ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারী অধিকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৮:২১, ৩ এপ্রিল ২০২০

নারী অধিকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু আমাদের পরম ভালবাসার, পরম শ্রদ্ধার মানুষ তিনি। শত বছরের শোষণ বঞ্চনা, নির্যাতন নিপীড়নের হাত থেকে বাঙালীকে মুক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিশ্ব মানচিত্রে উপহার দিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম নতুন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ছিলেন আপোষহীন। তিনি শুধু বাঙালীর নেতা নন, বিশ্ববাসীর কাছেও একজন মহান ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত আজও বিশ্ববাসীর কাছে অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সিদ্ধান্তে ছিল বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, মেধা, মহানুভবতা এবং প্রজ্ঞার ছাপ। বঙ্গবন্ধুর সকল ভাষণ, কর্মকান্ড, শাসন প্রণালী, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের খেতাব প্রদান ও জীবনচরিত বিশ্লেষণে সুস্পষ্ট হয়, তিনি সারাজীবন বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু তাঁর সমাজ সংস্কার বিশেষ করে নারী অধিকার রক্ষায় তাঁর বিশাল ভূমিকা খুব একটা আলোচিত নয়। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর সামাজিক অধিকার, সম্মানের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকেই অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নারীদেরও পুরুষদের মতো সমান অধিকার এবং তা রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আওয়ামী লীগ যেমন অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে তেমনি নর-নারীর সমান অধিকারেও বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগেও নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার।’ নিজের এই বক্তব্যের প্রতিফলন বঙ্গবন্ধু ঘটিয়েছিলেন দলের ভেতরে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায়। তার রাজনীতির সঙ্গে প্রথম থেকেই কিছু নারী নেতৃত্বের নামও আমরা জানতে পারি। যেমন- বদরুন্নেছা, আমেনা বেগম, জোহরা তাজউদ্দীন, বেগম নূরজাহান মুরশিদ প্রমুখ। বাংলাদেশের নারীকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর সংবিধানে যে বিধান রেখে গেছেন । ছয় দফার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে আমেনা বেগমকে (১৯২৫-১৯৮৯) দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের পদে মনোনয়ন দেন এবং ওই বছর ২৭ জুলাই আমেনা বেগমকে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। এই সময় আওয়ামী লীগের কোন কোন প্রবীণ পুরুষ নেতা আপত্তি তুলেছিলেন। বলেছিলেন, এই সংগ্রামের চরম মুহূর্তে একজন নারীকে দলের নেতৃত্ব দিলে হয়ত সাধারণ মানুষ সারা দেবে না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নারীদেরও পুরুষদের মতো সমান অধিকার এবং তা রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আওয়ামী লীগ যেমন অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে তেমনি নর নারীর সমান অধিকারেও বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগেও নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর সংগ্রামী রাজনীতিতে নিজের সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকেও জড়িয়েছিলেন। তিনি জেলে থাকতে বেগম মুজিব দলের নেতাদের সাহায্য ও পরামর্শ যোগাতেন। মায়া মমতা ভালবাসা দিয়ে দলের মানুষদের যেমন আঁকরে রাখতেন তেমনি বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতেন। শুধু ছেলেদের নয় নিজের দুই মেয়েকেও পিতার আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন বেগম মুজিব। যার ফলে আজ আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার মতো একজন আদর্শিক নেত্রীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পেয়েছি। ১৯৭২ সালে প্রণীত প্রথম ও মূল সংবিধান এবং পরবর্তীতে কয়েকটি সংশোধনীতে নারীদের বাড়তি সুযোগ সুবিধা ও সংরক্ষিত অধিকার দেয়ার কথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সরকারী চাকরি ও কর্মে সমান অধিকার নিশ্চিত করে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান কেবলমাত্র নারী-পুরুষের সমতাই নিশ্চিত করেনি, এ ছাড়াও সরকারী চাকরির নির্দিষ্ট আনুপাতিক সংখ্যক পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখার মাধ্যমে বিদ্যমান অসম প্রতিনিধিত্ব নিরসনের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করে। সংবিধানে সরকারী চাকরিতে মেয়েদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ অবারিত করে ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকারের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ের ১৫নং ধারার (ঘ) উপধারায়, সমাজের দুস্থ মানুষের পাশাপাশি বিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকারী সাহায্য লাভের অধিকারের কথা সংরক্ষিত করা হয়েছে। ১৭নং ধারার (ক) উপধারায়, একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক এবং বালিকার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করতে বঙ্গবন্ধু যান পাবনার বেড়া উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে। ওই অনুষ্ঠানে কয়েক নারী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে তাদের নির্যাতিত হওয়ার ভয়ঙ্কর সব ঘটনার কথা বলেন। তাদের কথায় বঙ্গবন্ধুর চোখ ছলছল করে ওঠে। তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন বঙ্গবন্ধু। পরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিতা মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্যই তারা ইজ্জত দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কম নয় বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই সব স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশে আমি বলছি যে, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহত স্ত্রীর স্বামী বা পিতা হয়েছেন। তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা।’ বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-১৯৭৮) পরিকল্পনায় স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ বিভিন্ন কর্মসূচী গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও। আর ঠিকানা লেখ ধানমন্ডি ৩২। ১৯৭২ জুড়ে দেশে অনেক যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের গ্রহণে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষ প্রস্তুত ছিল না। বঙ্গবন্ধু সরকার এ সময় বিদেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা করেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আইনের। এই সমস্যা সমাধানে তিনি ১৯৭২ সালে Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order, 1972 (P.O. No. 124 of 1972) জারি করা হয়। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন ফর রিহ্যাবিলিটেশন, মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটির মাধ্যমে বহু যুদ্ধশিশুকে বিদেশে দত্তক দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দত্তক হয়নি এমন শিশুদের বিভিন্ন শিশুসদনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। (তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ, নিউইর্য়ক)। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার, সামাজিক সম্মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং তাদের ত্যাগের স্বীকৃতিতে ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড ’ গঠন করেন। বাংলার নারীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নারী সংগঠন মহিলা সংস্থার ভিত্তি রচনা করেন। শিশু ও কিশোরীদের আত্মমর্যাদায়বোধ প্রতিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান গার্লস গাইড এ্যাসোসিয়েশনকে ঢেলে সাজান এবং পুনর্গঠিত করেন। সংবিধানের ২৭ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ২৮১ ধারায় রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।’ ২৮২ ধারায় আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ ২৮৩ ধারায় আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষ ভেদে বা বিশ্রামের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।’ ২৮৪ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের কোন অনগ্রসর অংশের প্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ ৬৫(৩) ধারায় নারীর জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষিত হয়েছে এবং ধারার অধীনে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। সত্তর দশকের প্রথমভাগ থেকেই তৎকালীন সরকার নারী উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। বঙ্গবন্ধু নারী ক্ষমতায়নের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন তার উপরই দাঁড়িয়েছে বর্তমান বিশ্বের ‘রোল মডেল’ সৌধ। এই সময়ে শুধু সংসদেই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী শীর্ষস্থান দখল করে আছে সগর্বে। জাতীয় রাজনীতির পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছেন নারী। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার চলতি মেয়াদের শাসনামলে নারীর ক্ষমতায়ন নতুন মাত্রা পায়। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সফলতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ২০১৫ সালে গুরুত্বপূর্ণ ‘উইমেন ইন পার্লামেন্টস গ্লোবাল ফোরাম এ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে। ইউএন উইমেন ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘প্লানেট ফিফটি ফিফটি চ্যাম্পিয়ন’ সম্মাণে ভূষিত করে এবং গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম নারী ক্ষমতায়নে ব্যাপক অবদান রাখার জন্য তাঁকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ এ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে এবং নারীর যথাযথ মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন। তিনি যতবার ক্ষমতায় এসেছেন নারীর ক্ষমতায়নে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়েছেন।
×