ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোরসালিন মিজান

বায়ান্ন বাজান তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ৩ এপ্রিল ২০২০

বায়ান্ন বাজান তিপ্পান্ন গলি

নিষ্ঠুর এক বাস্তবতা। মানুষ যে সমাজবদ্ধ জীব, আজ যেন তা মিথ্যা হতে চলেছে। একে অন্যের কাছাকাছি থাকার, হাতে হাত রেখে চলার রীতি এতকাল পর আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। সময়ের দাবি হয়ে সামনে এসেছে ‘সোশ্যাল ডিসটেন্স।’ বিশেষজ্ঞরা রীতিমতো অনুনয় করে বলছেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। দুজনের মধ্যে অন্তত তিন ফিট দূরত্ব রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। হ্যাঁ, প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনা গোটা বিশ্বকে এমন উল্টো রীতি মেনে চলতে বাধ্য করছে। বাংলাদেশেও তা-ই। অনেক দিন হয়ে গেল, ঘরে ঢুকেছে মানুষ। ছবিটা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান রাজধানী শহর ঢাকায়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ক্লান্ত শ্রান্ত মেগাসিটি এখন স্থবির। জরুরী সেবাগুলো ছাড়া বাকি সব অফিস আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। প্রধান প্রধান রাস্তা ফাঁকা। চিরচেনা যানজট নেই। বরং একটার বেশি দুটো গাড়ি একসঙ্গে দৃশ্যমান হলে, কাউকে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে দেখলে অনেকে চোখ বড় করে তাকাচ্ছেন। এর আগে গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানা যায়। ক্রমে সংখ্যাটি বাড়তে থাকে। আসে মৃত্যুর খবরও। এ অবস্থায় একমাত্র করণীয় হিসেবে ঘরে ঢোকার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে রাজধানীবাসী। ২০ মার্চের দিকে নিত্য পণ্যের দোকানগুলোতে ভিড় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আগেভাগেই মাছ মাংস দিয়ে ফ্রিজ ভর্তি করেছেন অনেকে। চাল ডাল আলু পেঁয়াজ তেল লবণ মরিচ ইত্যাদির দাম চড়া হলেও, কিনেছেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত। অনেক দিন ঘরে থাকার লক্ষ্যেই এমন পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন তারা। সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ থেকে পুরোপুরি ঘরে ঢুকে পড়ে মানুষ। ওইদিন থেকে সরকারী ছুটি। দ্বিতীয় দফায় ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকবে সব। বাস্তবতা মেনে নিয়ে ঘরবন্দী হয়েই আছে মানুষ। সাধারণ সময়ে এত ছোটাছুটি, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে দৌড়ে পারা যায় না। অথচ বর্তমানে সময় কাটানো দায়। নানাজন নানাভাবে সময় কাটানোর চেষ্টা করছেন। উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এখন ঢাকার প্রায় সব বাসা বাড়ি ওয়াইফাই সুবিধার আওতায়। আলাদা করে বিল গুনতে হয় না। ফলে ইন্টারনেটেই বেশি ব্যস্ততা। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের স্ত্রিনে চোখ রেখে পৃথিবী দেখার চেষ্টা করছেন। ফেসবুকে দারুণ সক্রিয় তারা। প্রতি ঘণ্টায় স্ট্যাটাস। আলোচনা। তর্ক বিতর্ক। চলছেই। গত কয়েকদিন ফেসবুকের নিউজফিড ঘুরে দেখা যায়, এই সমালোচনা সেই সমালোচনায় মুখর হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়া অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বানও জানানো হচ্ছে বিভিন্ন আইডি থেকে। তবে সব দেখে মনে হয়েছে, কাজ করার লোক অপেক্ষাকৃত কম। কথা বলারই লোক বেশি। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর প্রবণতাটি হলো, গুজবের চর্চা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। সেই মোহ পেয়েছে এমনকি লেখাপড়া জানা লোকজনদেরও। এর বাইরে অনেকে নেটফ্লিক্সে বা ইউটিউবে সিনেমা দেখে সময় কাটাচ্ছেন। ঘরের ভেতরেই কেরাম দাবা ইত্যাদি খেলছেন। বই পড়ার অভ্যাস যাদের আছে তারা সময়টিকে আরও মূল্যবান করে তুলছেন। সব মিলিয়ে মোটামুটি কেটে যাচ্ছে সময়। শেষ করা যাক মন খারাপ করা খবরটি দিয়ে। এরই মাঝে সবাই জেনে গিয়েছেন যে, পহেলা বৈশাখের উৎসব অনুষ্ঠান এবার আর হচ্ছে না। বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার সকল আনুষ্ঠানিকতা বাতিল করা হয়েছে। ছায়ানটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাসজনিত দুর্যোগের কারণে রমনা বটমূলের প্রভাতী অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রণী প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর এ অনুষ্ঠান আয়োজন করলেও, এবার এর পরিবর্তে বিপন্ন দুস্থ মানুষকে অন্ন জোগানোর কাজ করবে। এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবেই বলতে হয় যে, বাঙালীর আপন সত্তার স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা আর মানবকল্যাণের ব্রত নিয়ে ১৯৬১ সালে ছায়ানটের জন্ম। সংগঠনটি বরাবরই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। লক্ষ্য অর্জনে ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন রমনা বটমূলে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে আসছে। ১৯৭১ সাল ছাড়া এ অনুষ্ঠান কখনও বন্ধ রাখা হয়নি। এমনকি ২০০১ সালে মৌলবাদীদের নৃশংস বোমা হামলার পরও আয়োজন থেকে সরে আসেনি ছায়ানট। এবার করোনাভাইরাসের কারণে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব বাতিল করতে হলো। সত্যি বেদনার। একইভাবে বাতিল করা হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার আকর্ষণীয় আয়োজনটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ অন্যান্য বছর এ সময়ে কী যে ব্যস্ত সময় পার করে! বৃহস্পতিবার অনুষদের সামনে গিয়ে দেখা গেল সুনসান নীরবতা। সামনের তিনটি গেট বন্ধ। তালা দেয়া। বিষয়টি নিয়ে ফোনে কথা হচ্ছিল, অনুষদের ডিন নিসার হোসেনের সঙ্গে। তিনিও জানালেন, মন খুব খারাপ। কিন্তু বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন তারা। মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবেই এবার বন্ধ রাখা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। অন্য আয়োজনগুলোও একইভাবে বন্ধ থাকবে। সরকারীভাবেও এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে ঘরে বসেও বাঙালিত্বের সাধনা হতে পারে। এবার তা-ই হবে বলে আশা করছেন রাজধানীবাসী।
×