ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়া শহরের তীরের করতোয়া- সুখ ও আনন্দের নদী আজ নগরীর কান্না

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৪ এপ্রিল ২০২০

 বগুড়া শহরের তীরের করতোয়া- সুখ ও আনন্দের নদী আজ নগরীর কান্না

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ ভূগোলের পাঠ- ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। বগুড়া করতোয়া নদীর তীরে। প্রমত্তা এই নদীগুলো ছিল নগরীর সুখ ও আনন্দ। কালের প্রবাহে এই দুই নদী এখন নগরী ও মহানগরীর কান্না ও দুঃখ। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর পানির রং কালো ও দূষিত। বগুড়া নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর অবস্থা এমনই- দেখে মনে হবে উপচেপড়া ময়লার ভাগাড়ের ধারে এক মটির ড্রেন। ভূমি দস্যুরা এই নদীভূমি দখল করে গড়ে তুলছে অবকাঠামো স্থাপনা। কাগজে কলমে বলা হয় করতোয়া মৃতপ্রায় নদী। এখন আর মৃতপ্রায় নেই। সুধীজন বলেন করতোয়াকে ভেন্টিলেশনে (লাইফ সাপোর্টে) রাখা হয়েছে। সাধারণজন বলেন, একদার প্রমত্তা করতোয়াকে কার্যত হত্যা করা হয়েছে। অতীতে শহরের ধারের করতোয়া নৌপথে বড় বজরা নৌকা বিভিন্ন স্থানে চলাচল ও ঘাটে বাণিজ্যের বড় নৌকা ভিড়ত। ষাটের দশকের মধ্যভাগে করতোয়া নদীর ওপর পাকা ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। কিছুদিন ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌপথ চালু ছিল। আশির দশকের শেষের দিকে করতোয়া নদী দখলের পালা শুরু হয়। এরপর আর থামেনি। করতোয়া দখলের উৎসব যে কত তা খালি চোখেই দেখা যায় বগুড়া জেলা প্রশাসন অফিসের পেছনে গেলে। ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ নদীর দুই তীরে যে যেভাবে পারছে দখলী প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। কেউ মাটি ভরাট করে প্রকাশ্যে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। কেউ চার ধারে টিনের চালায় ঘিরে গোপনে ভেতরে নির্মাণ কাজ করছে। বগুড়া নগরীর নবাববাড়ি সড়কের ধারে কয়েকটি অভিজাত মার্কেটের পেছনে গেলে দেখা যায় নদীভূমি কতটা দখল করে নদীর প্রস্তকে ছোট করা হয়েছে। এদিকে প্রায় ৭০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বগুড়া পৌরসভার যত আবর্জনা ও ময়লা সবই ফেলা হয় করতোয়ায়। শহরের ফতেহআলী বাজার সংলগ্ন করতোয়া নদীর ভেতরে ফেলা হয় কসাইয়ের জবেহ করা গরু ছাগলের মাংসের বর্জ্য। করতোয়ার সঙ্গে লিঙ্ক ড্রেন বানিয়ে হাস মুরগির বিষ্ঠা ফেলে পানি ঢেলে দেয়া হয়। কখনও পৌর কর্তৃপক্ষের গারবেজবাহী ঠেলাগাড়ি ময়লা ঢেলে দেয় করতোয়া নদীর মধ্যে। বছর কয়েক আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন নদী দখলকে অবৈধ ঘোষণা করে দখলের সকল কাজ বন্ধ করে দেন। ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০ এর ৩৩৫ ও ৩৩৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে নদীভূমি দখল করা দ-নীয় অপরাধ। এমনকি নদী তীরের কোন মালিক নদীর তলদেশ ও ফোরশোর (নদীর দুই তীরে যে অংশ শুকনো মৌসুমে চর পড়ে বর্ষায় ডুবে যায় না) এই অংশ কোন ভাবে দখলে নেয়া যাবে না। তিনি বদলি হওয়ার পর তার উত্তরসূরী নূরে আলম সিদ্দিকী নদীভূমি দখলকারীর তালিকা তৈরি করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দখল ছেড়ে দেয়ার নোটিস দেন। তারপর উচ্ছেদ অভিযানের শুরুতেই কয়েক ব্যক্তির মামলাজনিত কারনে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ পূর্বসুরীর অনুসরণে নদী দখলের উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন। অভিযান শুরুর পর্যায়ে কিছু ছোট স্থাপনা উচ্ছেদের পর বড় ও প্রভাবশালীদের স্থাপনা ভাঙ্গতে গেলে আইনী বাধার মুখে পড়েন। এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তার স্থাপনা যে বিতর্কিত নয় এর মীমাংসা না হওয়ার কাগজ উত্থাপন করলে উচ্ছেদ সাময়িক বন্ধ করা হয়। এরপর বগুড়া নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযান আর হয়নি। উল্লেখ্য- ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে নদী ও খাল বিলের পানির প্রবাহের বাধা সৃষ্টিকারী সব ধরনের স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রত্যেক জেলার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) জরুরী ভিত্তিতে লিখিত নির্দেশনা দেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব। নদী ভূমি অবৈধভাবে দখল উচ্ছেদের তালিকায় ৫ নম্বরেই আছে বগুড়ার করতোয়া নদী। এদিকে নদীর দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান জানান বগুড়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী ড্রেজিং করে দুই ধারে দীর্ঘ সড়ক ও বাগান, বিনোদনের আকর্ষণীয় স্পট গড়ে তোলার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর পর বগুড়া পাউবোর কাছে কয়েকটি বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে। উত্তর জমা দেয়া হয়েছে। এরপর আরও দুই ধাপ আছে। আরেকটি প্রকল্পে বগুড়াকে কেন্দ্রবিন্দু করে উত্তরে গাইবান্ধা ও দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্যে বয়ে যাওয়া ২শ’ ১৭ কিলোমিটরের মৃতপ্রায় নদীগুলোর নাব্য ফিরিয়ে গভীরতা ও স্রোতধারা বাড়ানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাঙালী, করতোয়া, ফুলজোড় ও হুরাসাগর নদী পূর্বাবস্থার (জোয়ারের নদী) ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং পুনর্খননের পর নদীর প্রবাহ ধরে রাখতে তীর সংরক্ষণ করা হবে। চারটি নদীর জোয়ারে বড় নদী যমুনার স্রোতধারা বেড়ে আরও অন্তত পাঁচটি নদী পূর্বের ধারা ফিরে পাবে। এই প্রকল্পেও বগুড়া নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলা আছে। সাধারণের প্রশ্ন ; কবে নাগাদ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে আর কবে করতোয়া দখলমুক্ত হবে।
×