ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন

গৃহবধূ রেহেনা একজন সফল উদ্যোক্তা

প্রকাশিত: ০৮:২২, ৩ এপ্রিল ২০২০

 গৃহবধূ রেহেনা একজন  সফল উদ্যোক্তা

রেহেনা বেগম (৪৫)। একজন সফল উদ্যোক্তা। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক তাকে ঘুরে দাঁড়াতে পাশে ছিল। পারিশ্রমিক এই নারী নিজ বাড়ির উঠানে মুরগির খামার, কোয়েল পাখির খামার, চীনা মুরগি (তিথি), টার্কি ও গাভী প্রতিপালন করে খামার গড়ে তুলেছে। সেই সঙ্গে নিজের বাড়িতে স্থাপিত ইনকিউবেটর মেশিনে প্রতিমাসে ডিম থেকে গড়ে প্রায় ৪ হাজার বাচ্চা ফুটাচ্ছে। এসব খামার ও ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বিক্রি করে প্রতিমাসে সব খরচ শেষে নিট আয় করছে ৩৫ হাজার হতে ৪০ হাজার টাকা। খামারের দেখাশোনা করছে মা পাশাপাশি বড় ছেলে। প্রতিদিন ২/৩ জন মহিলা খামারে স্থায়ী কর্মসংস্থান হয়েছে। ২৫ বছর আগে রেহেনা বেগমের বিয়ে হয় রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার বাঘমারা গ্রামে। গ্রামটি তিস্তা নদীর পাড়ে অবস্থিত ছিল। স্বামী মোঃ মকবুল হোসেনের সঙ্গে প্রায় ১০ বছর সংসার ভালভাবেই সচ্ছলতার সঙ্গে চলে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ ১৫ বছর আগে তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে সেই সংসারে ছন্দপতন ঘটে। বাড়িঘর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। মুহূর্তে রেহেনা ও তার স্বামী পথের ফকির হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে প্রায় ১৫ বছর আগে লালমনিরহাট জেলা সদরের রাজপুর ইউনিয়নের বালাপাড়া গ্রামে তার বাবার বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে ঠাঁই পায়। স্বামী দিনমজুরি করে অতিকষ্টে সংসার চালায়। সংসারে সব সময় অভাব অনটন লেগেই থাকত। ২৫ বছরের এই সংসার জীবনে কোলজুড়ে আসে তিনটি পুত্র সন্তান। তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এই চিন্তায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। স্বামী মকবুল রাজপুর ইউনিয়নে গ্রাম পুলিশের চাকরি পায়। এই সুবাদে স্বামীর কাছে রেহেনা বেগম শুনতে পায়। প্রশিক্ষণ নিয়ে গবাদি পশু ও মুরগির খামার করা যায়। এই খামার করতে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ঋণ দেয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে গবাদি পশু পালনের প্রশিক্ষণ নিয়ে আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক হতে ৮ হাজার টাকা ঋণ নেয়। সেই ঋণ নিয়ে ছোট ছোট ৪টি বাচ্চা ছাগল বাজার হতে কিনে নিয়ে এসে প্রতিপালন শুরু করে। এভাবে দুই বছরে ৪টি ছাগল হতে ১৬টি ছাগল হয়। ছাগলগুলো বিক্রি করে প্রায় ৪৮ হাজার টাকা বিক্রি করে। পুনরায় আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক হতে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ১৬ হাজার টাকা ঋণ নেয়। ছাগল বিক্রির টাকা, ঋণের টাকায় ও কিছু টাকা আত্মীয়স্বজনদের কাছে ধারে নিয়ে একটি বিদেশী গাভী কিনে। গাভী পালনের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় রেহেনা বেগমের জীবনযুদ্ধ। বাবার বাড়ি ও নিজের ঘর সংসারের কাজ শেষ করে প্রতিদিন বিকেলে গাভীর জন্য কাঁচা ঘাস সংগ্রহ করে এনে গাভীকে খাওয়ায়। একটি গাভী দিয়ে শুরু। পরের বছর আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক হতে নেয়া ১৬ হাজার টাকা ঋণ আয় থেকে পরিশোধ করে। পুনরায় ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেয়। এই ঋণ ও নিজের জমানো অর্থ দিয়ে আরও একটি বিদেশী গাভী কিনে। দুই গাভী পালন শুরু করে। এভাবে ২০২০ সালের মার্চ মাসে এসে তার খামারে ৬টি বিদেশী গরুর মালিক হয়েছে। এই গাভীগুলোর মধ্যে একটি বকনা বাছুর রয়েছে। বর্তমানে তার গরুর খামার থেকে প্রতিদিন ৩০/৩৫ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিলিটার দুধ ৪০ টাকা দরে বাজারের বিক্রি হয়। এই দুধ বিক্রি হতে প্রতিদিন তার আয় ১৪শ টাকা। তার বাড়িতে রয়েছে সোনালী মুরগির খামার। এই খামারে আছে প্রায় ২২হাজার ৫শ’ টাকা মূল্যের মুরগি। বয়লার মুরগির খামারে আছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা মূল্যের বয়লার মুরগি। কোয়েল পাখির খামার আছে প্রায় ১৫ হাজার টাকার কয়েল পাখি। ফাইটার মুরগির খামারে আছে প্রায় ১৬ হাজার টাকার ফাইটার মুরগি। চীনা মুরগি (তিথি) খামারে রযেছে প্রায় ১১ হাজার টাকার চীনা মুরগি ও টার্কির খামারে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা মূল্যের টার্কি। যা বিক্রি করলে এক লাখ ১৪ জাহার ৫শ’ টাকা হবে। রেহেনা বেগমের বাড়িতে এ বছর সরকার বিদ্যুত পৌঁচ্ছে দিয়েছে। এই বিদ্যুত পৌঁচ্ছে যাওয়ায় তিনি একটি অটোমেটিক ইনকিউবেটর যার ডিম ফুটানোর ধারণক্ষমতা প্রায় ২৪শ’ ও একটি ম্যানুয়াল ইনকিউবিটর যার ডিম ফুটানোর ধারণ ক্ষমতা ৩শ’ ক্রয় করেছে। রয়েছে স্যাটার একটি ও হ্যাচার একটি। যার মূল্য প্রায় ৬০ হাজার টাকা। আপদকালীন বিদ্যুত উৎপাদনে ৩ হাজার ওয়ার্ডের একটি পুরনো জেনারেটর ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছে। বর্তমানে রেহেনা বেগম বাবার দেয়া কয়েক শত বসত ভিটার সঙ্গে নিজে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে গ্রামে ১৪শ’ জমি কিনেছে। সাড়ে ৪ লাখ টাকা ফসলের জমি বন্ধক নিয়েছে ৪ বিঘা। এই জমির ফসল দিয়ে সারা বছর পরিবারের খাবারের যোগান হয়ে। তাছাড়া খাবারের চাহিদা মিটিয়ে ফসল বিক্রি করে বছরে ৩ বার কিছু অর্থ হাতে আসে। রেহেনা বেগম ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ৩ রুমবিশিষ্ট টিন সেড পাকা ঘর করেছে। এই ঘরটি বসবাসের জন্য করলেও এখন গাভীর খামার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে রেহেনা বেগম স্বামী ও তিন পুত্র সন্তান নিয়ে সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করেছে। তার বড় পুত্র মোঃ আরিফ হাসান (২২) ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। একটি দুর্ঘটনায় তার পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পড়াশোনা এখন বন্ধ। মাকে সাহায্য করতে মার গড়ে ওঠা খামারগুলো পরিচালনা করছে। মেঝ ছেলে মোঃ আতিকুর হাসান স্থানীয় রাজপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। সব ছোট ছেলে মোঃ আরাফাত হাসান বালাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষার্থী। এই নারী এসএমই ঋণ নিয়ে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়েছে। এখন গ্রামে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তার দেখাদেখি তার গ্রামে ১০/১২ জন নারী তার মতো করে খামার শুরু করেছে। রেহেনা বেগম জেলা সদরের রাজপুর ইউনিয়নের বালাপাড়া আমার বাড়ি আমার খামার গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সমিতিরও সদস্য। ২০১৪ সালে এই সমিতি যাত্রা শুরু করেছিল। তার সমিতিতে ৬০ জন করে সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে ৪০ জন নারী। প্রতি মাসে প্রতি সদস্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংককে দুই শত টাকা জমা করে। সরকার প্রতি তিন মাস পরপর জন প্রতি ৬শ’ টাকা করে প্রণোদনা দেয়। এভাবে বর্তমানে তাদের সমিতির মূলধন ১১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের সমিতি এই রাজপুর ইউনিয়নে ৩০টি রয়েছে। প্রকল্প ও সঞ্চয় ব্যাংক সমিতির মূলধন এক কোটি ২৮ লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে। সদর উপজেলা সমন্ময়কারী ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক লিটন কুমার রায় জানান, সদর উপজেলায় আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সমিতি রয়েছ ১৬৭টি। যার সদস্য সংখ্যা ৯হাজার ৫০৮জন। মূলধন প্রায় ১০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সমিতি রয়েছে ১১৩টি। সদস্য সংখ্যা ৫ হাজার ৯শত জন। মূলধন দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি টাকায়। এই প্রকল্প ও সঞ্চয় ব্যাংক হতে এই উপজেলায় এসএমই ঋণ ১১০ জনের মাঝে ৫৬ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তবে কিছু সমস্যা রয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের দিকে এই প্রকল্পগুলোতে জনবলের অভাব ছিল। তখন ঋণ বিতরণে সদস্য বাছাই সঠিকভাবে হয়নি। ফলে সেই সময়ের দায় নিয়ে চলতে হচ্ছে। তাই আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পে শতকরা ৫ভাগ ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে ঋণ আদায়ের হার খেলাপীর হার শতকরা ৫২ ভাগ। লালমনিরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সুবিধাভোগী বাছাই কমিটির সভাপতি উত্তম কুমার রায় জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগ গুলো সুন্দর। এতে এনজিওগুলোর ঋণের দৌরাত্ম্য কমেছে। গ্রামীণ নারীদের বিশাল ক্ষমতায় ঘটেছে।
×