আজাদ সুলায়মান ॥ এমনিতেই খুঁড়িয়ে চলছিল দেশের সরকারী বেসরকারী সব এয়ারলাইন্স। তার ওপর হঠাৎ করোনার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে এভিয়েশন খাত। এটা শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়-তাবত দুনিয়ার। এ খাতে সারাবিশ্বে বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য ইতোমধ্যে প্রচারিত হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ গণমাধ্যমে। বাংলাদেশেও প্রাথমিক অনুমিত হিসেবে গত তিন মাসে বিমানসহ অপর তিনটে এয়ার লাইন্সের অন্তত ১২৯২ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেরই গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্র্যন্ত লোকসান ধরা হয়েছে ৪১২ কোটি টাকা। দেশের বৃহত্তম বেসরকারী এয়ারলাইন্স ইউএস বাংলার ধরা হয়েছে ২৭১ কোটি টাকা, নভোর ৩৭৮ কোটি টাকা, ও রিজেন্টের ২১১ কোটি টাকা। ধুঁকিয়ে চলা এভিয়েশন খাতের এই আঘাতের ধকল সয়ে টিকতে পারবে কিনা এয়ারলাইন্সগুলো সেটা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। আশীষ রায় চৌধুরীর মতে-এখন একমাত্র ভরসা সরকার। সরকার যদি কিছু বিশেষ প্রণোদনাসহ কিছু বিষয় মওকুফ করে তবেই যদি এয়ারলাইন্স ঘুরে দাঁড়ায়। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ছোবলে সারাবিশ্ব আজ বিপন্ন, সবচেয়ে বিপর্যস্ত এভিয়েশন খাত। একের পর এক ফ্লাইট বন্ধে দেশের চারটি বিমান সংস্থার প্রায় সব উড়োজাহাজ এখন গ্রাউন্ডেড। স্থবির হয়ে পড়া দেশের এভিয়েশন খাতে আয়ের পথ রুদ্ধ হলেও ব্যয় থেমে নেই প্রতিষ্ঠানগুলোর। সিভিল এভিয়েশন চার্জ, উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মীদের বেতনসহ নানা ব্যয় টানতে গিয়ে তাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি শোচনীয় অবস্থা রিজেন্টের। এরই মধ্যে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ তিন মাসের জন্য কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। বিমান, ইউএস বাংলা ও নভোর অবস্থাও ত্রাহি ত্রাহি। শুধু এভিয়েশন কেন দেশের সবখাতই তো স্থবির। এ অবস্থায় সরকারের সহায়তা ছাড়া টিকে থাকা দুষ্কর হবে দেশীয় সরকারী বেসরকারী সব এয়ারলাইনসগুলোর। তারা ইতোমধ্যে চিঠি দিযেছে সরকারের কাছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন দেশের বিমান সংস্থাগুলোর প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে। আর্থিক বিষয়গুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশিষ্ট সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এভিয়েশন শিল্পকে বাঁচাতে যেভাবে দেখা হচ্ছে, আমরাও সেই পদক্ষেপ নেব।
এভিয়েশন খাতে বিপর্যয় কাটাতে সরকারের কাছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো চার্জ মওকুফসহ এভিয়েশন খাতের জন্য পৃথক ‘রেসকিউ প্যাকেজ’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বিমান, ইউএস বাংলা, নভো ও রিজেন্ট। এখন দেশের সব ফ্লাইট গ্রাউন্ডেড। সবেধনমনি হিসেবে শুধু চীনে সপ্তাহে একটি ফ্লাইট চালাচ্ছে ইউএস-বাংলা। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটেও সব ফ্লাইট ৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে। এ সময় আরও বাড়তে বলে আভাস দিয়েছে দেশী বিদেশী সিভিল এভিয়েশন। এখন প্রশ্ন উঠছে কিভাবে চলমান বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ দেশের চারটি এয়ারলাইনন্স। কেননা এগুলোর সব উড়োজাহাজই গ্রাউন্ডেড।
জানা গেছে- বর্তমানে এ চারটে কোম্পানিরই মোট উড়োজাহাজের সংখ্যা ৪৫টি। ইউএস-বাংলার একটি উড়োজাহাজ ছাড়া বাকি সবই গ্রাউন্ডেড। একমাত্র ইউএস বাংলার একটা ফ্লাইট চলছে গুয়াংজু রুটে। এর মধ্যে বিমানের বহরে আছে ১৯টি উড়োজাহাজ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের বহরে ১৩টি, নভোএয়ারের বহরে ৭টি এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজের আছে ৬টি উড়োজাহাজ। বিমানের এমডি মোকাব্বির হোসেন জানিয়েছেন- বিশ্বের ১৭টি গন্তব্যে প্রতি সপ্তাহে ২১৮টি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। গত ১০ মার্চের পর থেকে বিমানের একের পর এক রট বন্ধ হতে থাকে। সবশেষ গত শনিবার ৩০ জানুয়ারি দুটি রুট লন্ডন ও ম্যানচেস্টারে বিমানের ফ্লাইট বন্ধ হয়েছে যায়। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত এই দুটি রুটে ফ্লাইট চলাচল স্থগিত করে বিমান। অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলছে না বিমানের। এই তিন মাসে টিকেট বিক্রি বাবদ ২৪০ কোটি ১৭ লাখ ফেরত দিতে হবে বিমানকে। মার্চ মাসে আমাদের কোন টিকেট বিক্রি হয়নি। উল্টো আগাম টিকেট যারা কেটেছিলেন তাদের টাকা ফেরত দিতে হয়েছে। শুধু করোনার দরুণ গত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ১২৭৯ কোটি টাকার আর্থিক চাপে পড়েছে বিমান। যার মধ্যে সরাসরি লোকসানের পরিমাণ ৪৩২ কোটি টাকা। রুট ও আয় কমে যাওয়ায় বিমানের সব কর্মকর্তার ওভারটাইম ভাতা প্রদান বাতিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে ষষ্ঠ থেকে তদুর্ধ কর্মকর্তাসহ ককপিট এবং কেবিন ক্রুদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ হারে কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। হজ মৌসুমে ২০১৯ সালে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার হজযাত্রী বহন করেছিল বিমান। এবার সেটি নিয়েও অনিশ্চয়তায় রয়েছে বিমান।
এ সম্পর্কে বিমানের এমডি মোকাব্বির হোসেন বলেন, টিকেট বিক্রি না হলেও, ফ্লাইট না চললেও কিন্তু খরচ বসে নেই। গত মাসে একটা টিকেট বিক্রি হয়নি। অথচ বিমানের খরচ যেসব খাতে রয়েছে, সেগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। যেমন ধরুন ১২টি উড়োজাহাজ বিমানের সম্পদ। এগুলো টিকেয়ে রাখতে হবে। লিজে আনা বাকি উড়োজাহাজগুলোসহ ১৮টি উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ে এপ্রিল মাসে লাগবে ২৬৬ কোটি টাকা। লিজে আনা উড়োজাহাজের জন্য এপ্রিলে প্রয়োজন ৯৮ কোটি টাকা। উড়োজাহাজের কিস্তির জন্য ৭০ কোটি টাকা। বিমানের বিশাল কর্মী বহরের বেতন ও বিভিন্ন দেশে অফিস রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মাসে ২০৩ কোটি টাকা। এসব কিছুর জন্য এপ্রিল মাসে খরচ ৫৩৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হওয়া টিকেট ফেরত নিয়ে যাত্রীদের দিতে হবে ১৪ কোটি টাকা। এ সঙ্গে গত তিন মাসে রাজস্ব আয়ে ক্ষতি হয়েছে ৪০২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিমান চলতি বছরের তিন মাসে বিমান ১২শ’ কোটি টাকার বেশি আর্থিক চাপের মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এই অঙ্ক আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই সার্বিক বিষয় উচ্চপর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে আপদকালীন ফান্ড চেয়ে ইতোমধ্যে চিঠি পাঠানো হয়েছে।