ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মীম নোশিন নাওয়াল খান

তিতলির ঘরে থাকা

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ৪ এপ্রিল ২০২০

তিতলির ঘরে থাকা

তিতলি ধপাস করে বিছানায় গিয়ে বাবার পাশে শুয়ে পড়ল। বাবা তাকে দেখে হাতের পত্রিকাটা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো মেয়েটার? তিতলি মন খারাপ গলায় বলল, আর বাসায় থাকতে ভাল লাগছে না বাবা। ঘুরতে যেতে কেন নিষেধ করছে সবাই? বাবা হাসলেন। মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, এখন বেড়াতে যাওয়ার সময় না, মা। বেড়াতে যাওয়ার জন্য স্কুল ছুটি দেয়নি। এই ছুটিটা দিয়েছে বাসায় থাকার জন্য। এখন একটা খারাপ সময়। আমাদের উচিত নিজের জায়গা থেকে যতটা সম্ভব সহযোগিতা করা এই সময়টা পার করার জন্য। আর সেটা করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে বাসায় বসে থাকা। দেখছ না মা, অফিস-আদালত সব বন্ধ। করোনাভাইরাস একটা ছোঁয়াচে রোগ। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া আমরা কেউ ঘর থেকে বেরুব না। কেবল তাহলেই সম্ভব করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা। তিতলি চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করল, বাসায় বসে থাকলে সহযোগিতা কীভাবে হলো বাবা? বাবা হেসে বললেন, সামাজিক দূরত্ব এখন সবচেয়ে দরকার। তোকে আমি একটা জিনিস দেখাই, দাঁড়া। এটা দেখলে তুই ব্যাপারটা বুঝে যাবি। বাবা ফোন ঘেঁটে একটা ছবি বের করলেন। ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে পাশাপাশি অনেকগুলো ম্যাচের কাঠি রাখা। একপাশ থেকে আগুন লেগেছে, আগুনটা একটা থেকে আরেকটা ম্যাচের কাঠিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাঝখান থেকে একটা ম্যাচের কাঠি সরিয়ে দেয়া হয়েছে, ফলে আগুনটা আর তারপরের কাঠিগুলো পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। বাবা বললেন, দেখেছিস? ব্যাপারটা এমন। করোনাভাইরাস একটা সংক্রামক রোগ। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। যদি কোনভাবে ঘুরতে গিয়ে তুই করোনা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে আসিস, তাহলে তুই একা আক্রান্ত হবি না, তোর আশপাশের অন্যদেরও আক্রান্ত করে ফেলবি। কিন্তু তুই যদি সামাজিক দূরত্ব রাখিস, বাসায় থাকিস, অনেক মানুষ বেঁচে যাবে। তিতলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বুঝেছি বাবা। কিন্তু আমার সারাদিন বাসায় বসে থেকে ভাল লাগে না। আমি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। বাবা চশমাটা ঠিক করতে করতে বললেন, কেন বিরক্ত হচ্ছিস? ঘরে বসেও তো অনেক কাজ করা যায়। অনেক চমৎকার সব কাজ। তোরা তো এই প্রজন্ম সেসব কিছু জানিসই না! তিতলি জিজ্ঞেস করল, কেমন কাজ? বাবা বললেন, এই যে দেখ, তুই কতদিন তোর দাদাভাই আর দাদুমণির সঙ্গে ঠিক করে বসে কথা বলিস না বল তো? তিতলি একটু ভেবে বলল, জানি না তো। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কেন বলিস না? তিতলি বলল, সময় পাই কোথায় বাবা? স্কুল থেকে ফিরেই তো একটু বিশ্রাম নিতে না নিতে টিচার চলে আসে। তারপর এত্তগুলো হোমওয়ার্ক থাকে। এই করতে করতেই তো রাত হয়ে যায়। বাবা বললেন, ঠিক তাই। অথচ এখন এসব কোন চাপ নেই। এখন তুই বসে দাদাভাই আর দাদুমণির সঙ্গে একটু গল্প করতে পারিস। তাদের কাছে অনেক গল্প শুনতে পারিস। আমাদের ছোটবেলার গল্প, তাদের ছোটবেলার গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, গ্রামবাংলার গল্প। নানাভাই আর নানুমণিকে ফোন করে একটু গল্প করতে পারিস। তাদের সবারই বয়স হয়েছে, তাদের তো আমাদের সময় দেয়া উচিত, তাই না? তিতলি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক বলেছ বাবা। বাবা বললেন, তারা যত গল্প জানেন, এত গল্প তোরা সারাজীবন শুনলেও শেষ হবে না! তাছাড়া, তোরা তো পড়ার চাপে গল্পের বইও পড়িস না একদম। এখন তো বসে একটা দুটো গল্পের বই পড়তে পারিস। এগুলো পড়লে নির্মল আনন্দ যেমন পাবি, অনেক জানতে পারবি। কল্পনাশক্তি বাড়বে, সৃজনশীলতা বাড়বে। ছবি আঁকতে পারিস। ডায়েরি লিখতে পারিস। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে সেসব ঘটনার সময়ে কারও লেখা ডায়েরিগুলো। করোনাভাইরাসের এই সঙ্কটের সময়গুলোর কথা ডায়েরিতে লিখে রাখতে পারিস। পরবর্তীতে এটাই হয়তো এই সময়টার সাক্ষী হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতের মানুষেরা জানতে পারবে এই সঙ্কটের সময়ের কথা। তিতলি বিজ্ঞ মানুষের মতো মাথা ঝাঁকাল। বলল, এসব তো আমার মাথায় আসেনি বাবা! বাবা বললেন, এসব কেন মাথায় আসবে? তোদের মাথা তো শুধু কতগুলো বই মুখস্থ করা, স্মার্টফোন আর কম্পিউটার গেমসের মধ্যে বন্দী। তিতলি ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, আমি সব কাজ শুরু করব আজকে থেকেই। বাবা বললেন, হ্যাঁ, কর। তারপর যদি বাসায় বসে ভাল না লাগে, তখন বলিস। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে তিতলি বলল, আচ্ছা। তারপর আবার বলল, কিন্তু বাবা, আমরা কি কিছু করতে পারি না অন্যদের সাহায্য করার জন্য? বাবা একটু ভেবে বললেন, পারি তো। সচেতনতা তৈরি করতে পারি সবার মধ্যে। এই যে দেখ, আমরা বাসার যে লিফট ব্যবহার করছি, সবাই আঙুল দিয়ে লিফটের বাটন চাপে। কত জীবাণু আসে সেখান থেকে। তারপর দেখ, বাইরে থেকে কত মানুষ বিল্ডিং-এ ঢোকে। একেকজন একেক জায়গা থেকে আসে। কেউ জানে না নিজের সঙ্গে ভাইরাস নিয়ে এসেছে কিনা। এই ব্যাপারে আমরা একটা কিছু করতে পারি। তিতলি জিজ্ঞেস করল, কী করতে পারি বাবা? বাবা বললেন, আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা সুন্দর বুদ্ধি দেখলাম। লিফটের ভেতর যদি আমরা কতগুলো টুথপিক রেখে দিই, তাহলে আঙুল ব্যবহার না করে ওই টুথপিক দিয়ে সবাই বাটন চাপতে পারবে। একটা ঝুড়ি রাখতে হবে লিফতে যেখানে ব্যবহৃত টুথপিক ফেলা হবে। তিতলি লাফিয়ে উঠল। বলল, এটা তো দারুণ বুদ্ধি বাবা! আমরা আজকেই এটা করব! কিন্তু বাইরে থেকে যারা আসবে তাদের ব্যাপারে কী করা যায়? গেট দিয়ে ঢোকার সময় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা যায়? বাবা বললেন, এই তো! ঠিক বলেছিস। ব্যবস্থা করা যায় না, করতে হবে। নিচে একটা বেসিনের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে হ্যান্ডওয়াশ রাখা থাকবে। যারা বাইরে থেকে আসবে, তারা সবাই গেট দিয়ে ঢোকার পর ভাল করে হাত ধুয়ে তারপর বাসায় ঢুকবে। কথাটা বলে বাবা বললেন, সবাই একটু একটু করে নিজের জায়গা থেকে যদি চেষ্টা করি আমরা, তাহলে দেখবি অনেক বড় একটা কাজ হয়ে যাবে। ওই যে বিন্দু বিন্দু জলে সিন্ধু হওয়ার মতো ব্যাপার। সবাইকে সচেতন হতে হবে। নিজের জায়গা থেকে যতটুকু করা যায়, ততটুকুই করার চেষ্টা করতে হবে। আর এই করোনাভাইরাস কিন্তু আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে যাচ্ছে। এই শিক্ষাগুলো নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে হবে। করোনাভাইরাস আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার গুরুত্ব শেখাচ্ছে। শুধু নিজের কাজে আমরা ব্যস্ত থাকি, পরিবারকে সময় দিই না। এখন গৃহবন্দী থেকে আমরা বুঝতে পারছি পরিবারের মানুষগুলো- এই যেমন তোর দাদাভাই আর দাদুমণি- তাদের সঙ্গে সময় কাটানো কতটা আনন্দের এবং কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমরা এটা শিখছি যে কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে অন্যদের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের জায়গা থেকে নিজেকেই আগে প্রথম পদক্ষেপটা নিতে হয়। তিতলি বাবার গলা আবার জড়িয়ে ধরে বলল, ঠিক বলেছ বাবা। বাসায় থাকাটা আসলে অনেক কিছু শেখাচ্ছে আমাদের। তবে কী জানো বাবা? এই সময়টা পেরিয়ে গেলেও আমি দাদাভাই আর দাদুর সঙ্গে প্রতিদিন গল্প করব, যত কাজ থাকুক। গল্পের বই পড়ব, ছবি আঁকব। আমরা সবাই একসঙ্গে খাবারের টেবিলে বসে গল্প করব। ব্যাপারগুলো অনেক সুন্দর, তাই না বাবা? বাবা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হ্যাঁ মা। খুব সুন্দর। আর সেই সুন্দর জিনিসগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের পৃথিবীটাকে সুস্থ রাখতে হবে। পৃথিবী সুস্থ না হলে আমরা কেউ সুস্থভাবে বাঁচতে পারব না। তিতলি বলল, পৃথিবী ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে বাবা। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করব এখন থেকে পৃথিবীকে ভাল রাখার। পৃথিবী তো আমাদের বাড়ি। পৃথিবী ভাল থাকলে আমরাও ভাল থাকব। তাই না বাবা? বাবা তিতলিকে বুকে আঁকড়ে রাখলেন। কপালে একটা চুমু দিলেন। মনে মনে বললেন, হ্যাঁ মা। আমাদের এই সুন্দর ভালবাসাগুলোকে ভাল রাখতে হলে পৃথিবীকে তো ভাল রাখতেই হবে আমাদের।
×