ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রিয়জনদের বিদায় জানাতে হচ্ছে দূর থেকে

প্রকাশিত: ২২:৫০, ৬ এপ্রিল ২০২০

প্রিয়জনদের বিদায় জানাতে হচ্ছে দূর থেকে

অনলাইন ডেস্ক ॥ খন কেউ তার প্রিয়জনকে হারায়, সেই কষ্ট সামলানো প্রত্যেকের জীবনের কঠিন সময়গুলোর একটি। কিন্তু এখন স্বজনকে বিদায় জানানোর সেই ব্যাপারটিকে আরও কঠিন আর বেদনা-বিধুর করে তুলেছে করোনাভাইরাস। এখনকার চরম বাস্তবতা হলো, ভাইরাসের আক্রমণ থেকে সবাইকে নিরাপদ রাখা। ফলে খুব অসুস্থ এবং মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তিরাও তাদের স্বজনদের পাশে পাচ্ছেন না। সাধারণত যেভাবে শেষকৃত্যানুষ্ঠান করা হয়ে থাকে, সেভাবে হচ্ছে না। মানুষজন এমনকি একসাথে মিলে শোক পালনও করতে পারছে না। তারপরেও প্রিয়জনকে স্মরণ করতে, তার জন্য শোক করার জন্য অর্থবহ কিছু উপায় রয়েছে। ’সবচেয়ে কঠিন হলো একত্রে থাকতে না পারা’ : নর্থফোক এন্ড নরউইচ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ আইক স্কিনডারের ৯৯ বছর বয়সী দাদাকে যখন বক্ষব্যাধির সমস্যা নিয়ে গত সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, তখন তিনি জানতেন যে, তার দাদা হয়তো আর বাড়িতে ফিরে আসবেন না। ’’সাধারণ সময় হলে হয়তো আমাদের কেউ তাঁর সঙ্গে যেতাম। সেখানে হয়তো আমরা তার ব্যাপারে আলোচনা করতাম এবং পরিবারের সদস্যদের জানাতাম। কিন্তু এখন তার বদলে তার সঙ্গে এখন আমাদের রিমোট যোগাযোগ করতে হচ্ছে।’’ তিনি বলছেন। তিনি বলছিলেন, লন্ডন রয়েল ফ্রি হাসপাতাল খুব ভালো একটি হাসপাতাল, কিন্তু টেলিফোনে কথা বলার জন্য সেখানে খুব কম সময় পাওয়া যায়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, হাসপাতালে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি দেখা করতে পারবেন। কিন্তু তাকেও মাস্কসহ সুরক্ষা সরঞ্জাম পরতে হবে। এরপর পরবর্তী ১৪দিন তাকে আইসোলেশনে থাকতে হবে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, স্কিনডারের খালা তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। "একপর্যায়ে আমরা বুঝতে জানতে পারলাম, সেখানে একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা জানার পরেও আমার ওই খালা সেখানে অংশ নিতে পারেননি, কারণ তখন দাদাকে দেখে আসার কারণে তিনি আইসোলেশনে রয়েছেন।" মি. স্কিনডার বলছেন, যখন তার দাদার মৃত্যু হয়, তখন পরিবারের সবাই বুঝতে পারছিলেন যে, এখানে নতুন করে আর কিছু করার নেই। তবে সবচেয়ে দুঃখের বিষয়টি ছিল এরকম একটি সময়েও পরিবারের সদস্যদের একত্রিত হতে না পারা। যেদিন শেষকৃত্যানুষ্ঠান হয়, সেদিন তিনি বাড়িতে আইসোলেশনে ছিলেন, কারণ তার দুই বছর বয়সী শিশুটি জ্বরে ভুগছিল। দাদার শেষ বিদায় অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হতে না পেরে জুমের মাধ্যমে ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়। তাদের ১২জন আত্মীয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসে সেই অনুষ্ঠান দেখেন। শুধুমাত্র তার মা, বাবা আর বোনরা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। তার পিতামাতার কাছ থেকে দুইমিটার দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বোন। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পরে পরিবারের সদস্যরা আরেকটি জুম অ্যাপ ব্যবহার করে আরেকটি মিটিং করেন। সেখানে তারা সদ্য বিদায়ী দাদার স্মরণে নানা গল্প করেন, টোস্ট পান করেন পুরো ব্যাপারটি হয় রিমোট বা দূর প্রযুক্তি ব্যবহার করে। মি. স্কিনডার বলছেন, "এটা একেবারেই বাস্তবের মতো লাগছিল না।" শেষকৃত্যানুষ্ঠান নিয়ে কী বলছে ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিভাগ? যারা শেষকৃত্যানুষ্ঠান পরিচালনা করবেন, তাদের অবশ্যেই দায়িত্ব হবে যাতে যতটা সম্ভব কম মানুষ উপস্থিত থাকেন। শুধুমাত্র ওই পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা সেখানে অংশগ্রহণ করবেন। করোনাভাইরাসের লক্ষণ রয়েছে, এমন কেউ সেখানে অংশগ্রহণ করবেন না। পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত না হলে খুব কম সংখ্যক বন্ধু অংশ নিতে পারেন। সেখানে এমন কোন ক্রিয়াকর্ম করা যাবে না, যাতে মৃতদেহের কাছাকাছি বা সংস্পর্শে কাউকে আসতে হয়। ৪০ বছর ধরে শেষকৃত্যানুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন ফিউনারেল ডিরেক্টর লিয়ানা চ্যাম্প। তিনি বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি আসলেই হৃদয়বিদারক। "এটা দেখা খুবই হৃদয়বিদারক যে, পরিবারের সদস্যরা ছয় ফিট দূরে দূরে বসে আছেন, একজন আরেকজনকে স্পর্শও করতে পারেন না।"’ তিনি বলছেন, "আপনি ভাবতে পারেন যে, তাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যে, শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নিতে কে কে যাবেন আর কে যাবেন না!" "করোনাভাইরাসের কারণে শেষকৃত্যানুষ্ঠান এমন কিছুতে পরিণত হয়েছে, যা আমাদের অচেনা। যখন কেউ মারা যায়, মানুষ কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার কথা ভাবে, একত্রে থাকার কথা ভাবে।" "কিন্তু করোনাভাইরাসের ভীতি আমাদের জীবন-মৃত্যু সবকিছুতে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। পরিবর্তন এনেছে মানুষের শেষ বিদায়ের মতো আনুষ্ঠানিকতাতেও।" লেখক ও শোক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মিজ চ্যাম্প মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দেয়া যে, দাফনের মতো অনুষ্ঠানে যাতে কোন বন্ধু বা স্বজনদের উপস্থিতি না থাকে। "মানুষ যখন শোকের মধ্যে থাকে, তখন পরিচ্ছন্নটার ব্যাপারে কম সতর্ক থাকে-যেমন তারা চেয়ার-টেবিল স্পর্শ করে ফেলে অথবা তাদের নাক পরিষ্কার করে ফেলে। এখানে আরও অনেক মানুষ উপস্থিত থাকে, তাদের স্বাস্থ্য সতর্কতারও ব্যাপার রয়েছে," তিনি বলছেন। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, যে জীবন বেঁচে রয়েছে, মানুষের এখন সেদিকেই বেশি নজর দেয়া উচিত। যিনি মারা গেছেন, বা শেষকৃত্য নিয়ে বেশি মনোযোগ বা চিন্তার সময় এটা নয়। আপনি যদি প্রিয় কারো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নিতে না পারেন, সেই অনুষ্ঠান চলার সময় আপনি বরং তাঁর একটি ছবির সামনে মোমবাতি জ্বালাতে পারেন। "এর মাধ্যমে আপনার একটি মানসিক সংযোগ তৈরি হবে। অথবা আপনি তার জন্য প্রার্থনা করতে পারেন।" "সেই সঙ্গে পরস্পর কথা বলাও খুব গুরুত্বপূর্ণ-অন্য কারো সঙ্গে নিজের অনুভূতি বিনিময় করা জরুরি। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করাও খারাপ নয়। আর চোখ থেকে পানি যদি গড়িয়ে পড়তে থাকে, সেটাকেও বাধা দেয়ার কিছু নেই।" ‘ভালোবাসার মানুষটি জানে, আপনি তাকে ভালোবাসেন’ : সেবা ও যত্ন বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অ্যান্ডি ল্যাংফোর্ড বলছেন, যারা শোকের ভেতরে রয়েছেন,তাদের জন্য তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন যেন, তারা টেলিফোন ও অনলাইনের মাধ্যমে একে অপরের সংস্পর্শে থাকেন। যারা শোকের মধ্যে রয়েছেন, অন্যরা যেন তাদের সাত্বনা দেন। "বিষয়টা এমন নয় যে, সবসময়ে সঠিক শব্দ বলতে পারা যাবে। কারণ সবসময়ে আসলে সঠিক কথাটি খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু আপনি এটা বোঝাতে পারেন যে, আপনি তার জন্য রয়েছেন এবং তার বিষয়ে ভাবছেন। সে সময় অনেক একা লাগতে পারে। কিন্তু আপনি সঠিকভাবে সময় দিতে পারলে সেটা হয়তো অনেকটা কাটানো যায়।" ২৬ বছর বয়সী সু জিল ক্রুজ নামের সেবাদাতা ওই প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করেন। তিনি মূলত শোক কাটাতে শিশুদের সহায়তা করেন। বর্তমানে তিনি শিশুদের অভিভাবক বা তাদের যত্নদানকারীদের ফোন ব্যবহার করে এই সেবা দিচ্ছেন। "আমার মতে কারো শেষ সময়টা খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়েই আমরা তাদের বিদায় জানানোর সুযোগ পাই আর বলতে পারি, আমরা তাদের ভালোবাসতাম। এখন তাদেরকে প্রিয়জনের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।" "কিন্তু আমরা যাদের ভালোবাসি, তারা জানেন যে, আমরা তাদের ভালোবাসি। হয়তো সেটা আমরা যথেষ্ট সংখ্যকবার বলি না, কিন্তু এই তথ্যটি সবার ভেতরেই রয়েছে।" তিনি বলছেন, কাউকে স্মরণ করার অনুষ্ঠান ভবিষ্যতেও পালন করা যাবে। "তখন হয়তো আরো ভালোভাবে কাউকে স্মরণ করার ও বিদায় জানানো যাবে। তখন সবাই একত্রে মিলে সেটা করতে পারবেন।" সূত্র : বিবিসি বাংলা
×