ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার ফার্মেসিগুলোয় মাস্ক বা পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ৪ এপ্রিল ২০২০

 ঢাকার ফার্মেসিগুলোয় মাস্ক বা পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কোন ফার্মেসির সামনে দড়ি বেঁধে সীমানা দেয়া, কিন্তু ভেতরে কর্মচারীদের কারও হাতে গ্লাভস নেই। যদিও সবার মুখে মাস্ক আছে। এভাবেই ওষুধ বিক্রি করছেন তারা। হাত পরিষ্কার করছেন দীর্ঘ সময় পর পর। আবার কোন ফার্মেসিতে দেখা গেছে, বিক্রয়কর্মীসহ সংশ্লিষ্টরা পিপিই পরিধান করে কাজ করছেন। সামনের গ্লাস ডোর লাগানো আছে। সুস্থ-অসুস্থ অনেক ক্রেতা স্টিলের হাতল ধরে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছেন, বের হচ্ছেন। কিন্তু হাতলটি পরিষ্কার করা হচ্ছে না। ভেতরে ক্রেতাদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা। কাউন্টারে দায়িত্বরতরা গ্লাভস পরে টাকা নিচ্ছেন-দিচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু লেনদেনের পর হাত পরিষ্কার করছেন না। এভাবে একের পর এক ক্রেতার সঙ্গে লেনদেন করছেন তারা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ছোটবড় ফার্মেসিগুলোয় এই দৃশ্য দেখা গেছে। ফার্মেসিতে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা সচেতনতার ঘাটতির কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ফার্মেসির মতো জায়গায় অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে যথাযথ জ্ঞান ফার্মেসি সংশ্লিষ্টদের থাকতে হবে। সচেতনভাবে সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে ক্রেতাদেরও নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। অসুস্থ কেউ থাকলে বা হাঁচি-কাশি থাকলে ওই ব্যক্তির বাজার বা ফার্মেসির মতো জায়গায় যাওয়া যাবে না। ঘরে থাকতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল কবীর বলেন, ‘করোনাভাইরাস হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। লক্ষণ আছে কিন্তু অনেকে সেটা হাইড করে চলছেন। বাজারে যাচ্ছেন, ফার্মেসিতে যাচ্ছেন। এটা করা যাবে না। তাদের বাসায় থাকতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সন্দেহভাজন হলে বা লক্ষণ উপসর্গ থাকলে টেস্ট করানো হবে। এর আগে ঘরেই থাকতে হবে। হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সচেতন হতে হবে। হাঁচি-কাশির সময় শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে।’ ফার্মেসিগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে চলছে না পাশাপাশি মানুষও অসতেনভাবে চলাফেরা করছেন। উভয়পক্ষের গাফিলতির কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ডাঃ আব্দুন নূর তুষার। তিনি বলেন, ‘এই সময়ে সবার আগে ক্রাউড কন্ট্রোল করতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠানের ভেতরে একাধিক ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে দিয়ে ক্রাউড তৈরি করা যাবে না। উপায় না থাকলে পর্যায়ক্রমে সীমিত সংখ্যক মানুষকে ভেতরে ঢুকতে দিয়ে সামাজিক দূরত্ব (ছয় মিটার) বজায় রাখতে হবে।’ রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকার ফার্মেসিগুলোতে দেখা গেছে, কোনটিতেই শতভাগ সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। চেন ফার্মেসিগুলোর কর্মীদের পিপিই পরিধান করতে দেখা গেছে। তারা জানান, একজন কর্মীর জন্য একটি করে পিপিই বরাদ্দ করা হয়েছে। ফার্মেসিতে কাজ শেষ হওয়ার পর কর্মীরা সেগুলো বাসায় নিয়ে যান। পরিষ্কার করে পরদিন আবারও একই পিপিই পরে কাজ করেন। নিজেদের উদ্যোগে কর্মীদের সুরক্ষার জন্য পিপিই ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন লাজ ফার্মার প্রজেক্ট ম্যানেজার রাসেল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘এই শাখায় আমাদের ৫০ জনের মতো স্টাফ আছে। তাদের প্রত্যেকের জন্য পিপিই’র ব্যবস্থা করা হয়েছে। পিপিইগুলো ধোয়া যায়। কর্মীরা বাসায় নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করেন। পরদিন আবারও সেটা ব্যবহার করা যায়। তবে কোন কারণে নষ্ট হয়ে গেলে বা ছিঁড়ে গেলে সেটা জমা দিলে নতুন পিপিই দেয়া হবে।’ রাজধানী অধিকাংশ চেন ফার্মেসিতে ক্রেতাদের অরক্ষিত রেখেই নিজেদের কর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন আরেকটি চেন ফার্মেসি ‘ওয়েলবিয়িং’। তারা গ্লাস ডোর বন্ধ রেখে ওষুধ বিক্রির করেন। হাতল ঠেলে ভেতরে ঢুকতে হয়। ভেতরে ঢুকে ক্রেতারা ওষুধ কিনছেন। গ্লাভস পড়ে ক্যাশ সামলালেও লেনদেনের পর হাত পরিষ্কার করতে দেখা যায়নি কর্মীদের। যদিও ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মোঃ সুলায়মান হাত পরিষ্কার না করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেক কর্মীর জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করেছি। তারা নিয়মিত হাত পরিষ্কার করেন। দরজার হাতল পরিষ্কার না করার বিষয়ে মোঃ সুলায়মান বলেন, ‘দরজা সব সময় খোলাই থাকে। যাতে কাউকে ঠেলে প্রবেশ করতে না হয়। এখন হয়ত বন্ধ হয়ে আছে। আর হাতল আমরা নিয়মিতই পরিষ্কার করে থাকি।’কিন্তু এর আগে ‘ওয়েলবিয়িং’ নামে এই ফার্মেসির সামনে ২০ মিনিটের বেশি সময় দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, পাঁচজন ক্রেতা ভেতরে প্রবেশ করেন। প্রত্যেকেই হাতল ঠেলে ভেতরে গেছেন। আবার হাতল টেনে বাইরে এসেছেন। এই সময়ের মধ্যে একবারের জন্যও হাতল পরিষ্কার করা হয়নি। পাশেই রয়েছে ‘এসকে ফার্মেসি’ নামে আরেকটি চেন ফার্মেসি। এই ফার্মেসির ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা নেই। ক্রেতাদের ওষুধ কিনতে হচ্ছে বাইরে দাঁড়িয়ে। তবে ভেতরে অবস্থান করা কর্মীদের অধিকাংশ সুরক্ষিত ছিলেন না। তাদের হাতে গ্লাভস ছিল না। খালি হাতেই ক্রেতাদের হাতে ওষুধ তুলে দিচ্ছেন। আবার একই হাতে টাকা নিচ্ছেন। হাত পরিষ্কারও করছেন না। মোহাম্মদপুর বাঁশবাড়ি সড়কে রেশমা ফার্মেসি, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ওষুধ কিনতে হয় ক্রেতাদের। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ফার্মেসির সামনে দড়ি বেঁধে রাখতে দেখা গেছে। তবে ভেতরে অবস্থান করা মালিক বা কর্মচারীরা কেউই গ্লাভস পরে কাজ করছেন না। ফার্মেসির মালিক গোলাম মোস্তফার দাবি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। কর্মীদের সবাইকে গ্লাভস ও স্যানিটাইজার দেয়া আছে। এমনকি ক্রেতাদেরও ফার্মেসিতে রাখা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে দেয়া হচ্ছে। মুখে এমনটি দাবি করলেও প্রায় ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ক্রেতাদের হাত পরিষ্কার করার ঘটনা চোখে পড়েনি। করোনা পরিস্থিতিতে একটি ফার্মেসি কিভাবে পরিচালিত হতে পারে, তার একটি মডেল জানিয়েছেন ডাঃ আব্দুন নূর তুষার। তিনি একটি মডেল ফার্মেসির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘যে কোন দোকান বা ফার্মেসির প্রবেশমুখে অবশ্যই আলাদা কাউন্টার থাকতে হবে। কাউন্টারে কাঁচ থাকা চাই। এখানে ক্রেতারা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াবেন। একজন আরেকজনের থেকে তিন ফুট দূরত্বে সারি বেঁধে দাঁড়াবেন। আর মুখোমুখি দাঁড়ালে ছয় ফুট দূরত্ব থাকতে হবে। লাইনে দাঁড়িয়ে সবার প্রেসক্রিপশন কাউন্টারে জমা দিতে হবে। ডেলিভারিম্যান প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ এনে নাম ধরে ডাকবেন, এরপর ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করে চলে যাবেন। যারা ভেতর থেকে ওষুধ এনে দেবেন, তাদের হাতে গ্লাভস থাকতে হবে। ওষুধ হাতে নেয়ার পর ক্রেতা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ওষুধ নিয়ে বাসায় যাবে। কোনভাবেই গাদাগাদি বা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ানো যাবে না।’
×