার থেকে চীনকে সম্পূর্ণ উৎখাতের জন্য তারা চেষ্টা চালাতে পারে। তাদের এই চেষ্টা সফল হলে বিশ্বের এক বৃহৎ এলাকায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব আবার ফিরে আসতে পারে। এজন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একটি নতুন বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংঘবদ্ধ হতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভারতেরও অবদান রয়েছে। শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণে সমতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখায় এই উন্নতি দ্রুত হয়েছে। ভবিষ্যতেও বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বিদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় এই সমতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে হবে। কেউ কেউ একটা সন্দেহ করছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের উৎপাদন বাড়াবে- এই ধুয়ার আড়ালে চীনের সঙ্গে সহযোগিতা কমিয়ে মার্কিন সহযোগিতার ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ার জন্য এক শ্রেণীর অর্থনীতিবিদ মার্কিন স্বার্থের তল্পিবাহক হয়ে কৌশলে প্রচার চালাতে পারে। বাংলাদেশ অবশ্যই বিদেশের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য নিজস্ব উৎপাদন বাড়াবে। কিন্তু এ ধরনের প্রোপাগান্ডার কবলে পড়ে যেন খাল কেটে কুমির না আনে। অর্থাৎ আগের পশ্চিমা অর্থনৈতিক আধিপত্যের জালে জড়িয়ে না পড়ে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপকে পুনর্গঠনের নামে আমেরিকা মার্শাল প্ল্যান তৈরি করে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নও যুদ্ধবিধ্বস্ত। চীন খুবই দুর্বল শক্তি। আমেরিকা ইউরোপকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়ার উছিলায় সারা মহাদেশটিতে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। একই সঙ্গে ন্যাটো-সামরিক সংস্থা গঠন করে ইউরোপের দেশগুলোতে মার্কিন সৈন্যের ঘাঁটি বানায়। ফ্রান্সের দ্য গলের বিদ্রোহের ফলে ইউরোপ মার্কিন আধিপত্যের বেড়াজাল থেকে অনেকটা মুক্ত হতে সক্ষম হয়। আমেরিকার অর্থনীতিও বর্তমানে করোনা হামলায় বিধ্বস্ত। কিন্তু তাদের সামরিক বিষদাঁত ভাঙ্গেনি। ঐ বিষদাঁতের জোরে তারা পুরনো অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে। সব উন্নয়নশীল দেশকেই এই চেষ্টা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। আসন্ন মন্দা প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশে হাসিনা সরকার আগেই তৎপর হয়েছেন। করোনাভাইরাস সঙ্কট এড়ানোর জন্য সম্প্রতি শেখ হাসিনা যে উন্নয়ন প্যাকেজের কথা ঘোষণা করেছেন, তাতে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং তা বাজারজাতকরণের সুব্যবস্থা রাখা দরকার। আমাদের পোশাক শিল্প নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় আমরা হেরে না যাই। সরকারের পক্ষে সবচেয়ে কঠিন হবে মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা। এজন্য এখন থেকেই সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে প্রস্তুত হতে হবে বর্তমানের বিপর্যয় এবং ভবিষ্যতের মন্দা রোখার জন্য। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা সতর্ক আছেন। এটাই আমাদের সবচাইতে বড় ভরসা। লন্ডন ৭ এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২০২০
×