ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রামে কয়েকটির অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে

করোনা সতর্কতার মধ্যেও মেগা প্রকল্পের কাজ চলবে

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ৩ এপ্রিল ২০২০

  করোনা সতর্কতার মধ্যেও মেগা প্রকল্পের কাজ চলবে

মোয়াজ্জেমুল হক/ হাসান নাসির ॥ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে ছুটিসহ ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বহু মেগা প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, উদ্ভূত পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এসব মেগা প্রকল্প সম্পন্নের কাজ নিশ্চিতভাবে পিছিয়ে যাবে। পাশাপাশি প্রকল্প ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি সংশ্লিষ্ট খাতসমূহে নানারকম সমস্যার উদ্ভব হবে। এরপরও সংশ্লিষ্ট মেগা প্রকল্পসমূহের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সূত্রে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে এই বলে যে, সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস প্রতিরোধমূলক সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমান সরকারের গৃহীত মেগা প্রকল্পসমূহের অনেকই চট্টগ্রামভিত্তিক। ঢাকায় বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক জাপানী বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন কিন্তু চট্টগ্রামের মেগা প্রকল্পে জড়িত চীনা নাগরিকদের বাংলাদেশ ত্যাগের পরিকল্পনা এখনও নেই বলে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। অন্যতম মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল (কর্ণফুলী টানেল) কার্যক্রমে নির্মাণ সংশ্লিষ্ট মালামাল আমদানি ও খালাস কাজ ব্যাহত হয়ে আছে। এ প্রকল্পের উচ্চপর্যায়ের কয়েক কনসালট্যান্ট করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে নিজ নিজ দেশে চলে গেছেন। তবে প্রকল্পের সঙ্গে নিযুক্ত বিপুলসংখ্যক চীনা নাগরিক অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে ২৭ জন নিজ দেশ চীনে গিয়ে এখনও ফিরে আসেননি বা আটকা পড়ে আছেন। এ প্রকল্পটি চীনের সঙ্গে জি টু জি একটি প্রকল্প। অপরদিকে, শুধু মেগা প্রকল্প নয়, সরকারী কোষাগারে সর্বোচ্চ রাজস্ব জোগানদাতা সংস্থা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দৈনিক গড় আয়ে মারাত্মক ভাটা পড়েছে। পাশাপাশি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে কন্টেনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। এর ফলে চলমান অর্থবছরে নির্দিষ্ট আয় থেকেও এ বন্দর বঞ্চিত হবে। অনুরূপভাবে চট্টগ্রামে দেশের বৃহত্তম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (সিইপিজেড)-এর পাশাপাশি কর্ণফুলী ইপিজেড, আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড, প্রস্তাবিত চীন অর্থনৈতিক জোন এবং মীরসরাইতে চলমান বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরের কার্যক্রম বিভিন্নভাবে ইতোমধ্যে ব্যাহত হতে শুরু করেছে। এসব ছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে খাল সংস্কার কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এ প্রকল্পটিও সরকার মেগা প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন প্রতিষ্ঠাপূর্ব ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম সরকারী ছুটি ঘোষিত হওয়ার কারণে বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রক্রিয়াটি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও প্ল্যানিং সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে মাতার বাড়িতে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার থেকে এলএনজি আমদানির পর সরবরাহ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে মাতারবাড়ি থেকে পেকুয়া এবং চকরিয়া হয়ে এলএনজি সরবরাহের যে পাইপ লাইন কার্যক্রম চলছিল তা থমকে গেছে। এছাড়া মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত প্রকল্পের কাজেও ভাটা পড়েছে। যদিও এসব প্রকল্পে জড়িত বিদেশীদের কেউ প্রকল্প এলাকা ছেড়ে যাননি এখনও। মহানগরীতে চট্টগ্রাম সিটি রিং রোড কার্যক্রম, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর), যা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অন্যতম বড় প্রকল্প। একদিকে সরকারী ছুটি এবং অপরদিকে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক কর্মচারীদের অনুপস্থিতিতে প্রকল্প কাজ ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির নির্বাহী সদস্য (অতিরিক্ত সচিব) শেখ হারুনুর রশীদ বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে জানান, মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে মাটি ভরাট, সড়ক ও সরোবর তৈরিসহ শ্রমিকনির্ভর কাজগুলো চলমান রয়েছে। কিন্তু যে সকল কাজের সঙ্গে বিদেশী বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট এবং আমদানিনির্ভরতা রয়েছে সেগুলোর কাজ গতি হারিয়েছে। চীনা একটি কেমিক্যাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানার কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির দ্রুত উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। এর জন্য প্রয়োজন ছিল কাঁচামাল আমদানি। কিন্তু করোনা সতর্কতার কারণে বাণিজ্য বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করতে পারছে না। ফলে কবে নাগাদ বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরের প্রথম প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে যেতে সক্ষম হবে তা এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। বেজা’র এ কর্মকর্তা জানান, টেকনাফের সাবরাংয়ে বাস্তবায়নাধীন ট্যুরিজম পার্কের কাজেও ধীরগতি এসেছে করোনার কারণে। তবে সেখানেও দেশী শ্রমিকনির্ভর কাজগুলো এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। আনোয়ারায় বাস্তবায়নাধীন চীনা ইকোনমিক জোন প্রকল্পের কাজও মাঠে গড়াতে সময় নেবে একই কারণে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম জনকণ্ঠকে জানান, করোনা সতর্কতায় সার্বিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। কাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। তিনি জানান, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রামের সাগর পাড়ে বে-টার্মিনাল এবং আরও কয়েকটি প্রকল্পের জন্য পরামর্শক নিয়োগের কাজ প্রক্রিয়াধীন ছিল। কিন্তু এখন এ কাজগুলো থেমে গেছে। করোনা ঝুঁকি সম্পূর্ণ দূর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে এখন আর উপায় নেই। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, করোনা আতঙ্ক ও সতর্কতায় আমদানি-রফতানি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিদেশ থেকে জাহাজ আসা কমেছে। আমদানির যে কন্টেনারগুলো নামানো হচ্ছে তা ডেলিভারি হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর পদক্ষেপ হিসেবে দীর্ঘ ছুটির কারণে এই স্থবিরতা। এতে বন্দর ইয়ার্ডে প্রতিদিনই বাড়ছে কন্টেনার। ইয়ার্ডে বর্তমানে ধারণক্ষমতা প্রায় ৪৯ হাজার টিইউএস কন্টেনার। এখনই কন্টেনারের পরিমাণ ৪৫ হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ইয়ার্ডে আর পণ্য রাখার জায়গা থাকবে না। যন্ত্রচালিত ইক্যুইপমেন্টগুলো চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় অপারেশনাল কর্মকা- মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিবহন বিভাগ সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার এ নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর তা হলো ছুটির মধ্যে কোন আমদানিকারক যদি পণ্য ডেলিভারি নিতে চান তাহলে দ-ভাড়া ছাড়াই নিয়ে যেতে পারবেন। বন্ধের মধ্যে গণরিবহন বন্ধ থাকলেও পণ্য পরিবহন চলাচলে বাধা নেই। ফলে আমদানিকারকরা এ সুযোগ গ্রহণ করবেন বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে দৈনিক টার্গেট ১২০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত একসপ্তাহে তেমন রাজস্বই আদায় হয়নি। কারণ শুধু জরুরী পণ্য ছাড়া শুল্কায়ন বন্ধ ছিল। তবে রমজানকে সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের শুল্কায়নের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ফলে আগামী সপ্তাহ থেকে শুল্কায়ন কিছুটা বাড়লেও তা হবে খুবই সামান্য। কারণ নিত্যপণ্যের ওপর শুল্কহার নামমাত্র। এদিকে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন মেগা প্রকল্পসমূহের কাজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে কর্মকর্তা কর্মচারীদের ছুটি ঘোষিত হওয়ায়। এর পাশাপাশি প্রকল্পে জড়িত নির্মাণ শ্রমিকরাও থাকছে গরহাজির। এ সংস্থার আউটার রিং রোড প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অন্যান্য প্রকল্পের অবস্থাও অনুরূপ।
×