ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নেই বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ কালো ধোঁয়া

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ৩ এপ্রিল ২০২০

  নেই বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ কালো ধোঁয়া

শাহীন রহমান ॥ করোনার প্রভাবে বদলে যাওয়া ঢাকায় এখন সবকিছুই বদলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে পরিবেশ। নেই চিরায়িত শব্দ দূষণের যন্ত্রণা। বাইরে বের হলেই আর বায়ুদূষণের কবলে পড়তে হচ্ছে না কারও। বায়ুদূষণ এখন বিপদসীমার অনেক নিচে নেমে গেছে। দূষণে ধুঁকতে থাকা দেশে ফুসফুস এখন ক্রমেই সতেজ হয়ে উঠছে। নেই কোন যানজট গাড়ির কালো ধোঁয়া। খাল জলাশয়ের পানির দুর্গন্ধও কমে গেছে। পানির রং স্বচ্ছ ধারণ করতে শুরু করেছে। তবে সর্বত্রই যেন সুনশান নিরবতা। তবে এই নিরবতায় নগরজীবনকে বেশি আতঙ্কিতও করে তুলেছে। গত ৮ মার্চ থেকে দেশে প্রথমবারের মতো করোইভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর পর থেকে প্রতিদিন কেউ না কেউ সংক্রমিত হচ্ছে। এটি মোকাবেলায় সরকার ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। আর এই সুযোগ নিয়ে রাজধানীর অধিকাংশ ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। যারা আছেন তাদের ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। সরকারী এই নিয়ম মেনে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না কেউ। ফলে যান চলাচল নেই। ফলে শব্দ দূষণ বায়ুদূষণ কিছুই আর আগের মতো নেই। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সবকিছুতেই এখন বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত। লকডাউনের কারণে এখন দূষণের পারদ এখন নিম্নমুখী। রাজধানীতে এখন নেই চিরায়ত শব্দ দূষণ। বাতাসে বিষাক্ত ধুলিকণার উপস্থিতি কমে গেছে অনেক। হাতিরঝিলসহ কোন কোন এলাকার পানির স্বচ্ছ রূপ ধারণ করতে শুরু করেছে। তবে ঢাকার চার নদী এখন বিষাক্ত পানিতে ভরপুর। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে এই লকডাউন যদি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় তবে ঢাকার নদীর পানিও দূষণমুক্ত হয়ে যাবে। ফিরে পারে তার প্রাণ বৈচিত্র্য। তবে তারা এও বলছেন যে জনজীবন স্বাভাবিক হলে রাজধানীর পরিবেশে যেন স্বাভাবিকতা বজায় থাকে। শুধু বাংলাদেশেই যে দূষণ কমে গেছে তা নয়। দক্ষিণ এশিয়াসহ পুরো ইউরোপে যেখানে দূষণে জর্জরিত ছিল তা এখন বলতে গেলে নেই। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কার পাশাপাশি আশাও প্রকাশ করেছেন যে লকডাউন যদি দীর্ঘমেয়াদী চলে তাহলে অর্থনীতির উপর চরম প্রভাব পড়বে। মানুষের আর্থিক অবস্থা চরম খারাপ হবে। পাশাপশি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে মুক্তি পাবে। রাজধানীর যান্ত্রিক যান্ত্রণা নামে খ্যাত ছিল শব্দ দূষণ। প্রতিনিয়ত এই দূষণে কান ঝালাপালায় অস্থির ছিল পুরো রাজধানীবাসী। বর্তমানের অবস্থা যেন কোন কোথা কেউ নেই। সন্ধ্যা নামলে রাজধানী সুনশান নীরব হয়ে যাচ্ছে। দিনের বেলায়ও এক ভীতিকর অবস্থার বিরাজ করছে। সরকার প্রসীতি নীতিমালায় যেখানে এলাকা ভেদে ৩৫ থেকে ৭৫ ডেসিবল ছিল শব্দে বেঁধে দেয়া মাত্রা। এর বিপরীতে শব্দের মাত্রা ছিল ১২০ থেকে ১৩০ ডেসিবল পর্যন্ত। সেই চিরচেনা রাজধানীতে এখন শব্দের মাত্রা ১০ ডেসিবল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতই নীবর হয়ে গেছে চিরচেনা রাজধানীতে এখন পিনপতন নিরবতা। রাজধানী ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় দূষণে ধুঁকতে থাকা দেশের ‘ফুসফুস’ কিন্তু ক্রমশই সতেজ হয়ে উঠছে। লকডাউন ঘোষণার পর থেকে কল-কারখানা প্রায় বন্ধ। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই। অযথা আওয়াজ নেই। ফলে নতুন করে যেন অক্সিজেন ফিরে পেয়েছে শহর। করোনার কারণে আইসোলেশনে থাকা ঢাকার দূষণের বিষ কমেছে অনেকটাই। বাতাসে বিষের পরিমাণ বিপদসীমার অনেকটাই নিচে নেমে গিয়েছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছেন শহরবাসী। রাজধানীতে বড় বড় প্রকল্পের কর্মকান্ড থেমে গেছে নেই কোন যানবাহন। এর প্রভাব পড়ছে বায়ু দূষণের উপর। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবদি যেখানে ধুলিকণায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত ঢাকা আকাশ সেখানে এখন স্বচ্ছ রূপ নিয়েছে। এমন বায়ু দূষণমুক্ত পরিবেশ ঢাকা এর আগে কখনও দেখেনি। রাজধানী জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এখন বাসাবাড়িতে ধুলিকণা জমে না। পরিবেশটা এত স্বচ্ছ যে রাতে আকাশও এখন পরিষ্কার দেখা যায়। জোসনা রাতে চাঁদের আলো ঠিকই পড়ছে রাজধানীর বুকে। গাড়ির কালো ধোঁয়া নেই এখন। অথচ ক’দিন আগে রাজধানীর বাতাস ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকার চারপাশে ইটভাঁটির কারণে এখন বায়ু বিষাক্ত কণার উপস্থিতি রয়েছে। তবে তা সীমিত মাত্রায় রয়েছে। বাতাসে যেটুকু বিষাক্ত কণা রয়েছে এর জন্য দায়ী চারপাশের ইটভাঁটিগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখনও ঢাকার অনেক ইটভাঁটি চালু হয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কর্মকা-ও কিছু অব্যাহত রয়েছে। তবে লকডাউন আর কিছুদিন অব্যাহত থাকলে বায়ু মান একেবারের স্বচ্ছ রূপ নিতে পারে। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, আগের চেয়ে বায়ু মান অনেক উন্নতি হয়েছে। যানবাহন চলছে না। মানুষের চলাফেরা নেই। এই অবস্থায় আগের চেয়ে বায়ু দূষণের কমেছে। ধীরে ধীরে আরও উন্নতির কথা জানান তিনি। তবে তিনি বলেন ইটভাঁটির কারণেই ঢাকার বাতাস বেশি দূষিত হয়ে পড়েছিল তার এই লকডাউনে মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে। শুধু শব্দ দূষণ বা বায়ু দূষণ কমছে তা নয়। এই লকডাউনের ফলে পরিবেশে সব সেক্টরের এখন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খালগুলো যেখানে দূষিত আবর্জনায় ভরা থাকত, রাত দিন দুর্গন্ধ ছড়ানো সেখানে আজ উন্নতির আভাস। মানুষের চাপ কমে যাওয়া বিষাক্ত হয়ে যাওয়ায় এই পরিবেশ এখন বেশ উন্নতির পথে। এই তালিকায় যোগ হয়েছে রাজধানীর হাতিরঝিল। প্রতিদিন এর পাশ দিয়ে গেলে নাকে এসে লাগত উৎকট দুর্গন্ধ। অথচ এই কয়দিনে ঝিলে সেই চিরাচরিত বৈশিষ্ট্যও আর নেই। পানি স্বচ্ছ রূপ ধারণ করতে শুরু করেছে। নেই কোন দুর্গন্ধ। রাজধানীর বিভিন্ন জলায়শয়ের অবস্থাও এখন ভালর পথে। কলকারখানা বন্ধ থাকায় নদীতে আর মিশছে না বিষাক্ত তরল বর্জ্য। সরেজমিন দেখা গেছে হাতিরঝিলে সেই পরিবেশ আর নেই। এখন অনেকটাই উন্নতির পথে। পানি রং স্বচ্ছ ধারণ করতে শুরু করেছে। ময়লা পড়ছে না। দুর্গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্বের পরিবেশ এখন স্বচ্ছতায় রূপ নিয়েছে। ভাইরাস ঠেকাতে বিশ্বের নানা দেশ লকডাউনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এ কারণে এসব দেশে যান চলাচল ও কলকারখানা প্রায় বন্ধ। গৃহবন্দী বহু মানুষ। বাইরে মানুষের চলাফেরাসহ অন্যান্য তৎপরতা এক রকম বন্ধ হওয়ায় বিশ্বের সব জায়গায় বাতাসে দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। রয়্যাল নেদারল্যান্ডস মেটিওরোলোজিক্যাল ইনস্টিটিউট (কেএনএমআই) এই মানচিত্রে দেখা গেছে, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। এ কারণে বাতাসে দূষণের মাত্রা কমতে শুরু করেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে মূলত বাতাস এত দূষিত হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছে এক সময় করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আবার জনজীবন স্বাভাবিক হবে। তখন কিন্তু দূষণের মাত্রা আবার বাড়তে থাকবে। তবে সরকার এবং সাধারণ সচেতন হলে স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া দূষণের হার অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
×