ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কেউ সামাজিক দূরত্বে নেই, মাছ-মাংসের দোকানে মাছি...

প্রকাশিত: ১০:৫২, ৭ এপ্রিল ২০২০

কেউ সামাজিক দূরত্বে নেই, মাছ-মাংসের দোকানে মাছি...

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার প্রাচীন এ্যাডওয়ার্ড পার্কের তিনটি মূল ফটক অরুণাচল পূর্বাচল ও দক্ষিণায়ন লকডাউন হয়ে আছে। শুধু পাখি ছাড়া প্রবেশ ও প্রস্থান নেই। এই পাখি আর উড়ে আসে না। ভোরে যে চড়ুই, বাবুই, শালিক খোলা মাঠে কিচিরমিচির করতো তাও নেই। ‘কাক ডাকা ভোরের’ বেসুরে কা.. কা... ডাক রুদ্ধ হয়েছে বোধ হয়। শহরে যে কয়টি ষাঁড় ও গাই গরু নির্বিঘেœ ঘুরে বেড়াত তাও চোখে পড়ছে না। প্রতিটি সড়কে কিছু কুকুর লেজ নাড়িয়ে ঘুরঘুর করত পালিয়েছে কোথায়! রাতে হঠাৎ কোত্থেকে এসে ডাকতে শুরু করে। উপ শহর ও শহরতলী এলাকায় গভীর রাতে শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক শোনা যেত। কুকুর তাড়া করত। এই দুই প্রাণীর দৌড়ঝাঁপ বন্ধ। বাসা বাড়িতে বিড়ালের আগমন নেই। পেনিডেমিক বা বৈশি^ক মহামারী কোভিড-১৯ (করোনা) আক্রমণে বিশ^ অসহায় হয়ে মানুষ বাঁচাতে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে। অফিস আদালত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছুটি দিয়েছে সরকার। মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সেনাবাহিনী পুলিশ র‌্যাব মানুষকে ঘরে থাকতে বলছেন। বগুড়া নগরীতে লোকজন ঘরে থাকার কথা। কিন্তু..... সকালে লোকজন বাইরে আসে না। ঘণ্টা দুয়েক এই অবস্থা থাকে। এরপর এক দুই চার করে কিছু রিক্সা মোটরসাইকেল, কার, ইজিবাইক (অটো) সিএনজি চালিত অটোরিক্সা বের হয়। শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় এই ভিড় বেড়ে গেলে সেনা বাহিনী মাইকে নিজের জীবন ও অন্যের জীবন বাঁচাতে অনুরোধ করে ঘরে থাকতে বলে। লোকজন ফিরেও যায়। কিছুক্ষণ পর। ফের পূর্বাবস্থা। জেলা প্রশাসনকে যৌক্তিক কারণে কঠোর হতে হয়। প্রশাসন সেনাবাহিনী পুলিশ পৌরসভা শহরের মূল কেন্দ্র ও বিভিন্ন পয়েন্টে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে দেয় প্রতিদিন। সেনা সদস্যগণ শহরের প্রতিটি পয়েন্টে হ্যান্ডমাইকে লোকজনকে ঘরে ফিরে যেতে বলে। জরুরী প্রয়োজনে যারা ঘর থেকে বের হয়েছে তাদের কাজ সেরে কোন জটলা না পাকিয়ে আড্ডা না দিয়ে জীবন বাঁচাতেই ঘরে ফিরতে বলে। কার, মোটরসাইকেল চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। রিক্সা-ইজিবাইক ও কিছু সিএনজি চালিত অটোরিক্সা প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে অন্য সড়কগুলোতে চলতে থাকে। কত বার বলা হয় জরুরী প্রয়োজনে সামাজিক দূরত্ব বজার রেখে চলতে। তারপরও রিক্সা ও অটোরিক্সায় দুই বা অধিক ব্যক্তি চাপাচাপি করে বসে। যারা পথে নামে কথা শুনতে চায় না। সোমবার সকাল থেকে অনেকটা সময় পর্যন্ত হেঁটে বগুড়া শহরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেল-প্রধান সড়ক ছাড়া অন্য সড়কগুলোতে কিছু লোক বের হয়েছে। ফতেহ আলী বাজারে লোকজন মাছ, মুরগি, মাংস তরিতরকারি কেনাকাটা করছে। কেউ সামাজিক দূরত্বে নেই। অনেকের মাস্ক নেই। মাছ বিক্রেতারা বালতি থেকে হাতের তালুতে পানি নিয়ে মাছের ওপর ছিটিয়ে দিচ্ছে। মাংসের দোকানে মাছি ভন ভন করছে। মাস্ক মুখে আছে তবে চিবুকের নিচে। ক্রেতা-বিক্রেতা টাকা গুনছে। লেনদেন হচ্ছে। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বালাই নেই। বাজারে আসা এক ক্রেতা বললেন বাড়িতে গিয়ে থলে বাইরে রেখে দুয়ারের কাছে রাখা ব্লিচিং মেশানো পানি স্প্রে করে নেন। তারপর হাত ধুয়ে স্যানিটাইজ করে বাজারের থলে থেকে পণ্য বের করে গৃহিণী। যতটা পারেন সুরক্ষায় থাকেন। আরেকজনের সঙ্গে কথা বললে তিনি খোশ মেজাজেই বলেন ‘আর কত দিন রুটিন করে হাত ধোয়া স্যানিটাইজ করতে হবে। যতটা পারা যায় তা করছি।’ সূত্রাপুর এলাকার বেসরকারী সংস্থার কর্মকর্তা এসএম সদরুল হক বললেন, আতঙ্কের দিনরাত্রি কেটে যায় সংবাদপত্র পড়ে, টিভি দেখে, গান শুনে, স্বজনদের সঙ্গে কখনও ফোনে কথা বলে। কম্পিউটারে বসে। খাওয়া দাওয়া আর ঘুম পাড়া। বললেন ‘ঘরে আর কত বসে থাকি রে ভাই তবুও মানুষ বাঁচুক। রোগ বালাই দূর হয়ে যাক।’ গৃহিণী কামরুন নাহার জেসমিন বললেন-গত ডিসেম্বর মাসে তার বোন নাজরীন ও ভগ্নিপতি আমেরিকা বেড়াতে গেছে ছেলেদের কাছে। মেসেঞ্জারে মাঝে মধ্যেই ভিডিও কল হয়। বৈশি^ক আতঙ্কের খোঁজখবর নেন। সুখ দুঃখের কথা ভাগাভাগি করেন। তার স্বামী চাকরি করেন। ব্যক্তি সুরক্ষায় ঘর থেকে বের হন। বড় মেয়ে জোশিতা ঢাকায় এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। তার সঙ্গেও মেসেঞ্জারে কথা হয়। ছোট মেয়ে পৃথ্বা বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী। কলেজ খুললে পরীক্ষা। ঘরেই পরীক্ষার প্রস্তুতির পাঠ নিচ্ছে। গৃহিণী জেসমিনের এভাবেই সময় কাটে। এর মধ্যেই রান্না ও ঘর গৃহস্থালি খবরের কাগজ পড়া টিভি দেখা। বললেন খবর ছাড়া এখন আর টিভির কোন অনুষ্ঠান দেখতে ভালো লাগে না। স্বজনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে অনেকটা সময় কাটে।
×